ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) গুলিতে নিহত বাংলাদেশি কিশোরী ফেলানী হত্যার ক্ষতিপূরণ বাবদ ৫ লাখ রুপি দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ভারতের মানবাধিকার কমিশন সোমবার এ ক্ষতিপূরণের অর্থ দেয়ার নির্দেশ দেন। বাংলাদেশস্থ ভারতীয় হাইকমিশনের মাধ্যমে ফেলানীর পরিবারকে এ অর্থ প্রদানে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। একদিকে ফেলানী হত্যার দায়ে অভিযুক্ত বিএসএফ সদস্য অমিয় ঘোষকে বিচারে নির্দোষ ঘোষণা করা অন্যদিকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। এই স্ববিরোধিতার মানে কী? বিশ্লেষণকদের মতে, এর মধ্য দিয়ে একটি সত্য প্রাথমিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হল যে, ভারতীয় বিএসএফ কর্তৃক ফেলানী হত্যার শিকার হয়েছে। যার কারণে ক্ষতি পুষিয়ে দেয়ার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আর্থিক ক্ষতিপূরণের নির্দেশ তারা দিয়েছে। একই সঙ্গে এর ভিতর দিয়ে আসামির উপর ফৌজদারী দায় যে যুক্তিগ্রাহ্য তা নতুন করে প্রমাণিত হল। ফলে শুধু ক্ষতিপূরণ নয় ফেলানী হত্যার দায়ে দোষী ব্যক্তির শাস্তিই স্বজনদের ক্ষোভ ও বেদনা কিছুটা হলেও প্রশমিত করতে পারে। ২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি ফেলানী খাতুন বাংলাদেশ ভারত সীমান্তে বিএসএফ সদস্য অমিয় ঘোষের গুলিতে নির্মমভাবে নিহত হয়। এ ঘটনার পর বিএসএফ তার আদালতে অমিয় ঘোষকে অভিযুক্ত করে একটি অভিযোগ গঠন করে। ২ বছর ৮ মাস পর ২০১৩ সালের ৬ সেপ্টেম্বর অভিযুক্ত অমিয় ঘোষকে নির্দোষ রায় দেন বিএসএফ এর আদালত। এটিকে একটি প্রহসনের বিচার বলে মনে করে বাংলাদেশের মানুষ।এই রায় যর্থার্থ মনে করেননি বিএসএফ মহাপরিচালক। তিনি রায় পুনর্বিবেচনার আদেশ দিয়েছিলেন। এরপর ২ জুলাই ২০১৫ বিএসএফ কোর্ট অভিযুক্ত অমিয় ঘোষকে নির্দোষ বলে পুনরায় রায় দেন। এ রায়ে হতভম্ব হন ফেলানীর বাবা। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, অমিয় ঘোষ ফেলানীকে গুলি করে হত্যা করার কথা আদালতে স্বীকার করে। তারপরও নির্দোষ প্রমাণিত হওয়ায় সবাই বিস্মিত ও মর্মাহত হয়।সীমান্তে নির্বিচারে বাংলাদেশিদের হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশ ভারত-সম্পর্কের একটি নাজুক দিক। দু’টি দেশের সম্পর্কোন্নয়নের ক্ষেত্রেও এটি এক বড় বাধা। সেক্ষেত্রে ফেলানী হত্যার সুষ্ঠু বিচার সীমান্ত হত্যা বন্ধে একটি কার্যকর ভূমিকা রাখত। এই হত্যাকাণ্ডকে ঘিরে শুধু বাংলাদেশ নয় ভারতেও ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। সেখানকার মানবাধিকার সংস্থাগুলোও এর জোরালো প্রতিবাদ জানিয়েছে। এবার তো ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথাও বলছে ভারতীয় মানবাধিকার কমিশন। ফেলানী হত্যা কেবল বাংলাদেশি দরিদ্র পরিবারের একজন কিশোরীকে হত্যা নয়, বরং এর মধ্য দিয়ে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মনস্তাত্ত্বিক দিকটিও উন্মোচিত। সীমান্তে কাঁটাতারে ঝুলে থাকা ফেলানীর মৃতদেহ তোলপাড় সৃষ্টি করে বিশ্ব গণমাধ্যমে। ভারত সরকারের উচিত ছিল এই ধরনের ন্যক্কারজনক হত্যাকোণ্ডের সুষ্ঠু বিচার করা। বিচারের ব্যাপারে সদিচ্ছা থাকলে সেটি হওয়া উচিত ছিল ফৌজদারি আদালতে, বিএসএফের নিজস্ব আদালতে নয়। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। অভিযুক্ত বিএসএফ সদস্য দোষ স্বীকার করেও নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে ফেলানীকে হত্যা করলো কে? ভারতের মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চ (মাসুম) ভারতের সুপ্রিম কোর্টে গত ১৪ জুলাই ফেলানীর বাবার অনুরোধে একটি রিট মামলা দায়ের করে। ২৬ আগস্ট ভারতের দিল্লীর সুপ্রিম কোর্ট এ মামলা শুনানির জন্য আগামী ৬ অক্টোবর তারিখ নির্ধারণ করেন। এরই মধ্যে মানবাধিকার সংস্থা স্বপ্রণোদিত হয়ে ৫ লাখ রুপি ক্ষতিপূরণের নির্দেশ দিল। একটি হত্যাকাণ্ডের ক্ষতিপূরণ আর্থিক মূল্যে বিচার্য হতে পারে না। ফেলানীর মা-বাবাও একই কথা বলছেন। তারা অর্থ চান না। দোষী ব্যক্তির শাস্তিই তাদের একমাত্র চাওয়া। আইনের দৃষ্টিতেও ফেলানী হত্যার ন্যায়বিচার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ ব্যাপারে মানবাধিকার সংস্থা মাসুম যে রিট করেছে সেখানে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা পেলে বাংলাদেশের মানুষ স্বস্তি পাবে। এবং সেটা হবে সম্পর্ক উন্নয়নে ভারতের সদিচ্ছার প্রকাশ।এইচআর/এমএস
Advertisement