ভ্রমণ

সাঙ্গু লেকের বরফময় পর্বত গলে যাওয়ার দৃশ্য

লতিফুল হক মিয়া

Advertisement

১৫ ডিসেম্বর আমাদের ঘুম ভাঙল রানা ভাইয়ের হাঁকডাকে। তিনি হোটেলের বারান্দা থেকেই দেখতে পাচ্ছিলেন পাহাড়ের এমন অপরূপ দৃশ্য। সেই সাথে সাঙ্গু লেকের বরফময় পর্বত। সূর্যমামার আলো ‘সাঙ্গু লেকে’র বরফময় পর্বতে পড়ে এক অপার্থিব দৃশ্যপট রচনা করেছে। সেই দৃশ্য দেখে তিনি হতবিহ্বল। ‘এই পাহাড় গলে গেল; বরফ শেষ হয়ে গেল’- ইত্যাদি বলে ডাকছিলেন রানা ভাই। সবাইকে ডেকে ডেকে তিনি দেখাচ্ছিলেন সেই দৃশ্যপট। তার ডাকে স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে কক্ষ থেকে বেরিয়ে আমারও চোখ ‘ছানাবড়া’ হলো। এমন একটি জায়গায় আমরা রাতযাপন করেছি বুঝতেই পারিনি। অবশেষে দৃশ্যগুলোর সঙ্গে ফ্রেমবন্দি করতে সবাই ব্যস্ত হলাম।

এরপর প্রাকৃতিক কাজকর্ম সেরে হোটেল থেকে বেরিয়ে পড়লাম সকালের নাস্তা করতে। স্থানীয় একটি বাঙালি রেস্তোরাঁয় আলু পরাটা আর ডিম ওমলেট খেয়ে হোটেলে ফিরলাম। একটু পরে যাব সেই কাঙ্ক্ষিত বরফময় পর্বত ‘ইয়ংথান ভ্যালি’ দর্শনে। হোটেলে ফিরে মন খারাপ হলো সবার। আমাদের ৯ জনের টিমে একজন ছিলেন সাংবাদিক। তারটা বাদে বাকি ৮ জনকে অনুমতি দিয়েছেন সিকিমের ভ্রমণ কর্তৃপক্ষ। সাংবাদিকের ভিসায় আলাদা সিল মারা ছিল, ‘ট্যুরিজম পারপাস। নট ভ্যালিড ফর রিপোর্টিং/ওয়ার্ক’ এ শব্দগুলো দিয়ে। এখানে একজনের নাম বলতে হয়, যিনি সবাইকে অনুপ্রেরণা দিয়েছেন। তিনি হলেন রানা ভাই। তিনি উদ্দীপনা জুগিয়েছেন ‘ভ্রমণ কর্তৃপক্ষ’র কাছ থেকে অনুমতি সংগ্রহের জন্য। পরে ‘পর্যটক তথ্য কেন্দ্রে’ যাওয়া হলো। ওখানে ছিলেন একজন ভদ্রমহিলা। তাকে বোঝানো হলো, তিনি সাংবাদিক কিন্তু ৯ জনের টিম নিয়ে তো আর সাংবাদিকতা করতে আসা হয়নি। আসা হয়েছে ভ্রমণ করতে। তবে ওই ভদ্রমহিলা জানালেন, ‘এটা সংরক্ষিত এলাকা। এই এলাকায় সাংবাদিকদের অনুমতি দেওয়া হয় না।’

কী আর করা, মন খারাপ চিত্তে ফিরলাম হোটেলে। সাংবাদিক ভাইকে গ্যাংটকে রেখেই লাচুংয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিলেন সবাই। এরই মধ্যে টিমের ৬ জন হোটেল থেকে ৩ কিলোমিটার দূরে ট্যাক্সিস্ট্যান্ডে চলে গিয়েছেন। বাকি আছেন রানাভাইসহ আরও দু’জন। হঠাৎ আশার বাণী নিয়ে এলেন ‘হোটেল গ্যালাক্সি’র ম্যানেজার। তিনি জানালেন, ‘সাংবাদিক ভাইকে দেখে আমার কষ্ট হয়েছে। তাই আমি দায়িত্ব নিয়ে আলাদাভাবে ওনার যাওয়ার ব্যবস্থা করেছি।’ এ খবর শুনে সাংবাদিক ভাই খুশিতে আত্মহারা হয়ে হোটেল ম্যানেজারকে জড়িয়ে ধরলেন। অবশেষে হোটেল থেকে লাগেজ নিয়ে আরেকটি ট্যাক্সিতে করে রওনা দেওয়া হলো ট্যাক্সিস্ট্যান্ডে। টিমের সবাই এবার খুশি। ফুল টিম যাবো এবার স্বপ্নের রাজ্যে। পরে জানতে পারলাম, সাংবাদিক ভাইকে নিয়ে যাওয়ার ঝুঁকিটি নিয়েছেন গাড়ি চালক। যিনি আমাদের লাচুংয়ে রাতযাপন, চার বেলা খাবার ও গাইড হিসেবে কাজ করবেন। তার নাম ‘কর্মা ওজের’। এখানে ‘কর্মা’ সম্পর্কে একটু বলে রাখা ভালো। কর্মা খুবই বন্ধুভাবাপন্ন একজন যুবক। ২৫ বছর বয়সী তরুণ কর্মা ভালো ইংরেজি ও হিন্দি বলতে পারেন। বাংলা বলতে না পারলেও বুঝতে পারেন। ১৫ হাজার রুপিতেই তিনি আমাদের রাতযাপন, চারবেলা খাবার এবং দর্শনীয় স্থান ভ্রমণ করিয়ে আবার গ্যাংটকে নিয়ে আসবেন।

Advertisement

গ্যাংটকের ট্যাক্সিস্ট্যান্ড থেকে লাচুংয়ের দূরত্ব ১১৫ কিলোমিটার। এ দিন রাতযাপন করব সেখানে। পরের দিন আবহাওয়ার উপর নির্ভর করবে ইয়ংথান ভ্যালি ভ্রমণের। আমাদের জিপটি বেলা ১২টার দিকে ছাড়ল গ্যাংটকের ট্যাক্সিস্ট্যান্ড থেকে। রৌদ্রোজ্জ্বল ঝলমলে দুপুরে আমাদের জিপ ছুটে চলছে এখন লাচুংয়ের দিকে। গ্যাংটক থেকে কিছু অগ্রসর হয়ে পর্বতের সুরঙ্গ ভেদ করে চলছে আমাদের গাড়িটি। পাহাড়ি আঁকা-বাঁকা পথ। এ পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে ছুটছে আমাদের গাড়ি। কর্মা নেপালি, হিন্দি ও ইংরেজি ভাষার গান বাজিয়ে শোনালেন আমাদের। পরে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত তিনি বাজালেন। তার ঝুলিতে বাংলা গানও বেশ সমৃদ্ধ রয়েছে। বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের গান শুনতে বেশ ভালোই লাগছিল।

ঘণ্টাখানেক পর কর্মা গাড়ি থামালেন একটি ঝরনার কাছে। ১০-১৫ মিনিট ব্যয় করলাম ঝরনা দর্শনে। আবার শুরু হলো যাত্রা। এ পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে ছুটে চলেছে আমাদের গাড়ি। পাহাড়ি রাস্তার পাশে মাঝেমধ্যে দেখা মিলছে দু’একটি গ্রাম। আবারও কোথাও দু’একটি বাড়ি। আড়াইটার দিকে কর্মা আমাদের পাহাড়ি একটি গ্রামে দুপুরের খাবার খাওয়ালেন। খাবারে ছিলো ডিম, ডাল, ভাজি আর ভর্তা। স্বাদ অতুলনীয়। তিনটার দিকে আবার শুরু হলো যাত্রা।

এসইউ/এএ/এমএস

Advertisement