মতামত

মেধাদীপ্ত উচ্চশিক্ষিত জাতীয় চারনেতা : অনুসরণীয় অনুকরণীয়

সমাজতন্ত্রী মার্ক্সবাদী, বিপ্লবী, চিকিৎসক, লেখক, বুদ্ধিজীবী, গেরিলা নেতা, কূটনীতিবিদ, সামরিক তত্ত্ববিদ এবং কিউবার বিপ্লবের প্রধান ব্যক্তিত্ব এর্নেস্তো চে গুয়েভারা বলেছিলেন, "বিপ্লবী হতে চাও? বিল্পবের প্রথম শর্ত, শিক্ষিত হও।" আর শিক্ষা মানেই মঙ্গল ও কল্যাণের পথ, অন্ধকার কুসংস্কার থেকে আলো ও প্রগতির দিকে এগিয়ে চলা।

Advertisement

শিক্ষিত মানেই আলোকিত মানুষ, পথপদর্শক। আর রাজনীতি হল এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে নির্দিষ্ট কোনো গোষ্ঠীর আদর্শকে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ে প্রতিফলিত করা। রাজনীতি লক্ষ্য হলো সমাজকে সংস্কার করে কল্যাণের পথে এবং উন্নতির দিকে ধাবিত করা। পঞ্চাশ-ষাট দশকে ছাত্র রাজনীতির কথা শুনলে ভেসে উঠতো একজন মেধাবী, শিক্ষিত, সমাজ সচেতন, নিষ্ঠাবান, সৎ এক তরুণের ছবি। কবি শামসুর রাহমানের ভাষায়,

`` স্বাধীনতা তুমি বটের ছায়ায় তরুণ মেধাবী শিক্ষার্থীরশাণিত কথার ঝলশানি লাগা সতেজ ভাষণ।"

বঙ্গবন্ধু বলেছেন, "সোনার বাংলা গড়তে হলে সোনার মানুষ চাই। সোনার মানুষ আকাশ থেকেও পড়বে না আবার মাটি থেকেও গজাবে না। সোনার মানুষ আমাদের মধ্যে থেকেই তৈরি হতে হবে।" সেই সোনার মানুষ, শিক্ষিত ও সুস্থ রাজনীতির পথিকৃৎ ছিলেন জাতীয় চারনেতা। তাঁরা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ৯ মাস সাফল্যের সঙ্গে রাজনৈতিক নেতৃত্ব দেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি থাকা অবস্থায় তাকে রাষ্ট্রপতি করে গঠিত এই প্রবাসী সরকারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। এএইচএম কামরুজ্জামান এবং এম মনসুর আলী ছিলেন ঐ সরকারের দুই প্রভাবশালী মন্ত্রী। সর্বগুণে গুণান্বিত জাতীয় চার নেতার জীবনের প্রতি আলোকপাত করা যাক।

Advertisement

সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তিনি ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি। তিনি ময়মনসিংহ জিলা স্কুল থেকে ১৯৪১ সালে দুই বিষয়ে লেটার মার্কসসহ প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন৷ ১৯৪৩ সালে আনন্দমোহন কলেজ থেকে কৃতিত্বের সাথে প্রথম বিভাগে আইএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন৷ তারপর ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে এবং ১৯৪৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে কৃতিত্বের সাথে বিএ. (অনার্স) পাস করেন। ১৯৪৭ সালে এমএ এবং ১৯৫৩ সালে এলএলবি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।

ছাত্রজীবন থেকেই তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। ১৯৪৬-৪৭ সালে সলিমুলাহ মুসলিম হল সংসদের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন৷ সৈয়দ নজরুল ইসলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিকেট ও হকি টীমের ক্যাপ্টেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) ক্রীড়া সম্পাদক ছিলেন। ১৯৪৭ সালে তিনি মুসলিম ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হন ৷ ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের সময় তিনি সর্বদলীয় অ্যাকশন কমিটির -এর সদস্য হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম ১৯৪৯ সালে পাকিস্তান সেন্ট্রাল সুপিরিয়র সার্ভিস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তিনি সরকারের কর বিভাগে অফিসার পদে যোগ দেন। ১৯৫১ সালে সরকারি চাকুরিতে ইস্তফা দিয়ে তিনি ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজে ইতিহাসের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন।

পরে ১৯৫৫ সালে ময়মনসিংহে আইনজীবী হিসেবে যোগদান করেন৷ ১৯ মার্চ ১৯৭১ ঢাকায় বঙ্গবন্ধু ও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার মধ্যে অনুষ্ঠিত বৈঠকে সৈয়দ নজরুল ইসলাম ছিলেন বঙ্গবন্ধুর অন্যতম সহযোগী এবং ২৫ মার্চ বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তারের পর সৈয়দ নজরুল ইসলাম দলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

তাজউদ্দীন আহমদ, বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ও স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম নেতা। একজন সৎ ও মেধাবী রাজনীতিবিদ হিসেবে তাঁর পরিচিতি ছিল। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে তিনি বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী হিসাবে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। তাজউদ্দীন আহমদের পড়াশোনা শুরু বাবার কাছে আরবি শিক্ষার মাধ্যমে এবং পবিত্র কোরআনের হাফেজ ছিলেন। স্কুলে তাজউদ্দীন আহমদ বরাবরই প্রথম স্থান অর্জন করেছেন। ষষ্ঠ শ্রেণির এমই স্কলারশিপ পরীক্ষায় তিনি ঢাকা জেলায় প্রথম স্থান অধিকার করেন। ১৯৪৪ সালে তিনি ম্যাট্রিক পরীক্ষায় অবিভক্ত বাংলার সম্মিলিত মেধাতালিকায় দ্বাদশ স্থান লাভ করেন এবং পরে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় জগন্নাথ কলেজ থেকে অবিভক্ত বাংলার সম্মিলিত মেধাতালিকায় চতুর্থ স্থান লাভ করেন।

Advertisement

অতঃপর ১৯৫০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়থেকে অর্থনীতিতে বি.এ (সম্মান) ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬৪ সালে রাজনৈতিক বন্দী হিসেবে কারাগারে থাকা অবস্থায় এলএলবি ডিগ্রির জন্য পরীক্ষা দেন এবং পাস করেন। পেশায় তিনি একজন আইনজীবী ছিলেন।তাঁর সম্পর্কে ভুট্টো বলেছিলঃ“আলোচনা বৈঠকে মুজিবের পেছনে ফাইল বগলে চুপচাপ যে নটোরিয়াস লোকটি বসে থাকে তাঁকে কাবু করা শক্ত। দিস তাজউদ্দীন, আই টেল ইউ, হি উইল বি আওয়ার মেইন প্রবলেম।"

এম মনসুর আলী, মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রী ও বঙ্গবন্ধু কর্তৃক বাকশাল প্রতিষ্ঠার পর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। একজন নির্লোভ, সৎ ও দেশপ্রেমিক নেতা হিসেবে তার পরিচিতি ছিল। সিরাজগঞ্জ বিএল হাইস্কুলে হতে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন৷ এরপর পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ হতে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন৷ এরপর ১৯৪১ সালে প্রখ্যাত কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ থেকে বিএ পাস করেন। এরপর ভর্তি হন আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো নাম করা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে৷ ১৯৪৫ সালে এখান থেকেই অর্থনীতিতে এমএ পাস করেন এবং এলএলবি- তে প্রথম শ্রেণী লাভ করেন।

১৯৪৮ সালে পিএল জি’র ক্যাপ্টেন পদে অধিষ্ঠিত হয়ে তিনি যশোর ক্যান্টনমেন্টে প্রশিক্ষণ নেন। এ সময় থেকেই তিনি ‘ক্যাপ্টেন মনসুর’ নামে পরিচিত হন। ১৯৫১ সালে আইন পেশা শুরু করেন পাবনা জেলা আদালতে৷ আইনজীবী হিসেবে তিনি ছিলেন একজন সফল ব্যক্তি৷ পাবনা আইনজীবী সমিতির নির্বাচিত সভাপতিও ছিলেন তিনি। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর মনসুর আলীকে খন্দকার মোশতাক প্রধানমন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। ঘৃণাভরে সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে এম মনসুর আলী বলেছিলেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রী হতে চাই না। জীবন দেব, তবুও তোমার মতো বেইমানের সঙ্গে হাত মেলাব না।’

এএইচএম কামারুজ্জামান, তিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধচলাকালীন সময়ে গঠিত অস্থায়ী সরকারের স্বরাষ্ট্র, কৃষি এবং ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী ছিলেন। একজন বিচক্ষণ, সৎ ও দেশপ্রেমিক নেতা ছিলেন। লেখাপড়ার শুরু রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলে, পরে চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হয়ে ১৯৪২ সালে মাধ্যমিক পাশ করেন। এরপর ১৯৪৪ সালে রাজশাহী কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন।

এবার তিনি উচ্চশিক্ষার জন্য কলকাতা গমন করেন এবং বিখ্যাত প্রেসিডেন্সী কলেজ থেকে ১৯৪৬ সালে অর্থনীতিতে অনার্স পাশ করেন। এরপর তিনি রাজশাহী আইন কলেজ হতে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করে ১৯৫৬ সাল থেকে রাজশাহী জর্জকোর্টে আইন ব্যবসা শুরু করেন। ১৯৭৪ সালের ১৮ জানুয়ারি তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হলে দলকে সরকার থেকে পৃথকীকরণ ও সুসংহত করার লক্ষে মন্ত্রী পরিষদ থেকে পদত্যাগ করেন।

এ মহান নেতারা শুধু বঙ্গবন্ধুর আজীবন সহচর ছিলেন না মরণেও তাঁর সহযাত্রী হয়েছেন। স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর খন্দকার মুশতাক চক্র চার নেতাকে তাদের সাথে যোগ দেবার আহবান জানায়। কিন্তু এই ঘৃণিত প্রস্তাবে রাজী না হওয়ায় তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়। ২ রা নভেম্বর রাতে মুশতাক সরকারের বিরুদ্ধে পাল্টা অভ্যুত্থানের পরপরই বঙ্গবন্ধুর ঘাতকেরা কারাগারে ঢুকে জাতিকে নেতৃত্বশূন্য করার মহাপরিকল্পনা হিসাবে কারাগারের নিরাপত্তা বেষ্টনির ভিতরে ঢুকে চার নেতাকে প্রথমে গুলি করে পরে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। সমাপ্তি ঘটায় স্বাধীনতার উজ্জ্বল আলোকিত অধ্যায়ের।

সর্বোপরি ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত আদর্শিক জাতীয় চার নেতার শিক্ষাগত যোগ্যতা, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, সাংগঠনিক দক্ষতা ও সার্বিক গ্রহণযোগ্য নেতৃত্বই প্রত্যেক রাজনৈতিক ব্যক্তির জন্য অনুসরণীয় ও অনুপ্রেরণার উৎস। তাদের সাথে আজকে যারা রাজনীতি করছেন বা করবেন, এই দুইয়ের মাঝে একটি মেলবন্ধন দরকার। প্রয়োজনে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ওয়ার্কশপ, সেমিনার আয়োজন করে তাদের সেই অভিজ্ঞতা, ভাবনা, আদর্শ, অনুশীলন, সাফল্য, ব্যর্থতা সব বিষয়ে জানা ও চর্চা করা, অনুসরণ করা।

লেখক: ডেপুটি এটর্নি জেনারেল, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ ওআইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট।

এইচআর/এমকেএইচ