পহেলা বৈশাখে হালখাতা করা পুরান ঢাকার শাঁখারিবাজার ও তাঁতীবাজারের ব্যবসায়ীদের মধ্যে একটি রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বছরের পর বছর ধরে বৈশাখের দিন হালখাতা করে আসছেন এ অঞ্চলের স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা। পহেলা বৈশাখ ও হালখাতা নিয়ে রয়েছে দুই রকম মত। এক শ্রেণির ব্যবসায়ী সম্প্রদায় ১৪ এপ্রিল এবং আরেক শ্রেণি ১৫ এপ্রিল হালখাতা ও পহেলা বৈশাখ পালন করেন।
Advertisement
যুগের পর যুগ ধরে এভাবে হালখাতা পালন করা হলেও এখন এই রীতি থেকে বেরিয়ে আসতে চান শাঁখারিবাজার ও তাঁতীবাজারের ব্যবসায়ীরা। হিন্দু, মুসলিম সব ধর্মের ব্যবসায়ীরাই চাচ্ছেন সরকার থেকে হালখাতার একটি নির্দিষ্ট তারিখ নির্ধারণ করে দেয়া হোক।
রোববার শাঁখারিবাজার ও তাঁতীবাজারের অন্তত অর্ধশতাধিক ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে এমন অভিমত পাওয়া গেছে। তাদের দাবি, দুই দিনে হালখাতা হওয়ার কারণে ব্যবসায়ীদের বেশকিছু সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। একদিন হালখাতা হলে এসব সমস্যা হবে না।
সরেজমিনে পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী শাঁখারিবাজার ও তাঁতীবাজার ঘুরে দেখা যায়, এক শ্রেণির ব্যবসায়ীরা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ধুয়ে-মুছে পরিচ্ছন্ন করে তুলেছেন। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে নতুন করে রঙ করা হচ্ছে। আরেক শ্রেণির ব্যবসায়ীরা ফুল দিয়ে দোকান সাজিয়ে হালখাতা করতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। আর তাদের খরিদ্দাররা বকেয়া পরিশোধ করছেন।
Advertisement
আজ যে কয়টি প্রতিষ্ঠান হালখাতা করছে তার মধ্যে একটি প্রতিষ্ঠান হলো শরীফ জুয়েলার্স। দুপুরে প্রতিষ্ঠানটিতে ক্রেতাদের বেশ ভিড় দেখা যায়। ফলে ব্যস্ত সময় পার করতে হয় প্রতিষ্ঠানটির কর্মীদের। ভিড়ের মধ্যে ক্রেতারা তাদের পছন্দের জুয়েলারি সামগ্রী কিনেন। পণ্য কিনলে তাদের হাতে তুলে দেয়া হয় মিষ্টির প্যাকেট।
প্রতিষ্ঠানটির মালিক হাজী ইউসুফ শরীফ জাগো নিউজকে বলেন, এ বছর হালখাত বেশ ভালো হচ্ছে না। আগের বছর এর থেকে ভালো হালখাতা হয়েছিল। তার আগের বছর আরও ভালো হয়েছিল।
হালখাতা খারাপ হওয়ার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখন মানুষের ব্যবসা ভালো যাচ্ছে না। ব্যবসা ভালো না হলে মানুষ স্বর্ণের অলঙ্কার কিনবে কিভাবে? চাকরিজীবীরা সাধারণত স্বর্ণের জিনিস কম কেনে। ব্যবসায়ীরাই স্বর্ণ বেশি কেনে।
দুই সম্প্রদায় দুই দিন হালখাতা করার বিষয়ে এই ব্যবসায়ী বলেন, আমরা যারা মুসলিম তারা আজ পহেলা বৈশাখ ও হালখাতা পালন করি। কিন্তু হিন্দু ব্যবসায়ীরা আগামীকাল হালখাতা করবেন। দুই দিনের হালখাতার এ রীতি বন্ধ করা উচিত। দুইদিন হালখাতা হলে আমাদের অনেক সমস্যা হয়। আমরা চাই সব ব্যবসায়ী একদিনে হালখাতা করুক। এ জন্য সরকার থেকে একটি তারিখ নির্ধারণ করে দেয়া উচিত।
Advertisement
হালখাতা করা আরেক স্বর্ণ ব্যবসায়ী মো. আতিকুল ইসলাম বলেন, আমরা সরকারি নিয়ম মেনে আজ পহেলা বৈশাখ পালন করছি। আর পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে হালখাতা করছি। কিন্তু এখানকার বেশিরভাগ ব্যবসায়ী আগামীকাল হালখাতা করবেন। একই জায়গায় ব্যবসা করে হালখাতার দু’রকম রীতি এটা খুব একটা ভালো দেখায় না। সবাই মিলে একসঙ্গে হালখাতা করলে ভালো হতো।
এদিকে সনাতন ধর্মাবলম্বী ব্যবসায়ীরা রোববার পহেলা বৈশাখ ও হালখাতার সব প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন। এ লক্ষ্যে তারা তাদের দোকান ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করছেন। কেউ কেউ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে নতুন রঙও করেছেন।
নিতাই চন্দ্র নামের সনাতন ধর্মাবলম্বী এক ব্যবসায়ী বলেন, আগে আমরা সবাই একইদিনে অর্থাৎ ১৫ এপ্রিল হালখাতা ও পহেলা বৈশাখ করতাম। কিন্তু এখন কোনো কোনো ব্যবসায়ী ১৪ এপ্রিল হালখাতা ও পহেলা বৈশাখ পালন করছে। এখানে বিভিন্ন ধর্মের লোক রয়েছে। আমরা যারা হিন্দু ধর্মের তারা বরাবরের মতো আগামীকাল পহেলা বৈশাখ ও হালখাতা করব। তবে কেউ কেউ সরকারি নিয়ম মেনে আজ পহেলা বৈশাখ ও হালখাতা করছেন।
এই ব্যবসায়ী বলেন, আগে যখন আমরা একইদিনে হালখাতা করতাম তখনকার পরিবেশ ছিল খুব সুন্দর। এখনো এখানকার ব্যবসায়ীদের মধ্যে পারস্পরিক ভালো সম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু দুই শ্রেণি দু’দিন হালখাতা করার কিছুটা খারাপ লাগে। সবাই মিলে একদিনে হালখাতা করতে পারলে ভালো হতো।
তিনি আরও বলেন, একই জায়গায় ব্যবসা করার পর একদল আজ হালখাতা করবে, আর আমরা লৌকিক আচার অনুযায়ী চৈত্র সংক্রান্তি বা বিদায় উৎসব পালন করব। তবে যে দিনই হালখাতা ও চৈত্র সংক্রান্ত হোক সবার উদ্দেশ্যই এক। তাহলে ধুয়ে-মুছে পুরাতন বছরের সব জঞ্জাল বিদায় করা এবং ভালোকিছুর প্রত্যাশায় নতুন বছরের নতুন খাতা খোলা।
পি সি চন্দ্র জুয়েলার্সের গনেশ সরকার বলেন, আমরা গনেশ পূজার ওপর নির্ভর করে হালখাতা করি। সে হিসাবে আজ নয় আমাদের হালখাতা হবে আগামীকাল। আমাদের এখানে সাত হাজারের ওপরে স্বর্ণ ব্যবসায়ী আছেন। এদের বেশিরভাগ আগামীকাল হালখাতা করবে। কিন্তু কিছু কিছু ব্যবসায়ী আজ হালখাতা করছে। দেখতে একটু খারাপ লাগলেও কিছু বলার নেই। যার যার রীতি সে তাই করবে। তবে সবাই মিলে একদিনে হালখাতা করতে পারলে আনন্দ অনেক বেশি হতো।
স্বর্ণের আর এক ব্যবসায়ী মাধব বলেন, আমরা ‘লোকনাথ পঞ্জিকা’ নামে এক বিশেষ ধরনের পঞ্জিকা অনুসরণ করি। এ পঞ্জিকা অনুযায়ী আজ চৈত্র সংক্রান্তি। তাই আজ আমরা চৈত্র সংক্রান্তির পালন করব। আমাদের সব থেকে আকর্ষণীয় উৎসবটি আজ সন্ধ্যায় সূর্য ডোবার পরপরই শুরু হবে। সাম্প্রদায়িক গণ্ডি অতিক্রম করে এ উৎসবে একাকার হয়ে যান হিন্দু-মুসলিম সবাই।
হালখাতার বিষয়ে তিনি বলেন, যেহেতু আজ আমাদের চৈত্র সংক্রান্তি, তাই আমরা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ধুয়ে-মুছে বিগত বছরের সব জঞ্জাল দুর করবো। আর আগামীকাল খোলা হবে হিসাবের নতুন খাতা। বিগত বছরের খরিদ্দাররা বকেয়া পরিশোধ করবেন। আমরা তাদের মিষ্টি মুখ করাবো। এছাড়া বিভিন্ন আপ্যায়ন তো থাকবেই। সেইসঙ্গে নগদ কিছু ছাড়ও থাকবে। এই হালখাতা করার মূল উদ্দেশ্য হলো খরিদ্দারের সঙ্গে টেকসই সামাজিক সম্পর্ক গড়ে তোলা।
এমএএস/জেএইচ/এমএস