ফিচার

ভালো নেই দোলনার কারিগররা

ষাটোর্ধ্ব স্বপ্না বেগম, কিশোরী বয়সেই স্বামীর সংসার শুরু করেন। ৫ মেয়ে ৩ ছেলে নিয়ে স্বপ্না এখন স্বামীহারা। সংসারের হাল ও সন্তানদের মুখে খাবার তুলে দিতে নিজে শুরু করেন সুতা, রং ও বাঁশ দিয়ে দোলনা, ছিকাসহ গৃহস্থfলী নানা পণ্য তৈরির কাজ। আর এই দোলনাইতে স্বপ্ন বোনেন স্বপ্না।

Advertisement

শুধু স্বপ্না নয় তার মতো, এই দোলনাকে ঘিরে হাজারো স্বপ্ন দেখেন একই ইউনিয়নের ধনুন গ্রামের রেনু বেগম (৭৫), ফজিলা বেগম (৫০), বাগদী গ্রামের উর্মি বেগম (৩৫), লতিফা বেগম (৪০), গাড়ারিয়া গ্রামের শাহনাজ বেগম (৪৫) ও বিন্দান গ্রামের শাহানা আক্তার (৫৫)।

দোলনাকে ঘিরে তাদের এতশত স্বপ্ন থাকলেও বর্তমানে তারা এবং তাদের দোলনার গ্রামগুলো খুব বেশি ভালো নেই। সুতা, রং, বাঁশ ও এই শিল্প সংশ্লিষ্ট জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় এবং করোনার কারণে দোলনা তৈরিতে আগের মতো লাভবান নন তারা।

গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলার নাগরী ইউনিয়নের নিভৃত গ্রাম বির্তুলের নিত্যদিনের চিত্র এটি। এই উপজেলার নাগরী ইউনিয়নটি নানা কারণেই ঐতিহাসিক এবং গুরুত্বপূর্ণ। সেই সঙ্গে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এলাকাটিকে আলাদা বৈশিষ্ট্য দিয়েছে। তবে নাগরীর বির্তুল, ধনুন, বাগদী, গাড়ারিয়া ও বিন্দান গ্রাম এখন পরিচিত দোলনার গ্রাম নামেই।

Advertisement

নারীদের তৈরি দোলনাই এ গ্রামগুলোকে পরিচিতি দিয়েছে আলাদা এক নামে। এখানে প্রায় ৩ শতাধিক নারী-পুরুষ দোলনা তৈরির সঙ্গে জড়িত। পুরুষদের সহযোগিতায় দোলনা তৈরির কাজগুলো মূলত নারীরাই করে থাকেন।

এই গ্রামগুলোর তৈরি দোলনা দেশের অভিজাত শ্রেণির ঘরে আদরণীয় সামগ্রী হিসেবে গণ্য হচ্ছে। নামিদামি মার্কেটগুলোতেও শোভা পাচ্ছে এখানকার দোলনা। অপরূপ বুনন কৌশল আর বাহারি কারুকাজের কারণে কোনো কোনো উদ্যোক্তা বিদেশেও পাঠাচ্ছেন এই দোলনা। এসব কারণে ব্যাপক চাহিদা ও সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে এই দোলনাকে ঘিরে।

বাগদী উত্তরপাড়া গ্রামের দোলনার নারী কারিগর পারভীন আক্তার (৪৫) জানান, করোনার কারণে তারা একবারে পথে বসে গেছেন। আগে সুতা, রং ও বাঁশের দাম ছিল কম, এখন এ শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব জিনিসের দামই বেশি।

তাদের যে মূলধন তা দিয়ে তারা ঐতিহ্যের এই পেশাকে চালিয়ে নিতে হিমসিম খাচ্ছেন। এই শিল্পের জন্য সরকার যদি কোনো প্রণোদনা বা সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করেন তাহলে পূর্ব পুরুষের রেখে যাওয়া পেশাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবেন বলে জানান তিনি।

Advertisement

একই গ্রামের দোলনার কারিগর শাহিনুর বেগম (৩৫) জানান, দুই ছেলে দুই মেয়ে নিয়ে খুবই দুর্বিসহ জীবন-যাপন করছেন তিনি। করোনার আগে নিজ উদ্যোগে দোলনা তৈরির ব্যবসা করতেন। তবে করোনাকালীন সময় দেশের পরিস্থিতির কারণে তার এই ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়। তিনি আর্থিকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হন। তাই সরকারি সহযোগিতায় তিনি তার পূর্ব পুরুষের রেখে যাওয়া পেশাটি পূনরায় শুরু করতে পারবেন বলে জানান।

দোলনা ব্যবসায়ি আইয়ূবুর রহমান (৪২) জানান, আগে এই দোলনার ব্যবসা করে কারিগরদের নিয়মিত মজুরি দিতে পারতেন। কিন্তু ২/৩ মাস গত হলেও এখন আর পারেন না। পাইকারি দোকানগুলো থেকে টাকা উঠাতে গেলে তারা তাদের ব্যবসা মন্দার কথা বলে টাকা নিয়ে ঘুরাতে থাকে।

আর এই জন্য কারিগরদের মজুরি দিতে না পারায় মাঝে মাঝেই দোলনা ব্যবসায়ী ও কারিগরদের মধ্যে অপ্রিতীকর ঘটনা ঘটে। তবে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা চান এই দোলনার ব্যবসায়ী।

আরেক দোলনা ব্যবসায়ী আলাউদ্দিন মির্জা (৫০) জানান, তাদের তৈরি দোলনা স্থানীয় চাহিদা পূরণ করে রাজধানী ঢাকাসহ বগুড়া, নওগাঁ, টাঙ্গাইলসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় পাইকারি দোকানগুলোতে নিয়মিত সরবরাহ করা হয়।

পাইকারির চেয়ে খুচরা মূল্যে বিক্রি করলে তাদের বেশি মুনাফা হয় বলে জানান তিনি। তবে স্থানীয়ভাবে হাতে তৈরি এই দোলনার একটি বাজার সৃষ্টির জন্য সরকারের প্রতি অনুরোধ করেন তিনি।

দোলনা ব্যবসায়ী নাজিম উদ্দিন জানান, এক সময় দাপটের সঙ্গে চলত এই ব্যবসা। কিন্তু এখন সংশ্লিষ্ট জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় বর্তমানে ভালো নেই দোলনার কারিগররা। করোনা তাদের একেবারে পথে বসিয়ে দিয়েছে।

তবে সম্ভাবনাময় শিল্প টিকিয়ে রাখতে তিনি সরকারি-বেসরকারি নানা উদ্যোগ জরুরি বলে মনে করছেন তিনি। একই কথা বলেন দোলনার পুরুষ কারিগর আলমগীর হোসেন (৪৮)।

বাগদী গ্রামে খুচরা মূল্যে দোলনা কিনতে আসেন আবুল হাসনাত (৩৫) নামের এক ক্রেতা। কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি জানান, সরাসরি দোলনার গ্রাম থেকে দোলনা কিনলে বাজারের তুলানায় একটু কম দামে কেনা যায়।

তাছাড়া অনেকগুলো দোলনা থেকে ভালো দোলনা বেছে নেওয়া যায় বলেও তিনি জানান। তবে আগের মতো দোলনার ওই গ্রামেগুলোতে জৌলুস নেই বলেও জানান তিনি।

কালীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. শিবলী সাদিক জানান, নাগরী কৃষিপ্রধান এলাকা হলেও দোলনার সাফল্য ও সম্ভাবনার কারণে অনেকেই এই শিল্পের দিকে ঝুঁকছে। তবে করোনাকালীন সময়ে তারা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে বলে বিষয়টি তাদের নজরে এসেছে।

ক্ষতি পুশিয়ে তারা যেন তাদের পূর্ব পুরুষের পেশা ঠিক রেখে জীবিকা নির্বাহ করতে পারে সেজন্য স্থানীয়ভাবে সমিতি গঠন, ক্ষুদ্র ঋণ এবং বাজার সৃষ্টির আশ্বাস দিলেন উপজেলার এই নির্বাহী কর্মকর্তা।

আব্দুর রহমান আরমান/কেএসকে/জেআইএম