ভ্রমণ

সাগরকন্যা কুয়াকাটার মধুর স্মৃতি

সময়টা যে ২০২০ সাল। শুরু থেকেই বিভিন্ন সংকটে আমরা বিপন্ন। তার মধ্যে মহামারি ও দীর্ঘদিন ঘরবন্দি। তাই তো ছাড়া পেয়েই মন উতলা হয়ে উঠলো, ভ্রমণের জন্য কোথায় যাই? আর তখনই মনে পড়লো রবীন্দ্রনাথের সেই কথা, ‘দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া/ ঘর হতে দুই পা ফেলিয়া’। কাজের একঘেয়েমি আর ব্যস্ততা থেকে নিলাম কয়েকটা দিনের বিরতি। এরপরই ২৫ অক্টোবর পাড়ি দিলাম সাগরকন্যা কুয়াকাটায়।

Advertisement

সকালে পরিবারসহ তল্পিতল্পা গুছিয়ে রওনা দিলাম গন্তব্যের উদ্দেশে। আমাদের সাথে ছিল একটি পোষা বিড়াল; যার নাম মিনি। সকাল ৮টায় নদীপথে ঢাকা ত্যাগ করি। উত্তাল নদীর বুক চিরে দ্রুতগতিতে আমাদের গন্তব্যের দিকে নিয়ে ছুটছিল গ্রিনলাইন ওয়াটার বাস। দীর্ঘ যাত্রায় মাঝপথে কিছুটা ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা হলেও নদীর সৌন্দর্য অবলোকন করতে করতে অবশেষে নিরাপদেই গন্তব্যে পৌঁছাই।

এরপর আমাদের সাথে যুক্ত হলো দুই বোন ও দুই ভাগ্নে, যারা আনন্দের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিলো। দীর্ঘ যাত্রাপথ পেরিয়ে ক্লান্তির সাথে সংগ্রাম করে অবশেষে পৌঁছে যাই গন্তব্য সাগরকন্যা কুয়াকাটায়।

প্রথমেই কিছুটা বিশ্রামের জন্য উঠলাম রেস্ট হাউসে। সেখানে বসে যখন আমরা কৃত্রিম বাতাসে ক্লান্তি দূর করছি; তখন হয়তো সমুদ্রে মৃদু ঠান্ডা প্রাকৃতিক বাতাস বইছে আর জানান দিচ্ছে আমাদের আগমনী বার্তা। ওদিকে পেটের মধ্যে যে লেগে গেছে যুদ্ধ, সে খেয়াল নেই। তাই সমুদ্রস্নানের আগে সে যুদ্ধ থামিয়ে দিলাম খানিকটা ভূরিভোজ করে। কুয়াকাটায় খাবো আর শুঁটকি থাকবে না, তা কি হয়?

Advertisement

এরপর সমুদ্রের দিকে রওনা দিলাম। কিছুক্ষণ হাঁটার পর সমুদ্রের দর্শন পেতেই যেন নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল সমুদ্রের বিশালতার সামনে। ঢেউয়ের মাথায় সাদা ফেনা আর ঘোলাটে পানি যেন দুহাত তুলে ডাকছিল আমাদের। ছুটে যেতে ইচ্ছা করছিল সেই প্রান্তে, যেখানে নীল আকাশ আর সমুদ্র এক হয়ে গেছে। কিন্তু যাওয়ার তো সুযোগ নেই। তাই কিনারে থেকেই অবগাহন করলাম সমুদ্রের গভীরে।

দীর্ঘক্ষণ কাটানোর পর আমি উঠতে চাইলেও সমুদ্র যেন আমাকে উঠতে দিচ্ছে না। তারপরও ছিড়তে হবে এ বাঁধন, উঠতে তো হবেই না চাইলেও এ মন। সমুদ্রস্নানের ইতি টেনে মধ্যাহ্নভোজ সেরে বেরিয়ে পড়লাম সৌন্দর্যের লীলাভূমির সৌন্দর্য দেখতে।

একে একে বৌদ্ধ মন্দির, রাখাইনপল্লী, মিশ্রিপাড়া, হাজার বছরের পুরোনো নৌকা, লেবুরচর, শুঁটকিপল্লী (শুঁটকির কড়া গন্ধ কারো কাছে খুব বিরক্তিকর হলেও আমরা বেশ উপভোগ করেছি), বিখ্যাত কুয়া, যার নামানুসারে আজকের কুয়াকাটা। সন্ধ্যায় যখন সূর্য অস্ত যাচ্ছিল; তখন যেন চোখ ফেরাতে পারছিলাম না। এতটা অদ্ভুত সুন্দর প্রকৃতি কী করে হয়!

রাতে যখন সমুদ্রের পাড়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম; তখন অদূরের বিভিন্ন মাছ এবং কাঁকড়া দ্বারা তৈরি মসলাযুক্ত খাবারের ঘ্রাণ নাকে এসে তীব্রভাবে লাগছিল। এছাড়া বালুরাশির উপরে ছড়িয়ে থাকা পরিত্যক্ত সাদা ঝিনুকের ওপর জোৎস্নার আলোতে পা ফেলা এক অন্যরকম অনুভূতি, যা পিচঢালা রাস্তায় নিয়ন আলোতে কখনো পাওয়া যাবে না।

Advertisement

রাত্রীকালীন সমুদ্রের গর্জন ভীষণ ভয়ঙ্কর, মনে হয় কেউ যেন তেড়ে আসছে। যদিও এটা আসলে প্রকৃতির সৌন্দর্য। খুব ভোরে ছুটে গেলাম অসংখ্য ঝাউ গাছের সারিতে মোড়ানো ঝাউবনে সূর্যাস্তের পানে। সূর্যটা যখন উঠবে উঠবে করে উঁকি দিচ্ছিল; তখন মনে হচ্ছিল এ যেন আগুনে ঝলসে যাওয়া ফুলন্ত বেলুন বা জ্বলন্ত ফানুস।

এ দিনে সেই পরিচিত সূর্যকে যেন পুনরায় নতুন রূপে আবিষ্কার করলাম। এ দিনটি এবারের মতো কুয়াকাটায় শেষদিন আমাদের। মধ্যাহ্নভোজ সেরে পুনরায় নিজের ঠিকানায় যাওয়ার জন্য তল্পিতল্পা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। সাথে নিলাম একগাদা কুয়াকাটার বিখ্যাত সব বাহারি আচার আর মস্তিষ্কের মেমোরি ভর্তি একগাদা স্মৃতি।

বিদায়বেলা যেন শুনছি সমুদ্র আমাদের ডাকছে আর বলছে, হে প্রিয় অতিথি ‘যেতে নাহি দিতে চাই, তবু যেতে দিতে হয়’। আমাদের যে তখন যেতে ইচ্ছে করছিল না, তবু কী করার? বাস্তবতার কাঠিন্য যে আমাদের মেনে নিতেই হবে। এ সৌন্দর্যের মায়া যে ত্যাগ করতেই হবে। আমিও তাই সমুদ্রকে প্রতি উত্তরে বলি-‘হে সমুদ্র, আমরা যে তোমার অতিথি, আবার আসিবো ফিরে তোমারই তীরে,আবার যাবো হারিয়ে তোমারই মায়াতে,হে সৌন্দর্যের লীলা,হে প্রিয় সাগরকন্যা।’

এসইউ/এমকেএইচ