আন্তর্জাতিক

দলে দলে সন্ন্যাসী হচ্ছে ভারতের জৈন ধর্মের তরুণ-তরুণীরা

‘আমি আর কখনোই তাকে আলিঙ্গন করতে পারব না। তার চোখের দিকে আর তাকাতে পারব না।’ এভাবেই নিজের মেয়ে ধ্রুবি প্রসঙ্গে কথাগুলো বলছিলেন ইন্দ্রবদন সিংহি।

Advertisement

মেয়ে স্বাভাবিক সাংসারিক জীবন ত্যাগ করে সন্ন্যাসিনী হওয়ার দীক্ষা নিয়েছে। সেই উপলক্ষে বাড়িতে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়। ঘর-সংসার ছেড়ে মেয়ে এখন চলে যাবে আশ্রমে। সন্ন্যাসিনী হয়ে সেখানেই থাকবে। সংসার জীবনের শেষ কদিনে আত্মীয় স্বজন, বন্ধুরা বাড়িতে এসে দেখা করে যাচ্ছেন মেয়ের সঙ্গে।

২০ বছরের ধ্রুবি আর দশটি মেয়ের মতো জীবনযাপন করত। গান শুনত। কাছের পার্কে ক্রিকেট খেলত। বন্ধুদের সঙ্গে রেস্তোরাঁয় খেতে যেত। কিন্তু সন্ন্যাস বরণের পর সে আর তার বাবা-মাকে ‘বাবা-মা’ বলে ডাকতে পারবে না। চুল কেটে ন্যাড়া হতে হবে। খালি পায়ে হাঁটতে হবে। খেতে হবে শুধু ভিক্ষা করে। তাও আবার সব খাবার খাওয়া যাবে না।

আরও কিছু কঠোর বিধিনিষেধ তাকে আজীবন মেনে চলতে হবে। গাড়ি চড়া যাবে না, গোসল করা যাবে না। ফ্যানের নিচে শোয়া যাবে না, মোবাইল ফোন ব্যবহার করা যাবে না।

Advertisement

ধ্রুবি সিংহির পরিবার প্রাচীন জৈন ধর্মের অনুসারী। এখনো ভারতের এই ধর্মের ৪৫ লাখ অনুসারী রয়েছে। যারা এই ধর্মের আচার পালন করেন তাদেরকে ধর্মগুরুর জারি করা কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যে জীবন যাপন করতে হয়।

ইন্দ্রবদন সিংহি জানালেন, তাদের একমাত্র সন্তান ধ্রুবি ছোট থেকেই উচ্ছ্বল, বহির্মুখী ছিল। জিনস পরত। টিভি রিয়েলিটি শোতে অংশ নেয়ার আগ্রহ প্রচণ্ড আগ্রহ ছিল। কিন্তু গত পাঁচ বছর ধরে সে ধীরে ধীরে ধর্মের দিকে ঝুঁকছিল। তারপর সম্প্রতি স্বাভাবিক জীবনযাপন থেকে মুক্ত হয়ে সন্ন্যাসী হওয়ার দীক্ষা নেয় সে।

শুধু ধ্রুবি নয়, তার মতো শতশত জৈন তরুণ-তরুণী পার্থিব জীবন ত্যাগ করে সন্ন্যাস বরণ করছে। বছরে বছরে তাদের সংখ্যা বাড়ছে এবং ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা এই পথে বেশি যাচ্ছে।

মুম্বাই বিশ্ববিদ্যালয়ে জৈন দর্শন পড়ান ড. বিপিন দোশী। তিনি বলেন, ‘আগে বছরে বড় জোর ১০ থেকে ১৫টি দীক্ষা নেয়ার ঘটনা ঘটত। গত বছর সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ২৫০। এ বছর সংখ্যা ৪০০ হতে পারে।’

Advertisement

জৈন সমাজের নেতারা বলছেন, প্রধানত তিনটি কারণে এটি হচ্ছে : তরুণ বয়সীরা আধুনিক জীবনের চাপে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে; আধুনিক প্রযুক্তির কারণে ধর্মের শিক্ষা, দর্শন নতুন প্রজন্মের কাছে সহজে পৌঁছাচ্ছে এবং ধর্মীয় স্থানে সফরের সুযোগ তৈরি হওয়ায় অনেক তরুণ-তরুণী সন্ন্যাস জীবনের অভিজ্ঞতা নিতে আকৃষ্ট হচ্ছে।

ফিজিওথেরাপিস্ট পূজা বিনাখিয়া গত মাসে সন্ন্যাসিনীর দীক্ষা নিয়েছেন। তিনি বললেন, এখন তার জীবন পুরোপুরি বদলে গেছে।

এর আগে ২৪ ঘণ্টা উদ্বেগের জীবন ছিল পূজার। পরিবারের জন্য উদ্বেগ, বন্ধুদের জন্য উদ্বেগ, নিজের চেহারা নিয়ে উদ্বেগ, পেশা নিয়ে উদ্বেগ। এখন আর তাকে ভাবতে হয় না বন্ধুরা, স্বজনরা তাকে নিয়ে কী ভাবছে, কী চোখে দেখছে। তিনি বলেন, ‘এখানে আমরা শুধুই আত্মার পরিশুদ্ধি নিয়ে ভাবি।’

দীক্ষা নেয়ার কয়েকদিন আগে ধ্রুবির কথা ছিল তার গুরুই ‘তার কাছে সব, তিনি তার জগত; তিনি যা বলেন, সেটাই তার কাছে শেষ কথা।’

নতুন দীক্ষা নেয়া সব জৈনরাই তাদের গুরুকে নিয়ে, গুরুর কথায় পাগল। ধর্মীয় গুরুরা তাদের শিষ্যদের কাছ শতভাগ আনুগত্য পান।

ড. দোশী বলেন, ‘এই প্রবণতা সবসময় এ রকম ছিল না। আগে ধর্মীয় গুরুরা অনেক আত্মকেন্দ্রিক ছিলেন। তাদের নিজেদের আত্মার পরিশুদ্ধি নিয়েই মূলত তারা ভাবতেন। কিন্তু এখন এই ধর্মগুরুরা তরুণ যুবকদের কাছে ধর্মের বাণী পৌঁছে দিতে অনেক তৎপর।’

‘তারা (গুরুরা) ভালো কথা বলেন, নতুন প্রজন্মের কাছে তারা সহজ সাধারণ একটি জীবনের পথ তুলে ধরেন। তরুণ-তরুণীরা তাতে আকৃষ্ট হচ্ছে।’

‘১০ বছর আগেও জৈনরা তাদের ধর্মীয় বইপত্র পড়তেন শুধু প্রাচীন অর্ধ মগধি এবং সংস্কৃত ভাষায়। কিন্তু এখন অনেক ধর্মীয় বইপত্র ইংরেজিতে অনুবাদ হয়েছে। জৈন ধর্মের ইতিহাস নিয়ে শর্ট-ফিল্ম হয়েছে। সোশাল মিডিয়ায় সেগুলো প্রচার করা হচ্ছে। ফলে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে আগ্রহ তৈরি হচ্ছে’-যোগ করলেন ড. দোশী।

মূলত হোয়াটসআ্যাপের মাধ্যমে ছড়ানো এসব শর্ট-ফিল্মে সন্ন্যাস জীবনকে অত্যন্ত ইতিবাচক হিসাবে তুলে ধরা হচ্ছে, ধর্ম গুরুদের ‘সুপারহিরো’ হিসেবে দেখানো হচ্ছে।

মুনি জিনভটশারিয়া বিজয় মহারাজাসাহেব নামে একজন জৈন ধর্মগুরু নিজে ইউটিউবে বেশ কিছু ভিডিও ছেড়েছেন। ইউটিউবে তার ফলোয়ারের সংখ্যা ১০ লাখেরও বেশি।

ধ্রুবি জানায়, পাঁচ বছর আগে একটি আশ্রমে গিয়ে কিছুদিন থাকার পর থেকে সে সন্ন্যাস জীবনের প্রতি আকৃষ্ট হতে শুরু করে। ওই আশ্রমে গিয়ে কিছুদিন থেকে যেকোনো জৈন, সন্ন্যাস জীবনের অভিজ্ঞতা নিতে পারে। সেখানে খালি পায়ে থাকতে হয়, বিদ্যুৎ নেই, গোসলের ব্যবস্থা নেই। আশ্রমে নির্ভার সহজ এই জীবনযাপনে আকৃষ্ট হচ্ছে অনেকে।

১২ বছরের কিশোর হেট দোশী বলল, ‘আমার গুরু বলেছেন, এই পার্থিব জগত ভালো নয়। আমি পাপের জীবন থেকে দূরে যেতে চাই। আমি দীক্ষা নিতে চাই। গুরু বলেছেন, যত তাড়াতাড়ি করা যাবে, ততই ভালো। আমি ১৫ বছর বয়সের আগেই দীক্ষা নেব।’ বিবিসি বাংলা

এসআর/এমকেএইচ