ভ্রমণ

যেখানে পানির নিচে সবুজের স্বর্গরাজ্য

মো. শিব্বির আহমেদ তাশফিক

Advertisement

টাঙ্গুয়ার হাওর। বিশাল এ জলাভূমিতে প্রকৃতি বেড়ে উঠেছে আপন খেয়ালে। তার সৌন্দর্য চোখে না দেখলে ঠিক বোঝা যাবে না। বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব প্রান্তে, সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর ও ধর্মপাশা উপজেলার ১৮ মৌজায়, ৫১টি জলমহালের সমন্বয়ে ৯ হাজার ৭২৭ হেক্টর অঞ্চল নিয়ে টাঙ্গুয়ার হাওর গড়ে উঠেছে। এটি বাংলাদেশের অন্যতম বড় জলাভূমি। বর্ষাকালে হাওরটির আয়তন দাঁড়ায় প্রায় ২০ হাজার একর। টাঙ্গুয়ার হাওরের কারণে সুনামগঞ্জকে বলা হয় ‘হাওরকন্যা’।

ভারতের মেঘালয়ের পাদদেশে অবস্থিত টাঙ্গুয়ার হাওর। মেঘালয় পর্বত থেকে প্রায় ৩০টি ঝরনা এসে সরাসরি মিশেছে হাওরের পানিতে। সারি সারি হিজল-করচ শোভিত, পাখিদের কলকাকলি মুখরিত টাঙ্গুয়ার হাওর। মাছ, পাখি এবং অন্য জলজ প্রাণির বিশাল অভয়াশ্রম। জীববৈচিত্র্য ও সৌন্দর্যের কারণে টাঙ্গুয়ার হাওরের সুনাম বাংলাদেশে নয়, দেশের বাইরেও স্বীকৃত। মিঠাপানির এ হাওরকে বলা হয় বাংলাদেশের দ্বিতীয় রামসার অঞ্চল। সুন্দরবনকে ধরা হয় প্রথম।

গত ১৮ সেপ্টেম্বর সকাল ৮টায় আমাদের যাত্রা শুরু হয় সিলেটের কুমারগাঁও বাসস্ট্যান্ড থেকে। ৯ জন সদস্য নিয়ে এ ভ্রমণ শুরু হয়। সিলেট থেকে ২ জন, চট্টগ্রাম থেকে ৫ জন এবং ঢাকা থেকে ২ জন সদস্য যোগ দেয় ভ্রমণে। প্রায় সবাই এরআগে খুব বেশি ভ্রমণে যাননি বলে এ ভ্রমণ নিয়ে তাদের উত্তেজনা ছিল খুব বেশি। সকাল ১১টার দিকে আমরা সুনামগঞ্জ পৌঁছাই। সেখান থেকে সিএনজিযোগে তাহিরপুর উপজেলায় যাই। টাঙ্গুয়ার হাওরের প্রবেশমুখেই দেখা যায় সারি সারি হিজলগাছ। দেখে মনে হবে, গাছগুলো হাওরে আগতদের অভিবাদন জানানোর জন্য দাঁড়িয়ে আছে। মূল হাওরে প্রবেশ করলে পানির নিচের দিকে তাকালে দেখা মিলবে হরেকরকম লতা-পাতা জাতীয় জলজ উদ্ভিদ। দেখে মনে হবে, পানির নিচে অপরূপ সবুজের স্বর্গরাজ্য। টাঙ্গুয়ার হাওরে পাবেন করচ, বরুন, পানিফল, হেলেঞ্চা, বনতুলসি, নলখাগড়া, বল্লুয়া ও চাল্লিয়া জাতের উদ্ভিদ।

Advertisement

যেতে যেতে হাওরের বন্যাকবলিত মানুষের জীবন-যাপন দেখে সবারই মন খারাপ হলো। আধুনিক বিশ্বে এসব মানুষ এখনো সভ্যতার ছোঁয়া থেকে অনেকটা পিছিয়ে। যাদের জীবিকার মূল ভিত্তিই হলো মাছধরা। হাওরে আরও একটি সমস্যা হলো, পারের বাসিন্দাদের শত শত হাঁসের খামার। খামার মালিকরা প্রতিদিন সকালে হাঁসগুলোকে খাবার খাওয়ানোর জন্য হাওরে এনে ছেঁড়ে দেন। আবার সন্ধ্যায় খামারে নিয়ে যান। যদি প্রতিদিন ১ হাজার খামারের হাঁস হাওরে আসে, তাহলে হাঁসগুলোই ১ হাজার পরিযায়ী হাঁসের খাবার খেয়ে ফেলে।

পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, পরিযায়ী পাখিদের কিছু অংশ বহন করে অ্যাভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস। খামারের হাঁসগুলো হাওর থেকে খাবার গ্রহণ করার সময় এ ভাইরাস তাদের শরীরে বহন করে খামারে নিয়ে যায়। আর খামারের হাঁস থেকে এই অ্যাভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা প্রবেশ করে মানবদেহে। খামারের হাঁস থেকে বিভিন্ন ধরনের রোগের জীবাণু পরিযায়ী পাখির মধ্যেও সংক্রমিত হতে পারে।

যা হোক, এভাবে চলতে চলতে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে তাহিরপুর পৌঁছে গেলাম। সেখানে আমাদের জন্য এজাজ মাঝি আগে থেকেই অপেক্ষা করেছিলেন। আমাদের নৌকা আগে থেকেই ঠিক করা ছিল। আমরা দুপুরের খাবার শেষ করে নৌকায় উঠে টাঙ্গুয়ার হাওরের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করলাম। এত সুন্দর আর মনোরম পরিবেশ দেখে সবারই ক্লান্তি দূর হয়ে গেল। কেউ কেউ গান ধরলো আবার কেউ ফটোসেশন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেল। দুপুর তাই রোদের উত্তাপটাও ছিল খুব বেশি।

৪০ মিনিট পর নৌকা ট্যাকেরঘাটের কাছাকাছি নোঙর করল। সবাই গোসল করতে হাওরে নেমে পড়লাম। প্রায় ৩০ মিনিটের মত পানিতে দাপাদাপি করে গোসল শেষ করলাম।

Advertisement

নৌকা আবার চলতে শুরু করলো ট্যাকেরঘাটের দিকে। পড়ন্ত বিকেলের অস্তমান সূর্য আর ভারতের বর্ডারের নিকটবর্তী পাহাড়গুলো হাওরের সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে তুললো। দূর থেকে পাহাড়গুলোর সৌন্দর্য ভ্রমণকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছিল। গোধূলির রক্তিম সূর্য আর হাওরের নিস্তব্ধতা যেন স্বর্গের খুব কাছাকাছি নিয়ে গেল, যার অনুভূতি হয়তো ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। সন্ধ্যার দিকে নৌকা ট্যাকেরঘাটে নোঙর করলো। স্থানীয় বাজারে গিয়ে নাস্তা সেরে আবার নৌকায় ফিরে এলাম। অনেক দিনের একটা ইচ্ছে ছিল সবার, নৌকায় হাওরের বুকে রাতযাপন করার। সে সুযোগ চলে এলো! গান, কবিতা সবই হলো আড্ডায়। কেউ কেউ অতি আবেগপ্রবণ হয়ে পুরোনো অনেক কথা রোমন্থন করলো। এ ধরনের পরিবেশে মনের গহীনে লুকিয়ে থাকা অনেক গল্পের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। যান্ত্রিক জীবনে এভাবে সময় কাটানোর সুযোগ হয় কত জনের!

সবাই মোটামুটি একই বয়সের হওয়ায় আনন্দটা ছিল ধারণার চেয়ে বেশি। যদিও এরআগে সবার সাথে পরিচয় ছিল না। ভ্রমণের এটাই চমকপ্রদ বিষয়, অচেনাকে সহজেই চেনা যায়। অপরিচিতকে অল্প সময়েই আপন করে নেওয়া যায়।

পরদিন ফজরের নামাজ শেষে নৌকা থেকেই সূর্যোদয় দেখলাম। এরপর নীলাদ্রি লেকের দিকে যাত্রা। ১০-১৫ মিনিটের মধ্যেই লেকে পৌঁছলাম। অদ্ভুত সুন্দর আর প্রাকৃতিক পাহাড়গুলোর বেষ্টনী লেকের সৌন্দর্য বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। একপাশে ছোট ছোট টিলা আর অপরপাশে ভারত সীমান্তের কাছে পাহাড়গুলো যেন নীলাদ্রি লেককে ক্যানভাসের মতই সুন্দর লাগছিল। সূর্যের আপতিত রশ্মি লেকের পানিতে পড়ে চোখে প্রতিফলিত হচ্ছিল। সকালের মিষ্টি রোদ আর মৃদু হাওয়া সবারই দেহ-মনকে অনাবিল প্রশান্তির বার্তা দিয়েছিল। পানি এতটা নীল আর প্রকৃতির এমন সবুজ দেখে মন ভালো হয়ে যায়। তবে চুনাপথর উঠানোর কারণে কোনো কোনো জায়গায় অসম্ভব গভীর। তাই লেকে গোসল করতে নামার আগে গভীরতা কোথায় কম, নিশ্চিত হয়ে নিতে হবে।

কিছুক্ষণ পর আবার নৌকায় ফিরে সকালের নাস্তা সারলাম। ৮টা নাগাদ শিমুল বাগান এবং বারিক্কা টিলার দিকে বাইক ভাড়া করে রওনা দিলাম। আনুমানিক ১৫-২০ মিনিটের মধ্যেই যাদুকাটা নদীর ধারে পৌঁছলাম। পানি প্রায় শুকিয়ে যাওয়ায় হেঁটেই পার হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। যাদুকাটা নদী পার হয়েই শিমুলাবাগানে যেতে হয়। নদীর মাঝখানে গিয়ে ভারতের বর্ডারকে পেছনে ফেলে কিছুক্ষণ ফটোসেশন চললো। ভারতের মেঘালয় থেকে উৎপন্ন যাদুকাটা নদী তাহিরপুর উপজেলার উত্তর-পূর্ব প্রান্ত দিয়ে বাংলাদেশে এসেছে। বাংলাদেশ সীমান্তের প্রায় ৫ কিলোমিটার ভেতরে উপজেলার ফাজিলপুরে নাম নিয়েছে রক্তি। এখানে নদীটি বৌলাই নদীর সঙ্গে মিলিত হয়। পাহাড়ি নদী যাদুকাটাকে দেশের অন্যতম সৌন্দর্যের নদী হিসাবে বিবেচনা করা হয়।

তারপর শিমুল বাগানে গেলাম। ২০০৩ সালের দিকে ২৩০০ শতক জমিতে শিমুল গাছ লাগানোর মাধ্যমে জয়নাল আবেদীন নামক এক ব্যবসায়ী এ বাগান শুরু করেন। শিমুল গাছের পাশাপাশি এ বাগানে অনেক লেবু গাছও আছে। সাধারণত শিমুল বাগানের সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় হলো শিমুল ফুল। কিন্তু যে সময় গেলাম; সে সময়ে এ ফুল ফোটার সময় ছিল না। তাই কিছুক্ষণ বাগান ঘুরে দেখলাম। কেউ কেউ ঘোড়ায় চড়ে আনন্দ উপভোগ করলো।

৩০ মিনিট পর বাইকে চড়ে বারিক্কা টিলার দিকে রওনা দিলাম। টিলার উপর থেকে মেঘালয়ের খাসিয়া পাড়া দেখা যায়। টিলায় প্রায় ৪০টি আদিবাসী পরিবার বাস করে। টিলার মধ্যদিয়ে ট্যাকেরঘাট যাওয়ার রাস্তা আছে। পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ভারতের খাসিয়া পাড়া থেকে আসা যাদুকাটা নদী। বর্ষাকালে যাদুকাটা নদী বেয়ে ভারত থেকে প্রচুর বালু আর পাথর আসে। তখন বালু আর পাথর তোলার কর্মব্যস্ততা বিশেষভাবে আকৃষ্ট করে।

কিছুক্ষণ থেকে পাহাড়ের সৌন্দর্য উপভোগ করে ট্যাকেরঘাটের দিকে রওনা দিলাম। টিলা থেকে ফেরার পথে বেশ ঢালু একটি রাস্তা আছে, যা অনেকের জন্যই কিছুটা ভীতির সঞ্চার করে। দেখতে দেখতে আমরা ট্যাকেরঘাট পৌঁছলাম। সেখান থেকে লাকমাছড়ায় গেলাম। খুব কাছেই লাকমাছড়া। মাত্র পাঁচ মিনিটে বাইক নিয়ে যাওয়া যায়। জলরাশি আর পাহাড়ে ঘেরা জায়গাটি। খুব বেশি পর্যটক এখানে যাননি বলে পরিবেশটা বেশ নির্মল। তবে চুনাপাথর আর কয়লা সংগ্রহকারী শ্রমিকদের আনাগোনা সব সময়ই থাকে। কোলাহল, ভিড়, ময়লা-আবর্জনা নেই। মেঘালয় পর্বতমালা থেকে প্রবাহিত ঝরনা ধারার পানি নেমে আসে। তবে বর্ষাকালে বৃষ্টির পানি বাড়ে। বিশাল আকারের সব পাথর পাবেন পুরো এলাকাজুড়ে। চারপাশে মেঘালয় পর্বতের সারি। ধাপে ধাপে নেমে আসা পাহাড়। সেইসাথে পাহাড়ের কোলজুড়ে সাদা ঝরনা।

লাকমাছড়া থেকে নৌকায় তাহিরপুরের দিকে রওনা দিলাম। তাহিরপুরের কাছাকাছি একটি জায়গায় হাওরের পানিতে গোসল সেরে মাছ আর হাঁস দিয়ে দুপুরের খাবার শেষ করে ঘাটে নামলাম। সেখানে থেকে সিএনজিযোগে সুনামগঞ্জ ফিরে সিলেটের দিকে যাত্রা করলাম।

তবে এখন টাঙ্গুয়ার হাওর আর আগের মতো নেই। অতীত ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে পাখি শিকার বন্ধ করতে হবে। অতিথি পাখির আগমন অব্যাহত রাখতে সরকারি প্রচেষ্টার পাশাপাশি স্থানীয় জনগণের ভূমিকা জরুরি। হাওরে মাছ, পাখি শিকার বন্ধ, বন্যপ্রাণি সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন কার্যকর না হলে বিপন্ন হবে স্বাভাবিক জীববৈচিত্র্য।

লেখক: মাস্টার্স শিক্ষার্থী ও সহকারী গবেষক, বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)।

এসইউ/এএ/এমএস