ভ্রমণ

বালিখলা হাওরে আলো-আঁধারির খেলা

কিশোরগঞ্জ জেলার করিমগঞ্জ উপজেলার বালিখলা এলাকায় অবস্থিত বালিখলা হাওর। শহর থেকে সবচেয়ে কাছে বলে সহজেই এ হাওরের স্পর্শ পাওয়া যায়। তাই এবারের ঈদে পর্যটকের ঢল নেমেছে বালিখলা হাওরে। সড়কের পাশে দাঁড়িয়ে তারা হাওরের বিপুল সৌন্দর্য উপভোগ করেছেন। ঘুরে এসে বিস্তারিত জানাচ্ছেন সাদিকুল ইসলাম নিয়োগী পন্নী-

Advertisement

এক.‘চল, সবাই হাওর থেকে ঘুরে আসি।’ আমার এমন কথায় ছোট বোন বলল, ‘তুই প্রতি ঈদেই আমাদের নিয়ে যাস! তাই এবার যাবো না।’ আমি বললাম, ‘সত্যি যাবো এবার।’ ‘সত্য-মিথ্যা বুঝি না ভাইয়া। তোর মন চাইলে ঘুরে আস...’ ছোট বোন বেশ বিরক্ত। কারণ এর আগেও বেশ কয়েকবার যাওয়ার কথা বলেও যেতে পারিনি।

ফোন দিলাম সাংবাদিক বন্ধু টিটু দাশকে। সে পরামর্শ দিলো করিমগঞ্জের বালিখলা হাওর থেকে ঘুরে আসতে। আমাদের বাড়ি থেকে ইজিবাইক যোগে যেতে হবে হাওরে। ইজিবাইক চালক ফাইজুল ভাইকে ফোন করলাম। সে বলল, রেডি থাকিস। বিকেলে নিয়ে যাবো।

সব ঠিকঠাক করে বোনকে বললাম। কিন্তু সে তেমন গুরুত্ব দিলো না। বউকে বললাম। সে বলল, আর হাওরে যেতে হবে না। বাড়ির সামনে তো পুকুর আছে। প্রতি বছর তো তা দেখাও। বাবাকে বললাম, চলো আমাদের সাথে। তিনি বললেন, সমুদ্র দেখে এসেছিস কয়েকদিন আগে। এখন হাওর দেখলে পুকুর পুকুর মনে হবে। আমি কারো সাথে আর কথা বাড়ালাম না।

Advertisement

দুই.বিকেলে ফাইজুল ভাই আমাদের বাড়িতে এলো। আমি তাকে দেখে বললাম, ‘এতো তাড়াতাড়ি আসলা?’ সে বলল, ‘দূরের রাস্তা। এখন রওনা দেওয়াই ভালো।’ ফাইজুল ভাইয়ের সাথে কথা শেষ না হতে বোন এসে বলল, ‘আমি রেডি।’ আমি বললাম, ‘তুই তো যাবি না। রেডি কেন?’ বোন বলল, ‘তুই দেশ-বিদেশে ঘুরিস। হাওরে গিয়ে কী করবি? আমরা ঘুরে আসি। তুই থাক।’ বউ অন্যরুম থেকে এসে বলল, ‘তুমি এখনো বসে আছো?’ সে-ও বোনের সাথে পাল্লা দিয়ে রেডি হয়ে গেছে।

সবার সাজসাজ ভাব। আমিও কোনরকম রেডি হলাম। আমাদের উৎসাহ দেখে বাবার চোখ-মুখেও উত্তেজনা কাজ করছিল। কিন্তু বলছেন না। কারণ আগে তিনি অনীহা প্রকাশ করেছেন। আমরা বিষয়টা বুঝতে পেরে বাবাকে অনুরোধ করলাম। বাবা বললেন, ‘তোরা যেহেতু চাচ্ছিস আমার আপত্তি নাই। একটু বস। আমি সেভ করে নেই।’ আমি বললাম, ‘এই সময়ে সেভ!’ ‘আমি সেভ ছাড়া যাবো না। বেশি তাড়াহুড়া করলে তোরা চলে যা।’ বুঝলাম কথা বললে বাবা আরও রেগে যাবেন। আমরা বসলাম। বাবা সেভ করলেন। প্যান্ট-শার্ট পরলেন। কয়েক দফা পারফিউম দিলেন। (বাবা মুদির দোকানে গেলেও পারফিউম দেন)। তারপর আমাদের বললেন, ‘চল...’

তিন.ইজিবাইক তালজাঙ্গা বাজার হয়ে করিমগঞ্জের দিকে ছুটছে। দল ভারি করার জন্য আমি বন্ধু নাঈম ও টিটু মোদককে ফোন দিলাম। তারা করিমগঞ্জ থেকে আমাদের সাথে যোগ দিলেন। দীর্ঘদিন পর দুই বন্ধুর সাথে দেখা হলো। গল্প করতে করতে আমরা পৌঁছে গেলাম বালিখলা হাওরে। হাওরের মাঝ দিয়ে পাঁকা রাস্তা। যে দিকে চোখ যায় পানি আর পানি। পড়ন্ত বিকেলে হাওর সেজেছে অপরূপ সাজে। আকাশের রংধনু পানিতে আলোর দ্যুতি ছড়াচ্ছে। দূরের ডিঙি নৌকা হাওরের সৌন্দর্যকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। দু’পাশের অপরূপ দৃশ্য দেখতে দেখতে আমরা রাস্তার শেষপ্রান্তে চলে গেলাম। মূলত এ সড়কের শেষ সীমানায় হাওরকে ঘিরে গড়ে উঠেছে পর্যটনকেন্দ্র।

আমাদের মতো এখানে অনেকেই এসেছেন বেড়াতে। ইজিবাইক থেকে নামার পর কাকতালীয়ভাবে দেখা হলো আরেক বন্ধু রাসেলের সাথে। সে আমাদের দেখে চমকে গেল। ‘কীরে তোরা এখানে আসবি আগে জানাসনি কেন?’ তার প্রশ্নের উত্তরে বললাম, ‘তোকে চমক দেওয়ার জন্যই বলা হয়নি।’ রাসেল একটি ইঞ্জিন চালিত নৌকা ঠিক করে দিয়ে বলল, ‘তোরা ঘুরে আস। আমি একটা কাজে যাচ্ছি। ফেরার পথে দেখা হবে।’

Advertisement

একে একে আমরা নৌকায় উঠলাম। নৌকা চলা শুরু করলো। টিটু বেসুর গলায় গান ধরলো, ‘ওরে নীল দরিয়া...’সবাই সুর মেলালাম। এই সুরে গান মানুষের সামনে গাইলে নিশ্চিত মার খেতাম।

সূর্য ডুবে গেছে। আলো-আঁধারি পরিবেশে হাওরকে আরও অপরূপ লাগছে। দূর থেকে চামড়া ঘাটকে আলাদা একটা দ্বীপ মনে হচ্ছে। হাওরের পাশের গ্রামগুলোকেও মনে হচ্ছে একেকটা দ্বীপ। অনেকেই বড় ট্রলারে হৈ-হুল্লোড় করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মনে হচ্ছে সন্ধ্যার হাওর উৎসবের নগরীতে পরিণত হয়েছে। ঘণ্টাখানেক ঘোরাফেরা আর ফটোসেশনের পর আমরা ঘাটে ফিরে আসলাম। রাসেল তখন আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। আমি বললাম, ‘কোথাও বসতে চাই।’ ‘চল, সবাই চটপটি খাই।’ বলে রাসেল একটা দোকানে নিয়ে গেল।

পানির ওপর মাচাং করে এখানে বেশকিছু দোকান করা হয়েছে। এসব দোকানে চা, চটপটিসহ নানা ধরনের খাবার পাওয়া যায়। আমরা অবশ্য চটপটি খেতে পারিনি। কারণ অনেক আগেই নাকি এ দোকানের চটপটি শেষ হয়ে গিয়েছে। তবে ফুচকা খেয়েই সবাই সন্তুষ্ট হলাম।

রাসেলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ইজিবাইকে চড়লাম। বাইক চলছে। দূর থেকে হাওরের নৌকা ও ট্রলারের বাতিগুলোকে তখন জোনাকি পোকার মতো দেখাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল শত শত জোনাকি পোকা দলবেঁধে হাওরের বুকে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

এমন চোখ জুড়ানো দৃশ্য দেখতে দেখতে আমরা হাওরকে পেছনে ফেলে চলে আসলাম মূল সড়কে। তারপর সেই আগের রাস্তার পথ ধরে গ্রামের বাড়িতে। মাঝে যাত্রা বিরতিতে দুই বন্ধু বিদায় নিলো। আনসার অফিসার টিটু তাদের দোকানের কয়েক কেজি মিষ্টি দিয়ে দিলো। ব্যাংকার নাঈম দিলো আইসক্রিম।

কিভাবে যাবেন: ঢাকা থেকে ট্রেন বা বাসযোগে প্রথমে কিশোরগঞ্জ জেলা সদরে পৌঁছাতে হবে। তারপর শহরের একরামপুর থেকে সিএনজি বা অটোরিকশায় চড়ে সবমিলিয়ে গন্তব্যে পৌঁছতে ঘণ্টাখানেক সময় লাগবে।

থাকা-খাওয়া: কিশোরগঞ্জ শহরে বেশকিছু ভালো মানের আবাসিক হোটেল রয়েছে। এছাড়া শহরে ভালো মানের বিভিন্ন ছোট-বড় খাবার হোটেল, চাইনিজ ও মিনি চাইনিজও আছে।

এসইউ/এমএস