তথ্যপ্রযুক্তি

রোবট বানিয়ে সফল সানি জুবায়ের

রোবটিক্সের প্রতি ভালোবাসা ছিল ছোটবেলা থেকেই। হাতেখড়ি হয়েছে নিজে নিজেই, ছোটবেলা থেকেই যন্ত্রের ভেতরের ভাষাকে খুঁজতাম। এর ভেতরে লুকিয়ে থাকা রেজিস্টার, ট্রানজিস্টর আর সার্কিট বোর্ড প্রতিনিয়িতই আমাকে কৌতূহলী করতো। এভাবেই একসময় ভালোলাগা থেকে রোবট তৈরি পরিণত হয় স্বপ্ন ও লক্ষ্যে। এভাবেই জাগো নিউজকে নিজের রোবট তৈরির পেছনের গল্প জানান সানি জুবায়ের।

Advertisement

ছোট থেকেই তার প্রতিদিনের কাজের অংশ হয়ে যায় এটি। নতুনভাবে কোনো কিছু করার চিন্তা থেকে টুকিটাকি ছোট ছোট জিনিস বানাতে থাকেন, অংশগ্রহণ করতেন বিভিন্ন আন্তঃস্কুল কলেজ এবং জাতীয় বিজ্ঞান মেলায়।

সানি বলেন, মহান সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছায় প্রায় অধিকাংশ সময়ই নিজের কৃতিত্বের সাক্ষর রাখতে পেরেছেন সব প্রতিযোগিতায়। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশকে সম্মানজনক স্থানেও নিয়ে এসেছেন। সম্প্রতি ‘ফায়ার ফাইটিং রোবট’ বানিয়ে ডিজিটাল বাংলাদেশ পুরস্কার ২০২১ পেয়েছেন সানি।

১২ ডিসেম্বর ডিজিটাল বাংলাদেশ দিবস ২০২১ উপলক্ষে জেলা পর্যায়ে কারিগরি ব্যক্তিগত (বেসরকারি) বিভাগে এই পুরস্কার পান তরুণ বিজ্ঞানী সানি জুবায়ের, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক পুরস্কারটি তুলে দেন, ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত হয়ে পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান উপভোগ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

Advertisement

এই তরুণ বিজ্ঞানী বলেন, দেশে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা প্রায়ই ঘটে চলছে। অগ্নিকাণ্ডের এলাকায় আগুন নিয়ন্ত্রণ, আগুনের উৎস স্থান খুঁজে নিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণ, আটকে পড়া মানুষদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া, তাদের সঙ্গে প্রয়োাজনীয় যোগাযোগ করা, ক্ষতিকারক ধোঁয়া ভ্যাকিউম করাসহ সকল তথ্য সংগ্রহ করে অগ্নিনির্বাপক দল এর কাছে পৌঁছে দেওয়ার মতো সকল কাজে সক্ষম তার ডিফেন্ডার নামের অগ্নিনির্বাপক রোবটটি।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও আর.সি. নিয়ন্ত্রণ এই দুই পদ্ধতিতেই রোবট নিয়ন্ত্রিত হবে। মানুষের যাওয়া যেখানে প্রায় অসম্ভব সেখানে রোবট অনায়াসে পৌঁছে কাজ করতে পারবে। জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘর কর্তৃক আয়োজিত রোবট প্রতিযোগিতায় জাতীয় পর্যায়ে প্রথম হয় এই রোবট। এবার পেল ডিজিটাল বাংলাদেশ পুরস্কার ২০২১।

সানি জুবায়ের ব্যবহারিক পদার্থবিজ্ঞান এবং রোবটিক্স নিয়ে সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পে এবং ব্যক্তিগত প্রকল্পে কাজ করছেন। এ ছাড়াও বর্তমানে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান ও রোবটিক্স প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের হয়ে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছিলেন।

আন্তর্জাতিক রোবট অলিম্পিয়াডে বাংলাদেশের হয়ে সিনিয়র গ্রুপে সর্বপ্রথম ব্রোঞ্জ ও টেকনিক্যাল পদক অর্জন করেন। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশকে সম্মানজনক স্থানে নিয়ে আসতে অনেকটাই সক্ষম হয়েছেন বলেও জানান তিনি।

Advertisement

সানি জুবায়েরের স্কুল জীবন কাটে মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজে। এইচ.এস.সি শেষ করেছেন ঢাকা কলেজ থেকে। এখন ব্র্যাক ইউনির্ভাসিটিতে কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে পড়াশোনা করছেন।

সানি বলেন, ছোটবেলার রোবট নিয়ে কাজের প্রতি ভালোলাগা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। নতুন কিছু জ্ঞান আহরণের মাধ্যমে বানাতে শুরু করেন অত্যাধুনিক কিছু রোবট। এরই ধারাবাহিকতায় বেশ কয়েকটি অটোনোমাস রোবট এবং মার্স রোভার বানাতে সক্ষম হন তিনি।

বর্তমানে কাজ করছেন অগ্নি নির্বাপনের জন্য সিগমা-২১ নামক রোবট নিয়ে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে সিগমা-২১ এবং সামনেও বেশ কয়েকটি প্রকল্প রয়েছে তারমধ্যে কয়েকটি হল-আগুন দিয়ে তৈরিকৃত বিদ্যুৎ কোষ, স্বল্প দামে দেশিয় পদ্ধতিতে বানানো করোনা রোগীর জন্য ভেন্টিলেটর এবং সোয়াচ অফ নো গ্রাউন্ডের রহস্য বের করার জন্য রোবোটিক সাবমেরিন।

ছোটবেলায় সেই ভালো লাগার কাজটিকে নিয়ে সামনে অনেক স্বপ্ন দেখি। প্রতিনিয়ত লেখাপড়ার পাশাপাশি একটি বড় অংশ আমি আমার কাজের পেছনে দিয়ে থাকি। আশা করি খুব শিগগিরই দেশকে নতুন কিছু দিতে সক্ষম হবো।

তরুণ বিজ্ঞানী সানি জুবায়ের রয়েছে দেশে বিদেশে অর্ধশত অর্জন। ১৬টি জাতীয় বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি প্রতিযোগিতায় পদক অর্জন, যা মধ্যে ছিল জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সপ্তাহ, ডিজিটাল উদ্ভাবনী মেলা, জাতীয় রোবটিক চ্যালেঞ্জ, জাতীয় রোবট অলিম্পিয়াডসহ আরো কয়েকটি প্রতিযোগিতা, আন্তঃ স্কুল এবং কলেজ প্রতিযোগিতায় সর্বমোট ৫৬টি পুরস্কার পান তিনি।

বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত বিজ্ঞান প্রতিযোগিতায় ১৫টি পদক অর্জন করেন, এর মধ্যে ছিল-ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ইত্যাদি।

তার বানানো রোবট সমূহ: এফআর -২১ (ফাইটার রোবট) সামরিক কাজে ব্যবহার উপযোগী একটি রোবট, ব্রেইন বট সম্পূর্ণ অটোনোমাস ভিত্তিক দৈনিক কাজে সাহায্যকারী একটি রোবট, অ্যাটলাস নামের রোবট কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন একটি মঙ্গল রোভার, ফারমোভার একটি কৃষি রোবট, ফ্যালকন এক্স, এক্স আই.ভি একটি রেসিং রোবট , গমা-২১ একটি অগ্নিনির্বাপক রোবট, এটলাস এওভি- একটি অটোনমাস পরীক্ষামূলক সাবমেরিন, টলাস এভিভি-সাগরের পানি পরিষ্কারকারক একটি রোবট। অক্সিবক্স অল্প দামের ভেন্টিলেটর-স্বল্প খরচে করোনায় আক্রান্তদের জন্য ভেন্টিলেটর প্রকল্প।

তরুণ বিজ্ঞানী সানি জুবায়ের বলেন, আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় তিনি এবং তার দল বাংলাদেশকে সম্মানের সঙ্গে উপস্থাপন করি এর মধ্যে সিঙ্গাপুরে আয়োজিত এস.এ.ইউ.ভি. সি প্রতিযোগিতা, ভারতে আয়োজিত ওয়ার্ল্ড রোবটিক্স চ্যাম্পিয়নশিপসহ আরও বেশ কয়েকটি প্রতিযোগিতা। সানির টিম অ্যাটলাস নামের একটি রোভার দল আছে। বর্তমানে যার সদস্য সংখ্যা ১৮জন, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক এবং জাতীয় প্রতিযোগিতায় তিনি এবং তার দল অংশগ্রহণ করি।

আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতাগুলোতে আমি এবং আমার দল সর্বোচ্চ দিয়ে দেশকে উপস্থাপনের জন্য কাজ করি। আমাদের দলটির মূল উদ্দেশ্য হলো বিজ্ঞান প্রযুক্তিতে বাংলাদেশের কৃতিত্বকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে গৌরবের সঙ্গে উপস্থাপন করা এবং দেশের গুরুতর কিছু সমস্যাকে প্রযুক্তির মাধ্যমে সমাধান করা।

সানি বলেন, এই লক্ষ্য নিয়ে আমি এবং আমার দল সর্বোচ্চ দিয়ে কাজ করে যাচ্ছি। বাংলাদেশে রোবটিক্সকে অনেক দূর এগিয়ে নিতে চাই এটা আমার স্বপ্ন, সঙ্গে সঙ্গে দেশের জন্য প্রয়োজনীয় সকল কাজে নিজের সবটুকু দিয়ে প্রযুক্তি ভিত্তিক সমাধান দিতে চাই। যারা নতুনভাবে রোবটিক্স নিয়ে কাজ করতে চায় তাদের আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।

সৃষ্টিশীলতার অনেক বিষয় লুকিয়ে আছে রোবটিক্স এর ভেতরে। এর জন্যই তার প্রাথমিক ধারণাগুলো নিতে হবে সবার প্রথমে এবং সঙ্গে প্রোগ্রামিং করাটাও আয়ত্তে আনতে হবে। দিনে কিছু সময় এর পিছনে মনোযোগ দিতে হবে। অন্যকে অনুকরণ না করে নিজের সৃষ্টিশীলতা দিয়ে অবশ্যই কাজ করতে হবে। এভাবেই খুব দ্রুত চর্চার মাধ্যমে রোবটিক্স-এ দক্ষ্য হয়ে ওঠা যাবে। অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে রোবটিক্স অন্যতম প্রধান হাতিয়ার।

কেএসকে/এএসএম