প্রবাস

প্রণোদনা কি প্রবাসীদের সমস্যার সমাধান

দলমত নির্বিশেষে সবার মুখে একই কথা প্রবাসীরা দেশের অর্থনীতির চালিকা শক্তি। এই প্রবাসীদের জন্য করণীয় কি নেই সরকারের। কিন্তু সরকার উল্লেখযোগ্য এমন কি করেছেন প্রবাসীদের জন্য যার সুবাদে প্রায় এক কোটি মুখভরা হাসি নিয়ে সরকারকে প্রাণ ভরে দোয়া করবেন। ক্ষুদ্র এ জীবনে আমার চোখে এমন দৃশ্য পড়েনি যে সরকারের সহযোগিতায় প্রবাসীরা ভীষণ আনন্দিত।

Advertisement

সরকার থেকে অনেক কিছু আমরা পাই তা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। এ যাবৎ যা আমরা পেয়েছি তা শুধু কাগজে-কলমে। বাস্তবে নয়। প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের সুযোগ এবং ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের সুবিধাসহ আরও অনেক কিছু। কথা হলো প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক থেকে গত দশ বছরে ক'জন পেয়েছেন সরকারি সুবিধা আর কতজনকে অর্থনৈতিকভাবে সহযোগিতা করা হয়েছে তা আমার জানা নেই।

তবে মরার পরে ইতালি থেকে নিজ পরিবারের কাছে লাশ বিনা খরচে পৌঁছে দিতে ২০১৭ সালে রোম দূতাবাসের জন্য ৫০ ও মিলান কনসুলেট জেনারেল অফিসের জন্য ২০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয় সরকার। এজন্য রোমে নিযুক্ত বাংলাদেশ দূতাবাসের রাষ্ট্রদূত আব্দুস সোবাহান সিকদার এ বরাদ্দ পেতে ভূমিকা রাখেন।

বরাদ্দকৃত অর্থ দিয়ে ইতালি প্রবাসীদের লাশ দেশে যাবে। তবে এ সুযোগটি পেতে প্রতিটি প্রবাসীকে শর্তপূরণ করতে হবে। অর্থাৎ অবশ্যই তাকে ৪০ ইউরো দিয়ে ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের সদস্যপদ গ্রহণ করতে হবে। অন্যথায় মরার পর লাশ নিজ উদ্যোগে দেশে পাঠাতে হবে।

Advertisement

একটি হৃদয়বিদারক ঘটনা ইতালিতে এমডি জিয়াউল ইসলাম চৌধুরী নামে এক প্রবাসী অসুস্থ অবস্থায় ভেনিসের আনজেলো নামক হাসপাতালে মারা যান। দীর্ঘ ২৫ দিন মর্গে পড়ে থাকে লাশ। কেউ কোনো খোঁজ নেননি। পরে জিয়াউলের সঙ্গে পরিচিত একজন ইতালিয়ান নাগরিক দীর্ঘদিন তার সাথে যোগাযোগ না থাকায় তিনি জিয়াউলের খোঁজে নেমে পড়েন।

বিভিন্ন স্থানে খোঁজার পর একটি হাসপাতালে তার সন্ধান পায়। পরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লাশের সন্ধান চেয়ে সাবেক বাংলাদেশ সমিতির সভাপতি নুরে আলম সিদ্দিকী বাচ্চু একটি পোস্ট করলে এটি ভাইরাল হয়।

পোস্টটি পাঠক প্রিয় একটি পত্রিকার সংবাদকর্মীর নজরে পড়লে তিনি মিলান কনসুলেট অফিসে ফোন দেন। অফিসের এক কর্মকর্তার সাথে লাশ নিয়ে কথা হলে তিনি সংবাদকর্মীকে জানান এ ব্যাপারে তাদের কাছে কোন তথ্য নেই। এরপরই অফিস কর্মকর্তাদের টনক নড়ে।

এরপর সংবাদটি অফিসে মেইল করার প্রায় বিশ মিনিটের মধ্যে মিলান কনসুলেট অফিস থেকে ফোন করে সংবাদকর্মীকে জানান স্থানীয় পুলিশ এ লাশের খোঁজ চেয়ে একটি মেইল করেছে। এর আগে তিনি সংবাদকর্মীকে প্রশ্ন করে ছিলেন কেন লাশের খবর নেয়া হচ্ছে। সংবাদকর্মী উত্তরে বলেছিলেন ২৫ দিন ধরে পরিচয়হীন লাশ মর্গে পড়ে আছে আপনাদের (কনসুলেট অফিসের) কি করণীয় আছে। তিনি বললেন, খুব দ্রুত শনাক্ত করে জানাবেন। এ পর্যন্তই শেষ এরপর তারা আর কিছুই জানায়নি মর্গে থাকা লাশের খবর।

Advertisement

সরকারি কর্মকর্তা বনাম সাধারণ মানুষ

মানুষ মরণশীল চিরন্তন এ সত্যকে খণ্ডায় কে। জিয়াউলের মতো অনেকেরই কপাল পুঁড়ে প্রবাসে এসে। সরকারের দেখার যেন সময় নেই। তবে এও সত্য সরকার প্রধানতো জানে না কি ঘটছে বিশ্বের বিভিন্ন দূতাবাসে। প্রবাসীদের কার কি সমস্যা। প্রবাসীদের সমস্যা সমাধানে সরকারের বিশেষ উদ্যোগ না থাকলেও তাদের প্রেরিত রেমিট্যান্স সব সময় দেশে রিজার্ভ থাকে যা দিয়ে দেশের অর্থনীতি স্থির থাকে।

যাইহোক লাশ দেশে পাঠাতে মিলান কনসুলেট অফিসের কোনো উদ্যোগ বা মাথাব্যথা না থাকলেও সাধারণ মানুষের দায়িত্ববোধ সরকারি কর্মকর্তাদের চেয়েও কয়েকগুণ বেশি।

লাশ দেশে পাঠানোর দায়িত্ব নিলেন ভেনিসে বসবাসরত ভেনিস বাংলা স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি সৈয়দ কামরুল সারোয়ার। যতটুকু জানি ভেনিসে প্রবাসী বাংলাদেশিদের যেকোন সমস্যায় তিনি এগিয়ে আসেন। লাশ দেশে পাঠানোর ব্যাপারে তার সাথে আলাপ হলে তিনি বলেন, মিলান কনসুলেট অফিস লাশ পাঠানোর জন্য কোন আর্থিক সহযোগিতা করতে পারবে না।

অফিস শুধুমাত্র ট্রাভেল পাস দিয়ে তাদের দায়িত্ব পালন করেছেন। জিয়াউলের লাশ পাঠাতে মিলান কনসুলেট অফিস আর্থিকভাবে কোন সহযোগিতা না করার অন্যতম কারণ মৃত্যুর আগে সে সরকারের শর্ত পূরণ করতে পারেনি অর্থাৎ জিয়াউল ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের সদস্য হননি। অবশেষে প্রবাসীদের আর্থিক সহযোগিতায় গত বুধবার জিয়াউলের লাশ ভেনিস থেকে দেশে পাঠানো হয়। তাহলে সরকারের এই দুই টাকার প্রণোদনা দিয়ে প্রবাসীদের সমস্যা কি সমাধান হবে।

এ যাবৎ কোন দূতাবাস নিজ উদ্যোগে প্রবাসীদের সহযোগিতা করেছে বলে আমার জানা নেই। তাদের কাছে মৃত্যুর আগেই প্রবাসীরা সঠিক মূল্যায়ন পায় না মৃত্যুর খবর দিলে অফিসিয়াল ব্যবস্থা নিতে একটু সময় লাগা স্বভাবিক নয়কি।

প্রবাসীরা মনে হয় জন্মগতভাবে অদৃশ্য অসহায়ত্বের দেখা পেয়েছেন তাই কোনভাবেই দূতাবাস থেকে কোনো সহযোগিতা তারা পান না। এমন অভিযোগ বিশ্বের প্রতিটি বাংলাদেশি দূতাবাসের বিরুদ্ধে অহরহ পাওযা যায়। তাছাড়া বাংলাদেশ থেকে কোন দেশে যেতে যে, ধরনের সহযোগিতা সরকারিভাবে পাওয়া দরকার তা কোন সরকারের আমলে কোন প্রবাসী পায় না।

আমারা যদি চীনা, ফিলিপাইন, ভারত, শ্রীলঙ্কাসহ অন্যান্য দেশের সরকারি সুযোগ সুবিধার কথা বলি এতে আশ্চর্য হওয়া ছাড়া আর কিছু করার নেই। এ সমস্ত দেশের নাগরিকরা অন্য দেশে শ্রমিক হিসেবে যাওয়ার আগে সরকারিভাবে ট্রেনিং, অর্থনৈতিক সহযোগিতা দেয় অর্থাৎ নাগরিক সুবিধা দেয় সরকার।

এক একজন শ্রমিককে প্রবাসে পাড়ি জমাতে ভিসা ফি ও বিমান ভাড়া ছাড়া বাড়তি কোন টাকা গুণতে হয় না। বাংলাদেশে এর চিত্র সম্পূর্ণ উল্টো বরং একজন শ্রমিক কোন দেশে যেতে কি পরিমাণ হয়রানির স্বীকার হতে হয় তা বিশ্লেষণ আকারে বলা কঠিন।

এরপর একজন শ্রমিক দেশ থেকে নানারকম চড়াই উৎরাই পাড়ি দিয়ে প্রবাসে এসে কর্মস্থলে কোন সমস্যা হলে এই সমস্যা সমাধানের জন্য দূতাবাসগুলোর কোন সহযোগিতা পাওয়া যায় না। কোনো কোনো কোম্পানি বেতন দিতে গড়িমসি, মানসিক টর্চারসহ নানাভাবে হয়রানির স্বীকার হলে দূতাবাস শ্রমিকদের জন্য এগিয়ে আসে না। এটি অত্যন্ত দুঃখজনক একজন প্রবাসীর জন্য। বাংলাদেশ ছাড়া অন্য দেশের নাগরিকরা তাদের দূতাবাস থেকে সমস্যা উত্তোরণের জন্য এগিয়ে আসার অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে। বাংলাদেশের নাগরিকরা দেশে থেকে দেশান্তরে সব সময় অবহেলিত।

সরকারি সহযোগিতা ছাড়াই নিজ অর্থে বিদেশে গিয়ে নানা রকম সমস্যার মধ্য দিয়ে দেশের অর্থনীতিতে প্রবাসীরা বিশেষ ভূমিকা রাখছে। কিন্তু কোন প্রবাসী বিপদে পড়লে দূতাবাস সহযোগিতা করতে কার্পণ্য করে। কেন এ রকম করা হয় এ প্রশ্নের জবাব কার কাছে পাওয়া যাবে।

জিয়াউলের লাশ মিলান কনসুলেট অফিসের সহযোগিতা না দেয়া অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামালের কথা উপেক্ষা করা হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে ইতালি আওয়ামী লীগের সংবর্ধনায় প্রধান অতিথি হিসেবে তিনি বলেছিলেন প্রবাসীরা দেশের এক একজন অর্থমন্ত্রী। বর্তমান সরকার প্রবাসবান্ধব। প্রবাসীদের যৌক্তিক দাবি পূরণে সরকার বদ্ধপরিকর। প্রবাসীদের মরদেহ এখন থেকে দেশে যাবে বিনাখরচে।

প্রখর রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে প্রবাসীরা সেই অর্থ দেশে পাঠায় পরিবারের সুখের আশায় এবং দেশের অর্থনীতি সচল রাখতে। এরপরেও দেশে আসলে বিমানবন্দরে হয়রানির স্বীকার হন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখা যায় বিমানবন্দরের কর্মকর্তারা ট্রলি নিয়ে পর্যন্ত হয়নি করেন এমন দৃশ্য আমরা নিজ মাতৃভূমিতে দেখতে পাই।

এর চেয়ে দুঃখজনক আর কি হতে পারে। প্রবাসে কষ্ট করে এসে নিজ দেশেও অবশেষ বুক ভরা জ্বালা নিয়ে বাড়ি ফিরতে হয়। এমন কাণ্ড পৃথিবীর আর কোন দেশে দেখা যায় না। মনে হয় না এ রকম কেউ টানাহ্যাঁচড়া করে। তাও আবার নিজ দেশে এসে খোদ নিজ দেশের মানুষ দ্বারা হয়রানি। এ আচরণ বড়ই বেদনাদায়ক বাংলাদেশিদের জন্য।

প্রবাসীরা দেশে রেমিট্যান্স পাঠিয়ে দেশকে সহযোগিতা করছেন সরকারের উচিত প্রবাসীদের সহযোগিতা করা। পাশাপাশি বিশেষ কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করে হয়রানি নামক ভয়ংকর আচরণ থেকে রক্ষা করা। প্রবাসীরা যত বেশি নিরাপদ জীবন-যাপন করতে পারবে ততই রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধি পাবে। দেশে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হবেন।

লেখক, প্রবাসী সংবাদকর্মী

এমআরএম