মাত্র ১৭ বছর বয়সেই একটি অ্যাপের মাধ্যমে দেশে ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল নড়াইলের কিশোর সাদাত রহমান। এবার সেই কিশোর আন্তর্জাতিক শিশু শান্তি পুরস্কার অর্জন করে বিশ্বমঞ্চে জায়গা করে নিয়েছেন। সম্প্রতি সাদাত রহমান মুঠোফোনে আলাপচারিতায় জাগো নিউজের একান্ত সাক্ষাৎকারে বলেছেন তার সাফল্যের গল্প। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জুনায়েদ হাবীব
Advertisement
জাগো নিউজ: সাইবার বুলিং নিয়ে কাজ করে খ্যাতি অর্জন করেছেন অনেক আগেই। এর শুরুটা কীভাবে হয়েছিল?
সাদাত রহমান: একটা প্রবাদ আছে, প্রয়োজনের তাগিদে মানুষ উদ্ভাবন করে। সাইবার বুলিং ঠেকানোর শুরুটা হয়েছিল একটা রোমহর্ষক ঘটনা দিয়ে। পিরোজপুরে একটি মেয়ে সুইসাইড করলেন সাইবার বুলিংয়ের কারণে। সে কাউকে বলতে পারলো না তার সাথে ঘটে যাওয়া সেই ঘটনার কথা। তার আত্মহত্যার ব্যাপারটি জানার পর আমার মনে নাড়া দিয়েছিল।
সেই থেকে যাত্রা শুরু। মনে করলাম যে আমার জেলায় এ রকম বিপদে পড়ে অনেক কিশোর-কিশোরী এমন কিছু ফেস করছে সাইবার অপরাধ জগতে। আমার বন্ধু কয়েকজনকে নিয়ে ‘সাইবার টিনস’ নামের একটি অ্যাপ প্লে স্টোরে রিলিজ করলাম। এর পেছনে আমার, আমাদের অনেক ত্যাগ, সাধনা দীর্ঘ পরিশ্রম ছিল।
Advertisement
‘সাইবার টিনস’র কার্যক্রম শুধু অ্যাপসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, এখানে ওয়েবসাইট ও ফেসবুক পেজ আছে। আমি আসলে মোটেই প্রফেশনাল নই। তবুও নিজে যতটুকু পেরেছি, সমস্যা সমাধান করার চেষ্টা করেছি। আলহামদুলিল্লাহ খুব অল্প সময়েই হাজার হাজার কিশোর-কিশোরী এ অ্যাপের সুফল পাওয়া শুরু করলো।
জাগো নিউজ: সাইবার টিনসের কার্যকারিতা কেমন?
সাদাত রহমান: সাইবার টিনস মূলত একটি প্লাটফর্ম। এর একটি অ্যাপ ও সাইট আছে। সাথে ফ্যান পেজও রেখেছি। যেখানে ১৩-১৯ বছরের কিশোর-কিশোরী, যারা নড়াইলে থাকেন; তারা যদি অনলাইনে সাইবার বুলিংয়ের শিকার হন, সেটা বেসিক পর্যায়ে হতে পারে বা ক্রাইম পর্যায়ে হতে পারে। যেমন বেসিক পর্যায়ে যদি আইসিটি ইস্যু হয়- ভুক্তভোগীর নামে ফেইক আইডি খোলা, আইডি হ্যাক হয়ে যাওয়া বা আইডিতে কোনো প্রবলেম হয়।
সেগুলো আমাদের জানালে আমরা সাইবার এক্সপার্টের মাধ্যমে সমাধান করি। আর যদি দেখি যে এখন সিকিউরিটি রিলেটেড কোনো ইস্যু নেই। আছে ক্রাইম রিলেটেড ইস্যু, তাও মারাত্মকভাবে। তখন আমরা সেটির জন্য সরাসরি পুলিশের হস্তক্ষেপ কামনা করি। তাহলে কিশোর-কিশোরীরা অনেকে প্রত্যন্ত অঞ্চলে থাকে, সেখান থেকে সরাসরি পুলিশি সাপোর্ট পেয়ে গেল।
Advertisement
জাগো নিউজ: বাংলাদেশে সাইবার অপরাধ দমনে যে পথ বেছে নিয়েছিলেন তা নিশ্চয়ই অনেক কঠিন ছিল?সাদাত রহমান: বাংলাদেশে সাইবার অপরাধ দমনে যে পথ, এটা আসলেই কঠিন। কারণ নিজের নিরাপত্তা নেই। সাইবার টিনসের মাধ্যমে অপরাধী গ্রেফতার থেকে শুরু করে সন্দেহভাজনদের পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদে আসছে প্রতিনিয়ত, তা কিন্তু একান্তই আমার কারণেই। তারা সবাই জানে সাইবার টিনসটা কার নিয়ন্ত্রণে। কোন ছেলেরা এগুলো করছে বা কোন মেয়েরা এগুলো করছে। এটা আসলে একটা চ্যালেঞ্জ ছিল। কারণ সিকিউরিটির ব্যাপারে আমার জীবন ঝুঁকিতে থাকতো। তারপরও আল্লাহর রহমতে আমার কোনো সমস্যা হয়নি।
কিছুটা বিড়ম্বনায় পড়তে হতো, দেখা যেত লোকাল পর্যায়ে যে সাইবার বুলিং বা ইন্টারন্যাশনাল বিষয়ে লোকাল পুলিশ প্রশাসন তারা অনেক কম জানে। ফলে আসলে কাজ করাটা ডিফিকাল্ট। আবার দেখা যাচ্ছে আইসিটির কোনো মামলা হয় এটা নিয়ে একটা সমস্যা, যে মামলা আইসিটি অ্যাক্টে করা ঝামেলা। কারণ চেষ্টা করেছি সচেতন করতে। তবে টেকনিক্যালি কোনো সমস্যা আসে পুলিশের কাছে, যখন দেখি যে আর কোনো উপায় নেই তখন আমরা যাই।
কারণ একটা টিনএজারকে হঠাৎ করে পুলিশের কাছে দিয়ে দিলাম। পুলিশের যে একটা প্রসেস হয়তো বা আমাদের কাজ থেকে এখন জিডি নিচ্ছে না। কিন্তু আলটিমেটলি গ্রেফতারের পর জিডি বা আইনি প্রক্রিয়াগুলো করতে হচ্ছে তো টিনএজারের জন্য এগুলো একটু ঝামেলা হয়ে যায়। সেজন্য আমরা সব সময়ই চেষ্টা করি কীভাবে টেকনিক্যালি এটা সমাধানের উপায় বের করা যায়।
জাগো নিউজ: দেশে প্রথমবারের মতো শিশু শান্তি পুরস্কার এবং এমন স্বীকৃতি অর্জনে আপনার অনুভূতি কেমন ছিল? এর গল্পটা শুনতে চাই।সাদাত রহমান: দেশে প্রথমবারের মতো শিশু শান্তি পুরস্কার অর্জনের যে অনুভূতি এটি ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। সবচেয়ে বড় কথা হলো, এখন দায়িত্বটা আরো বেড়ে গেল। যেহেতু আন্তর্জাতিকভাবে একটি স্বীকৃতি পেলাম সেক্ষেত্রে শুধু দেশেরই নয় বরং সারা বিশ্বের সাইবার বুলিং প্রতিরোধের দায়িত্ব চলে এ লো আমার ওপর।
এ দায়িত্ব পরিপূর্ণভাবে পালন করতে পারলেই স্বার্থক মনে করবো। আসলে আমার কাছে সবকিছু ছিল এক কথায় স্বপ্নের মতো।
জাগো নিউজ: শিশু শান্তি পুরস্কার অর্জনের প্রক্রিয়া কীভাবে সম্পন্ন করতে হয়েছিল?সাদাত রহমান: আমি কখনো সে রকমভাবে শিশু শান্তি পুরস্কারের মনোয়নে অংশগ্রহণের ব্যাপারে ভাবিনি। কারণ আমি মনে করতাম এখনো তেমন কোনো কাজ করেতে পারিনি। আমার এক পরিচিত ভাই হঠাৎ আমাকে বললেন আবেদন করে দেখতে।
পরে আবেদন করতে গিয়ে দেখলাম নিজে নিজেকে মনোনীত করা যায় না, অন্য একজনের রেফারেন্সের প্রয়োজন হয়। তখন আমি আমার জেলার ডিসি স্যারের রেফারেন্সে আবেদনটি করেছিলাম।
জাগো নিউজ: দীর্ঘপথ হেঁটে বিশ্বমঞ্চে নিজেকে নিয়ে গেছেন। এবার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা জানতে চাই।সাদাত রহমান: ভবিষ্যতে সাইবার বুলিং ঠেকাতে আমাদের বিশেষ কিছু পরিকল্পনা রয়েছে। যেমন- বাংলাদেশের ৬৪টি জেলায় এ পরিকল্পনাটি বাস্তবায়ন করা, চাইল্ড ফ্রেন্ডলি একটি প্ল্যাটফর্মে নিয়ে যাওয়া। এছাড়া নিজেরা যতটুকু জানতাম তা নিয়ে আমরা কাজ শুরু করে ছিলাম।
ভবিষ্যতে বিশেষজ্ঞ ও পেশাদারদের সাথে গবেষণা আলোচনার মাধ্যমে কীভাবে আরো ভালো করা যায় সেদিকে এগিয়ে যেতে চাই এবং একটি পেশাদারি অবস্থানে নিয়ে যেতে চাই। সাইবার বুলিং ঠেকাতে আমাদের Awareness, Empathy, Counciling & Action এ চারটি ক্ষেত্র ডেভেলপ করতে হবে, এদের মধ্যে মূলত সচেতনতাই প্রধান। আমরা ইতিমধ্যে ওয়েবসিরিজ করার পরিকল্পনা করছি, প্রতিটি স্কুল-কলেজে সাইবার বুলিং সচেতনতা নিশ্চিত করা, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তরুণ-তরুণীদের বিভিন্ন সাইবার বুলিং সচেতনতা সংক্রান্ত প্রতিযোগিতার আয়োজন করা।
আমরা মূলত তরুণ প্রজন্ম নিয়েই কাজ করার পরিকল্পনা করছি। আমি সেদিনই সফল হবো যেদিন আর কেউ অ্যাপটি ইন্সটল করবে না এবং কারো সাইবার বুলিং নিয়ে অভিযোগ থাকবে না।
জাগো নিউজ: আমাদের সময় দেয়ার জন্য ধন্যবাদ।সাদাত রহমান: আপনাকেও ধন্যবাদ।
অনুলিখন: রিতা
এমএমএফ/এমকেএইচ