কৃষি ও প্রকৃতি

যে পদ্ধতিতে উৎপাদন হবে বিষমুক্ত শুঁটকি

কৃষিবিদ ফরহাদ আহাম্মেদ

Advertisement

রোদে মাছ শুকিয়ে শুঁটকি করার সময় এক ধরনের মাছির লার্ভা বা শুককীট শুঁটকি মাছের মারাত্মক ক্ষতি করে। এ থেকে রক্ষার জন্য শুঁটকি মাছ উৎপাদনকারীরা মাছ শুকানোর আগে কাঁচা মাছে বিষাক্ত কীটনাশক প্রয়োগ করেন। এতে উৎপাদিত শুঁটকি মাছ বিষাক্ত হয়ে যায়। যা খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য ভীষণ ক্ষতিকর।

শুঁটকি মাছ উৎপাদনকারীরা যখন কীটনাশক প্রয়োগ করেন তখনই শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে তাদের শরীরে কীটনাশক ঢুকে যায়। কারণ আমাদের দেশের মানুষ কীটনাশক প্রয়োগের নীতিমালা কখনই মেনে চলে না।

শুঁটকিভোজী মানুষ এই কীটনাশকযুক্ত শুঁটকি মাছ খাওয়ার ফলে তাদের শরীরে বিভিন্ন ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পরে। যেমন, শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়, লিভার, ফুসফুস এবং কিডনি সহজেই রোগাক্রান্ত হয়, হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ে ও প্রজনন ক্ষমতার উপর প্রভাব পড়ে। অন্যদিকে নারীদের অকাল গর্ভপাত, মৃত অথবা বিকলাঙ্গ সন্তান জন্ম হতে পারে। কাজেই নিরাপদ জীবনের জন্য কীটনাশকমুক্ত শুঁটকি মাছ উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি।

Advertisement

বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ১২-১৩ লাখ মেট্টিক টন সামুদ্রিক ও স্বাদু পানির মাছ উৎপাদন হয়। এর মধ্যে প্রায় ১৫ শতাংশ মাছকে রোদে শুকিয়ে শুঁটকি করা হয়। মাছ রোদে শুকানোর সময় লুসিলিয়া কিউপ্রিনা প্রজাতির ক্ষতিকারক মাছি মাছে ডিম পেড়ে শুককীট বা লার্ভা উৎপাদন করে। মাছির এই লার্ভাগুলো মাছ খেয়ে নষ্ট করে। এই বন্য মাছির আক্রমণে প্রায় ৩০ শতাংশ শুঁটকি মাছ নষ্ট হয়ে যায়।

এতে প্রতি বছর দুই থেকে তিনশত কোটি টাকার শুঁটকি মাছ নষ্ট হয়। এই মাছির ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য মাছে ক্ষতিকারক বিষ ও অতিরিক্ত লবণ প্রয়োগ করছেন শুঁটকি উৎপাদকরা। এতে ভোক্তা ও উৎপাদক উভয়েরই স্বাস্থ্যের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে।

একারণে শুঁটকির গুণগত মান কমে যাচ্ছে এবং উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। ফলে একদিকে শুঁটকির বাজারমূল্য কমে যাচ্ছে এবং অন্যদিকে শুঁটকি মাছ বিদেশে রপ্তানি করা যাচ্ছে না। এসব বিবেচনা করে বিষমুক্ত, নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত শুঁটকি মাছ উৎপাদনের লক্ষ্যে মাছি বন্ধ্যাকরণ প্রযুক্তির মাধ্যমে শুঁটকির ক্ষতিকারক আপদ দমনের প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছেন বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের বিজ্ঞানীরা।

মাছি বন্ধ্যাকরণ প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ক্ষতিকর মাছির বংশ বৃদ্ধি কমিয়ে শুঁটকি মাছের উৎপাদন ও গুণগতমান বৃদ্ধি করা সম্ভব। এই পদ্ধতিটি পরিবেশ বান্ধব, টেকসই, সহজ ও সাশ্রয়ী। এই পদ্ধতির মাধ্যমে নিশ্চিতভাবে বিষমুক্ত, নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত শুঁটকি মাছ উৎপাদন করা সম্ভব। এতে দেশীয় বাজারে শুঁটকি মাছের চাহিদা বেড়ে যাবে, শুঁটকি উৎপাদনকারীরা বেশি দাম পাবেন। পাশাপাশি ভোক্তা ও উৎপাদকরা উভয়ই স্বাস্থ্যহানি থেকে রক্ষা পাবেন। অন্যদিকে, বিষমুক্ত ও নিরাপদ এই শুঁটকি বিদেশে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করাও সম্ভব হবে।

Advertisement

বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন নব্বইয়ের দশক থেকে কক্সবাজারের মহেশখালীর সোনাদিয়া দ্বীপসহ অন্যান্য সামুদ্রিক শুঁটকি মাছ উৎপদান এলাকায় শুঁটকির আপদ নিয়ন্ত্রণে পরমাণু প্রযুক্তিতে উৎপাদিত বন্ধ্যা মাছি ব্যবহার করে আসছে। যদিও পূর্বে অনেক অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়েছে এ কাজে বর্তমানে এই অসুবিধাগুলো কাটিয়ে উঠে কার্যকরী ও সমন্বিতভাবে এই কাজ পরিচালনার মাধ্যমে বন্ধ্যা মাছি উৎপাদনের জন্য কক্সবাজারের কলাতলীতে সৈকত খনিজ বালি আহরণ কেন্দ্রে একটি গবেষণাগার স্থাপন করা হয়েছে।

এই স্থাপনায় এডিপি প্রকল্পের পরিচালক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকতা ড. প্রতুল কুমার রায়ের তত্ত্বাবধানে মাছি বন্ধ্যাকরণের জন্য ১টি কোবাল্ট-৬০ মোবাইল গামা ইরাডিয়েটর বসানো হয়েছে। যার মাধ্যমে প্রতি মাসে প্রায় ৩০ লক্ষাধিক বন্ধ্যা মাছি উৎপাদন করা সম্ভব এই গবেষণাগারে। এর লক্ষ্য হলো বিষমুক্ত, নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত শুঁটকি উৎপাদন।

বর্তমানে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের খাদ্য ও বিকিরণ জীববিজ্ঞান ইনিস্টিটিউটের বিকিরণ কীটতত্ত্ব ও মাকড়তত্ত্ব বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ড. এ টি এম ফয়েজুল ইসলামের নেতৃত্বে একদল বিজ্ঞানী এই কাজ পরিচালনা করছেন। ড. ফয়েজুল ইসলাম বলেন, বন্ধ্যাকৃত মাছির মাধ্যমে শুঁটকির আপদ দমন পদ্ধতিকে পোকা বন্ধ্যাকরণ প্রযুক্তি বলে। এই প্রযুক্তিটি হলো মাছির এক ধরনের জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি।

প্রাথমিক অবস্থায় শুঁটকি উৎপাদন এলাকা থেকে ক্ষতিকারক মাছি সংগ্রহ করে গবেষণাগারে বৃহদাকারে প্রতিপালন করে মাছির পিউপা বা মূককীটে গামা রশ্মি (কোবাল্ট-৬০) বিকিরণের মাধ্যমে তাদের বন্ধ্যা করা হয়। এরপর ঐসব শুঁটকি উৎপাদন এলাকায় বন্য মাছির কয়েকগুণ বেশি এই বন্ধ্যা মাছি অবমুক্ত করা হয়। তখন এই বন্ধ্যা মাছিগুলো মাঠের ক্ষতিকারক বন্য মাছির সাথে প্রজনন করে। যেহেতু প্রজননকৃত পুরুষ মাছি বন্ধ্যা তাই এদের শুক্রাণুর সক্রিয়তা থাকে না বিধায় স্ত্রী মাছির ডিম নিষিক্ত হয় না। ফলে স্ত্রী মাছি অধিকাংশ ক্ষেত্রে আর ডিম দেয় না।

যদি সামান্য কিছু ডিম দিয়ে থাকে ডিমগুলো নিষিক্ত না হওয়ায় ডিম থেকে আর শুককীট বের হয় না। যার জন্য ধীরে ধীরে ক্ষতিকর মাছির বংশ কমে যায়। সাথে সাথে শুঁটকি মাছে মাছির আক্রমণ কমে যায়। এভাবে বিষমুক্ত, লবণমুক্ত, নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত শুঁটকি উৎপাদনে পোকা বন্ধ্যাকরণ প্রযুক্তি কার্যকরী ভূমিকা রাখে।

ড. ফয়েজুল ইসলাম আরো বলেন, সোনাদিয়া একটি পৃথক দ্বীপ হওয়ায় এই পোকা বন্ধ্যাকরণ প্রযুক্তিটি সেখানে অধিকতর কার্যকর। কারণ বন্ধ্যা মাছি অবমুক্ত করার পর বাহির থেকে সেখানে আর ক্ষতিকর মাছি প্রবেশ করতে পারে না। ফলে সেখানে ক্ষতিকর মাছির সংখ্যা প্রাকৃতিকভাবে বৃদ্ধি পায় না ফলে বন্ধ্যা মাছি কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।

এই কার্যক্রমের আওতায় গত বছরের অক্টোবর হতে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত আনুমানিক দশ লক্ষাধিক বন্ধ্যা মাছি সোনাদিয়ায় অবমুক্ত করা হয়েছে।

এই প্রযুক্তি সম্পর্কে সরেজমিনে অবগত হওয়ার জন্য কক্সবাজার-২ (মহেশখালি-কুতুবদিয়া) আসনের সংসদ সদস্য আশেক উল্লাহ রফিক সংশ্লিষ্ট গণ্যমাণ্য ব্যক্তিবর্গ, প্রিন্টমিডিয়া ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকদের নিয়ে কক্সবাজারের কলাতলিতে অবস্থিত বন্ধ্যামাছি উৎপাদন কেন্দ্র পরিদর্শন করেন এবং সোনাদিয়ার শুঁটকি উৎপাদক, কক্সবাজারের শুঁটকি ব্যবসায়ী, পরমাণু শক্তি কমিশনের বিজ্ঞানী ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্যদের সাথে মতবিনিময় সভা করেন। তিনি গত ডিসেম্বরে সোনাদিয়ায় প্রায় তিন লক্ষাধিক বন্ধ্যা মাছি অবমুক্ত করেন ও সোনাদিয়ার শুঁটকি উৎপাদকদের সাথে এই প্রযুক্তির কার্যকারিতা নিয়ে আলোচনা করেন।

তাদেরকে এ কাজে সর্বাত্মক সহযোগিতা দেয়ার কথা বলেন। শুঁটকি উৎপাদকরা এ প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে সুফল পাওয়ার কথা জানান। মাননীয় সংসদ সদস্য শুঁটকি উৎপাদকদের শপথ পড়ান যে, কখনো যেন মাছে বিষ ও অতিরিক্ত লবণ মেশানো না হয়। তিনি আরো বলেন, ভবিষ্যতে সোনাদিয়ার শুঁটকি ব্র্যান্ডিং করা হবে এবং দেশের চাহিদা পূরণ করে বিদেশে রপ্তানির ব্যবস্থা করা হবে। এই প্রযুক্তিটি দেশের অন্যান্য শুঁটকি উৎপাদন এলাকায় ছড়িয়ে দেয়ার জন্য তিনি বিজ্ঞানীদের কার্যকর ভূমিকা রাখার পরামার্শ দেন।

দেশের অন্যান্য শুঁটকি উৎপাদন এলাকায় এই পোকা বন্ধ্যাকরণ প্রযুক্তির প্রসার ঘটিয়ে বেশি পরিমাণে বিষমুক্ত নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত শুঁটকি উৎপাদন করার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানান ড. ফয়েজুল ইসলাম। তিনি বলেন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ইয়াফেস ওসমানের নির্দেশনায় এই প্রযুক্তির ব্যবহারে প্রচার ও প্রসার ঘটানো হচ্ছে। যাতে করে প্রধানমন্ত্রীর কক্সবাজারের শুঁটকি ব্র্যান্ডিং করার অঙ্গীকার সর্বাত্মকভাবে পূরণ হয়। উৎপাদিত শুঁটকি মাছ সংরক্ষণকালে সংরক্ষণাগারে কয়েক ধরনের পোকা আক্রমণ করে ফলে বেশিদিন শুঁটকি সংরক্ষণ করা যায় না।

উৎপাদিত শুঁটকি যাতে পোকার এইসব আক্রমণ থেকে রক্ষা পায় এবং বেশিদিন সংরক্ষণ করা যায় সে লক্ষ্যে ড. এ টি এম ফয়েজুল ইসলামের নেতৃত্বে বিজ্ঞানীরা কাজ করছেন। তাছাড়া কীভাবে প্রোটিন সমৃদ্ধ এই মাছির লার্ভা ও পিউপা বিষাক্ত ট্যানারি বর্জ্য মিশ্রিত মাছ ও পোল্ট্রির কৃত্রিম খাবারের পরিবর্তে হাঁস, মাছ ও পোল্ট্রির খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা যায় তা নিয়ে তারা কাজ করছেন।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, কৃষিশিক্ষা, শহীদ জিয়া মহিলা কলেজ, ভূঞাপুর, টাঙ্গাইল ও বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পদকপ্রাপ্ত।

এমএমএফ/জিকেএস