ফিচার

ফ্রিল্যান্সিংয়ে মাসে আয় ৪ লাখ টাকা

মুহাম্মদ শফিকুর রহমান

Advertisement

মাত্র সাত বছর বয়সে বাবাকে হারান। স্বপ্ন ছিল আইনজীবী হওয়ার। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি পাস করলেও মাস্টার্স শেষ করতে পারেননি। পরিবারে আর্থিক টানাপোড়েন লেগেই ছিল। তাই পড়াশোনা বাদ দিয়ে আয়ের পথ খুঁজতে শুরু করেন। বর্তমানে তিনি কাজ করেছেন বিদেশি দুটি কোম্পানির সঙ্গে। নিজেও খুলেছেন একটি এজেন্সি। মাসে তার আয় চার থেকে ছয় হাজার ডলার। বাংলাদেশি টাকায় ৪ থেকে ৬ লাখ টাকা। জীবনযুদ্ধে সফল এ ফ্রিল্যান্সারের নাম সাদী রহমান।

ছোটবেলা থেকে আইনজীবী হওয়ার স্বপ্ন দেখলেও সাদীর মা চাইতেন ছেলে কম্পিউটার সংক্রান্ত কোনো কাজ করুক। মায়ের ইচ্ছায় কম্পিউটার শিখতে গিয়েই সাদী ফ্রিল্যান্সিংয়ের কথা জানতে পারেন। সেসময় কম্পিউটার বা স্মার্টফোন কিছুই ছিল না সাদীর। পরিচিত একজনের বাসায় গিয়ে কম্পিউটার চালাতেন। পরে মা এবং বোনের কাছ থেকে টাকা নিয়ে পুরোনো একটি কম্পিউটার কিনে আনেন বাড়িতে। দিনভর টিউশনি করতেন। রাত হলেই ফ্রিল্যান্সিংয়ের চর্চা চালিয়ে যেতেন। এক পর্যায়ে সাদীর মনে হয়েছিল তাকে দিয়ে কিছুই হবে না। একটি কাজও পাচ্ছিলেন না তিনি। তারপরও হাল ছেড়ে দেওয়া সম্ভব হয়নি তার। পরিবারের কথা তাকে ভাবতে হয়েছে।

নিজ থেকে ইউটিউবে কাজ শেখার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু বেশি কিছু শিখতে পারেননি। কোথাও কোর্স করবেন সে সামর্থও ছিল না তার। সাব্বির নামে এক বড় ভাই তখন আপওয়ার্কে কাজ করতেন। তার দ্বারস্থ হন সাদী। তিনি সাদীকে ফ্রিল্যান্সিংয়ে কাজ পাওয়ার খুঁটিনাটি কৌশল দেখিয়ে দেন। ২০১৬ সাল এভাবেই কেটে যায়। ২০১৭ সালের ১৯ জানুয়ারি আপওয়ার্কে ৫ ডলারের কাজের মাধ্যমে আয়ের শুরু সাদীর। এই কাজের সপ্তাহ খানের মধ্যে দুইশ ডলারের একটি কাজ পান সাদী। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে।

Advertisement

আরও পড়ুন: খুনি শামুকের কামড়ে মরতে পারে মানুষও

আইন বিষয়ে পড়েও আইন পেশায় তার যাওয়া হয়নি। সাদীর গ্রামের বাড়ি শেরপুর জেলার শ্রীবরদী থানায়। ঢাকার উত্তরায় মা, স্ত্রী, ভাই-বোনদের নিয়ে তার বসবাস। বীর মুক্তিযোদ্ধা লুৎফর রহমান মডেল স্কুল থেকে এসএসসি এবং শ্রীবরদী সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেছেন তিনি। এরপর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি করেন। তবে বর্তমানে একজন সফল ফ্রিল্যান্সার সাদী। হয়েছেন অনেক তরুণের আইডল।

ফ্রিল্যান্সিং হলো নানা রকম কাজের জায়গা। শুধু প্রয়োজন দক্ষতা। সাদী এটা ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন। সে কারণে ২০১৭ সালে তিনি মার্কেটিং রিলেটেড কাজ করেন। ২০১৮, ২০১৯ ওয়ার্ডপ্রেস ডেভেলপার হিসেবে নজর কাড়েন সবার। ২০২০ থেকে ২০২২ সাল। এ সময়ে সিআরএম ডেভেলপার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। কর্নারআপ, দ্য বিএমএস কোম্পানি নামে দুটি কোম্পানির সঙ্গে স্থায়ীভাবে কাজ করছেন। ইউএসএ, কানাডা, ইউকে, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া, ইন্ডিয়া, সুইডেন, নিউজিল্যান্ড ও ডেনমার্কের ছোট-বড় অনেক কোম্পানির মালিক এখন তার ক্লায়েন্ট। এ পর্যন্ত ৬০০টিরও বেশি প্রজেক্ট সফলভাবে সম্পন্ন করার কারিগর তিনি। এছাড়া কিছুদিন তিনি ফেসবুক, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম, লিঙ্কডইনে অ্যাডভার্টাইজিংয়ের কাজ করেছেন। ভালো কাজের জন্য গুগল থেকে সনদও জুটেছে সাদীর ঝুলিতে। যোহো সিআরএম, হাবস্পট সিআরএম, পিপিড্রাইভ সিআরএম, য্যাপার নিয়েও অনেক কাজ করেছেন বিগত বছরগুলোয়। এ পর্যন্ত আপওয়ার্কে তার কাজের সংখ্যা ৩০০টিরও বেশি। ফাইবারে তিনি প্রজেক্ট বেসিস কাছ বেছে নেন।

প্রথমদিকে বারবার ব্যর্থ হলেও ধৈর্য ধরে লেগে থাকা। নিজের অদম্য মনোবল। পাশাপাশি মায়ের দোয়াই ছিল সাদীর সাফল্যের মূলমন্ত্র। সাদী এগুলোকে তার সফলতার নেপথ্যের কারণ বলে মনে করেন। জীবনের প্রথম আয় ছিল ৩ হাজার ৩২০ টাকা। এখন মাসে ৪-৬ হাজার ডলার তার আয় হয়। ভালো কাজ করলে স্বীকৃতি তো মিলবেই। সাদীর বেলায়ও তাই হয়েছে। তিনি বিএএসআইএস থেকে ডিস্ট্রিক্ট ইন্ডিভিজুয়াল ক্যাটাগরিতে বেস্ট ফ্রিল্যান্সার ২০২১ নির্বাচিত হন।

Advertisement

বাংলাদেশের ই-কর্মাস ইন্ডাস্ট্রিকে ডেভেলপ করার ভাবনা তার অনেকদিন ধরেই। এ ভাবনা থেকেই তিনি অ্যাম্পার ডিজিটাল নামে একটি এজেন্সি খুলেছেন। তার পার্টনার হিসেবে আছেন টড থিয়েড নামে একজন। সেখানে আরও পাঁচজন কর্মী কাজ করছেন, যার তিনজনই বাংলাদেশি। এজেন্সির কাজ সম্পর্কে সাদী বলেন, আমরা এমন একটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান তৈরি করতে যাচ্ছি, যেখানে মানুষ সহজে ঘরে বসে কেনাকাটা করতে পারবেন। ক্রেতারা তাদের পণ্য হাতে পাবে দ্রুততম সময়ে কোনো রকম ঝামেলা ছাড়াই। উপরন্তু পেমেন্ট করার সম্পূর্ণ অথরিটি কাস্টমারদের দেওয়া হবে।

আরও পড়ুন: কিডনির পাথর দিয়ে স্টোনহেঞ্জ বানালেন স্থপতি

অনেক আগ্রহ নিয়ে তরুণ-তরুণীরা ফ্রিল্যান্সিংয়ের জগতে আসেন। তবে এদের অধিকাংশই অল্প কিছুদিনে গাছের শুকনো পাতার মতো ঝরে পড়েন। নিজেকে টিকিয়ে রাখতে পারেন না মোটেই। এর কারণ হিসেবে সাদী বলেন, দক্ষতা এবং ধৈর্যের অভাব। তিনি বলেন, ফ্রিল্যান্সিং একটি ইন্টারন্যাশনাল মার্কেট প্লেস। এ প্লেসে শুধু দক্ষতা দিয়ে আয় করা সম্ভব। অন্যথায় কিছুদিন টিকে থাকলেও পরে মার্কেট প্লেস থেকে ঝরে পড়ে যেতে হবে।

সাদী নিজেও প্রায় এক বছর পরিশ্রম করেছেন। একটি টাকাও আয় করতে পারেননি। ওদিকে পরিবারে চরম অর্থনৈতিক সংকট ছিল। সেই দিনগুলোর কথা এখন আর মনে করতে চান না সাদী। তিনি বলেন, সারাদিন টিউশনি করে রাতে ফিরে কম্পিউটারের সামনে বসতাম। কখন ভোর হয়ে যেত, টেরই পেতাম না। ইউটিউব, ফেসবুকে কোর্স করলেই লাখ টাকা আয় করা সম্ভব। এমন চটকদার বিজ্ঞাপনের বিষয়ে তিনি নতুনদের সতর্ক থাকার আহ্বান জানান। তিনি নতুনদের ধৈর্য, শিক্ষা এবং অক্লান্ত পরিশ্রম করার পরামর্শ দেন।

কেএসকে/এমএস