মুজিববর্ষ উপলক্ষে ভূমিহীন-গৃহহীনদের ঘর উপহার দেওয়ার উদ্যোগ নেয় তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। এসময় দেশের বিভিন্ন জেলায় ঘর নির্মাণ করা হয়। ময়মনসিংহেও নির্মিত হয় অনেক ঘর। কিন্তু অনিয়ম-দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতিসহ নানা কারণে প্রকল্পটি বার বার আলোচনায় আসে। এসব ঘরে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার, ঘর বরাদ্দে অনিয়মসহ নানা অভিযোগ ওঠে। এ নিয়ে সংবাদ প্রকাশ হলেও সংশ্লিষ্টরা কোনো ব্যবস্থায় নেয়নি। ফলে ঘর নির্মাণের ঠিকাদার ঘুরতে থাকে ফুরফুরা মেজাজে।
Advertisement
এবার নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলার চর ভেলামারী আশ্রয়ণ প্রকল্পটি। এটি উপজেলার চর বেতাগৈর ইউনিয়নের ব্রহ্মপুত্র নদের পূর্বপাড়ে অবস্থিত। আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের তৃতীয় পর্যায়ের দ্বিতীয় ধাপে নির্মিত এ প্রকল্পে রয়েছে ৭৩টি ঘর। এরমধ্যে মাত্র ২৫টি ঘরে লোকজন বসবাস করছেন। বাকি ঘরগুলোর দরজায় তালা দিয়ে চলে গেছেন বাসিন্দারা। যারা বসবাস করছেন তাদের অনেকের নামে ঘর বরাদ্দ নেই। তারা জানান, স্থানীয় নেতাদের জানিয়ে ঘরে বসবাস করছেন।
স্থানীয়রা জানান, শুরু থেকেই বরাদ্দে অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। এসব ঘরে গৃহহীন, বিধবা, স্বামী পরিত্যক্তা, প্রতিবন্ধী ও অসহায় পরিবারের বসবাস করার কথা। কিন্তু গ্রামে জমি ও বাড়ি আছে এমন লোকজনও ঘর বরাদ্দ পেয়েছেন। কিন্তু তাদের অনেকই এই ঘরে থাকেন না। আবার যারা ঘরে উঠেছিলেন তারা বিভিন্ন সময় ঘর ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছেন।
ভেলামারী আশ্রয়ণ প্রকল্পটি উদ্বোধন করা হয়েছিল ২০২২ সালের ২১ জুলাই। প্রতিটি ঘর তৈরিতে ব্যয় হয় ২ লাখ ৫৯ হাজার টাকা। ওইদিন প্রকল্পের আঙিনায় জেলা ও বিভাগীয় কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে দলিল এবং চাবি হস্তান্তর করা হয়।
Advertisement
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এই আশ্রয়ণ প্রকল্পের ৭৩ নম্বর ঘরটি বরাদ্দ পান কামাল হোসেন। গ্রামে তার জমিজমা ও পাকা ঘর রয়েছে। এছাড়া ৪৩ নম্বর ঘরটি হানিফা নামে আরেকজনের কাছে বরাদ্দ দেওয়া হয়। অথচ গ্রামে তার বাড়িসহ ২ একর জমি রয়েছে।
অপরদিকে ঘর বরাদ্দ নেই আছির উদ্দিনের। তবে তিনি শাকিল নামের একজনের ঘরে থাকছেন। জসিম উদ্দিনের ৬ নম্বর ঘরে বসবাস করেন শাহিনূর। এভাবে বসবাস করছেন আরও অনেকে।
অন্যের ঘরে বসবাস করার বিষয়ে জানতে চাইলে শাহিনূর বলেন, আমি জসিম উদ্দিনকে কখনো দেখিনি। ঘর ফাঁকা, তাই বসবাস করছি।
এ বিষয়ে জানতে জসিম উদ্দিনের মোবাইল নম্বরে একাধিকবার যোগাযোগ করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
Advertisement
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন জানিয়েছেন, জসিম ঘর বুঝে পাওয়ার কিছুদিন পরই চলে যান। গাজীপুর গিয়ে সেখানেই পরিবার নিয়ে থাকছেন।
ঘরে বসবাস করা আব্দুল কুদ্দুস ও আছির উদ্দিন জানান, তাদের নামেও ঘর বরাদ্দ নেই। আব্দুল কুদ্দুস থাকছেন শাকিল নামে একজনের নামে বরাদ্দের ঘরে এবং আছির থাকছেন বিউটির বরাদ্দের ঘরে।
এ বিষয়ে উপজেলার চর বেতাগৈর ইউনিয়নের বাসিন্দা আব্দুল কাদির বলেন, সঠিকভাবে যাচাই-বাছাই করে ঘর বরাদ্দের তালিকা করা হয়নি। তখন অনেক সচ্ছল ব্যক্তি বরাদ্দের খাতায় নাম উঠাতে বিভিন্নভাবে তদবির করেছেন। যদি প্রকৃত গরীব-অসহায় ব্যক্তিরা ঘর পেতেন, তাহলে তারা এসব ঘরেই থাকতেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঘরে বসবাস করা একজন জানান, প্রকল্পের ১১টি নলকূপের প্রতিটি শুরু থেকেই বিকল হয়ে পড়ে আছে। নিজেদের চেষ্টায় দু-একটি নলকূপ চালু রাখা সম্ভব হলেও তা থেকে ঘোলা পানি ওঠে। প্রকল্পের আশপাশে কাজ করে খাওয়ার মতো কোনো ব্যবস্থা নেই। কাছাকাছি নেই ছেলে-মেয়েদের পড়ালেখা করার প্রতিষ্ঠান। এছাড়া অনেকে সচ্ছল ও নিজেদের জমিজমা রয়েছে। তাই ঘর রেখে চলে গেছেন।
উপজেলার চর বেতাগৈর ইউনিয়নের সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান ফরিদ উদ্দিন বলেন, প্রকৃত ভূমি ও গৃহহীন লোকজন বরাদ্দ পায়নি বলেই ঘরগুলো তালাবদ্ধ থাকে। অন্যথায়, বরাদ্দ পাওয়া সব লোকজনই বসবাস করতেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নান্দাইল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সারমিনা সাত্তার জাগো নিউজকে বলেন, সম্প্রতি যোগদান করেছি। নিজেদের জমি ও বাড়ি আছে এমন লোকজন বরাদ্দ পেয়েছেন কি না আমার জানা নেই। যারা ঘর তালাবদ্ধ করে চলে গেছেন তাদের তালিকা করা হবে। একজনের ঘরে আরেকজন থাকার নিয়ম নেই। খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কামরুজ্জামান মিন্টু/জেডএইচ/জিকেএস