আচ্ছা, আপনাকে কি কেউ কখনো এভাবে বলেছেন, তোমার কি অটিজম আছে? আছে কি? যদিও দেখতে তুমি একেবারে স্বাভাবিক।
Advertisement
হয়তো কেউ কখনো বলেননি, তাতেই কি আপনি নিশ্চিত হতে পারছেন যে আপনার সত্যিই অটিজম নেই। হুইল চেয়ারে বসা বা ক্রাচে ভর দেওয়া মানুষ দেখলেই নিশ্চিতভাবে যে বলি, উনি-তিনি ডিজ্যাবল, তা কি ঠিক? ছেলেপুলে নিয়ে ঘুরতে বের হওয়া দম্পতিদের পারিবারিক ছবি দেখে ধরা না গেলেও হতে তো পারে, এদের কেউ না কেউ ডিজ্যাবল। সব অক্ষমতা কিন্তু হুইল চেয়ার চড়ে না, কোন কোন অক্ষমতা স্বাভাবিক মানুষের সাথেই ঘুরে বেড়ায়, একেবারে সেই মানুষটার ছায়ার মতো।
কেরি মারগো একজন বিখ্যাত বক্তা, যিনি অটিজম স্পেকট্রাম নিয়ে সম্মানীর বিনিময়ে বক্তৃতা দেন। ব্লুমবার্গ রেডিও, বিবিসি নিউজ, ইয়াহু প্যারেন্টিং, আমেরিকান এক্সপ্রেস, টেডএক্স-এর মতো বিশ্বখ্যাত ব্রান্ড কেরি মারগোকে বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজে লাগায়। কেরি মারগোর বয়স যখন মাত্র চার, তখন কেউ একজন তার দিকে চোখ রেখে তার বাবা-মাকে শুনিয়ে এরকম কথা বলেছিলেন। বাবা-মা দেরি করেননি। পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ধরা পড়ে, ছোট্ট কেরি অটিজম স্পেকট্রামের ভয়াবহ ধাপে অবস্থান করছে।
তিন বছর না হওয়া পর্যন্ত কেরি প্রথম শব্দটি উচ্চারণ করতে পারেনি। নিজের কণ্ঠস্বর খুঁজে বের করতে বা চিনতে তার বহু বছর লেগেছিল। কেরির বাবা-মা আর সব বাবা-মায়ের মতোই খুব চিন্তায় পড়ে গেলেন ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে। গান, থিয়েটার, অকুপেশনাল থেরাপি, শারীরিক ও বাচনিক থেরাপি কেরি মারগোর উন্নয়নে বিরাট ভূমিকা রেখেছিল। জীবনের অসংখ্য চ্যালেঞ্জকে হারিয়ে আজকের কেরি মারগো নিজেকে পরিণত করেছেন স্বাভাবিক মানুষের জন্যও উদাহরণ হিসেবে।
Advertisement
এখন যখন মানুষজন একজন পেশাদার বক্তা ও লেখকের সামনে দাঁড়ায়, তাদের নিশ্চিন্ত হাবভাব দেখে বোঝা যায়, তারা মোটও ভাবছে না যে তাদের সামনে একজন অটিজমবাহী মানুষ আছেন এবং তারা বুঝতেই পারছে না যে এই মানুষটিকে প্রতিরোধ জয় করে যেতে হয় এখনো, তখন তিনি বুঝতে পারেন, তার কাজ এখনো শেষ হয়নি। তিনি যে এখনো যুদ্ধ করছেন এবং নিজেকে সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে বদলাতে চাইছেন, নিজের সাথে নিজে বন্ধুত্ব করতে চাইছেন, তা বোঝানোই তার কাজ হয়ে যায়।
প্লেনে ওঠার পর প্লেন যখন আকাশে ওড়ার প্রস্তুতি নেয়, তখন অটিজম থাকা মানুষ হিসেবে নিজের অনুভ‚তির সাথে যুদ্ধ করে অবশেষে যখন তিনি কাউকে টের পেতে দেন না তার ভেতরে কি ঘটছে, তখন মনে হয়, সত্যিই জিতে গেছেন তিনি। কিন্তু এই যুদ্ধটা তো মিথ্যে নয়। তাই তিনি কেএফএম মেকিং আ ডিফেরেন্স নামের একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। এই প্রতিষ্ঠানটি অটিজমের শিকার শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষা গ্রহনে আর্থিক থেকে শুরু করে সব ধরনের সহায়তা দেয়।
কেরি মারগোর মতো অদৃশ্য অক্ষমতা বয়ে বেড়াচ্ছি কি আমিও? আপনি? তিনি? সমাজের সবাই কিন্তু সমান নন, কারোর কারোর একটু বেশি সাহায্য প্রয়োজন। কারোর সাহায্য প্রয়োজন কি না, তা কি আমরা বুঝতে পারি? বুঝতে পারার পর সত্যিই কি আমরা এগিয়ে যাই? অটিজম নিয়ে কথা বলছি কিছুটা, কিন্তু আরো যেসব অক্ষমতা আছে, যেমন মনোযেগ দিতে না পারার অক্ষমতা বা অ্যাটেনশন ডেফিসিট ডিজঅর্ডার (এডিডি), অ্যাটেনশন ডেফিসিট হাইপার অ্যাকটিভিটি ডিজঅর্ডার (এডিএইচডি), শেখার অক্ষমতা বা ডিজলেক্সিয়া ইত্যাদি।
চোখে দেখা না যাওয়া এই অক্ষমতা কাউকে কাউকে খুব অসহায় করে রাখছে, কারোর জীবন হয়ে উঠছে দুর্বিষহ। বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে এরকম হলে কষ্ট তো দ্বিগুণ। নিজে পারছে না, সেই অক্ষমতার সাথে যোগ হয় বাবামায়ের হতাশা। শিক্ষাকে ব্যবসা বানিয়ে ফেলা এখনকার সমাজে জিপিএ ফাইভ ছাড়া আর কিছু তো চলে না। যে শিশুটি জিপিএ ফাইভ পাচ্ছে না, তার অবস্থা কি অটিজম আক্রান্ত শিশুর মতো দৃশ্যমান অক্ষম শিশু এবং অদৃশ্য অক্ষমতায় আক্রান্ত শিশুর অবস্থার খুব বেশি ফাঁরাক আছে? কেন পারছে না, তা যাচাই করতে হবে, এই শিক্ষাটা আমাদের মাঝে পুরোপুরি কি এসেছে? আসেনি কিন্তু।
Advertisement
আমরা এখনো ভাবতে শিখিনি, যে যে অবস্থানে আছি, সেই অবস্থান থেকে নিজেকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াটাই জীবনের মূলমন্ত্র। সবার সাথে তাল মেলানো নয়, নিজের কদম আরো পোক্স করতে পারার চেষ্টা করতে হবে। চ্যালেঞ্জ করতে হবে নিজের সাথে। এবার পারিনি, সামনের বার পারব কি না সেই চেষ্টা করতে হবে। তাহলে অটিজম আক্রান্ত শিশুর চেষ্টা আর চোখে পীড়া দেয় না। যে শিশুটি পিছিয়ে আছে, তার অক্ষমতার কারন খুঁজতে উদ্যোহী হবো আমরা। এই পৃথিবী নামক গ্রহে সবচেয়ে ভালো ভাবে কীভাবে বাঁচা যায়, সেই চেষ্টা আমার জন্যও তো প্রযোজ্য। কেননা, আমি কি নিশ্চিতভাবেই শতভাগ সক্ষম? কোন প্রকারের অক্ষমতা কি আমার নেই?
কেরি মারগো কথা বলেন স্কুল-কলেজে, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে, সরকারি-বেসরকারি এজেন্সিতে, লাভজনক-অলাভজনক প্রতিষ্ঠানে, অভিভাবকদের গ্রুপে এবং বিশেষ বিশেষ আয়োজনে। তার আলোচনার সীমারেখায় থাকে অনেক বিষয়। চাকরির সমস্যা কোন্ অক্ষমতার কারনে ঘটছে ও এর সমাধান কি, শিক্ষণ-অক্ষমতা নিয়ে কলেজের পরীক্ষায় কীভাবে ভাল করা যাবে, মিথস্ক্রিয়ায় অক্ষমতা বলে সহজে অন্যের সাথে মিশতে না পারার সমস্যার সমাধান, অটিজম নিয়ে কতটা ভালভাবে বাস করা যায়, স্কুলে বুলি ঠেকানোর উপায়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সবচেয়ে ভাল চর্চা কীভাবে করা যেতে পারে ইত্যাদিকে তিনি উদ্ভাবনী কৌশলে আর উপর্যুপরি চর্চার মাধ্যমে কাটিয়ে ওঠার উপায় বাতলে দেন।
কারোর ডিজাবিলিটি আছে কি না, তা বোঝার সবচেয়ে ভাল উপায় হচ্ছে ডিজাবল মানুষকে ভালভাবে জানা। অটিজম নিয়ে জানতে চাইলে অটিজম আক্রান্ত মানুষটির কাছে যাওয়া উচিত। এতে যদি মনে হয়, অটিজম কম্যুনিটির সদস্য হয়ে গেলাম না তো, তাহলে হা হা করে হেসে নিন। সত্যি বলতে কি, অটিজম সম্বন্ধে পড়ে ফেলা খুব সহজ। কিন্তু এর সাথে বসবাস করা কিন্তু সম্পূর্ণ অন্য গল্প। আর আমরা যে সমাজ বা কম্যুনিটিতে বাস করছি, তাতে অসংখ্য মানুষ অটিজমের সাথে বসবাস করছেন বলে এই সমাজ বা কম্যুনিটিকে অনায়াসে আপনি অটিজম কম্যুনিটি বলতে পারেন।
আর অটিজমের কথা যদি আলাদাভাবে না বলি, তবে অন্য সব ডিজ্যাবিলিটির কথা ধরলে আমাদের সমাজটা কি ডিজাবল সমাজ নয়? শারীরিক নানা অক্ষমতা চোখে দেখা যায় বলে কেবল এদেরকে আলাদা করে তৃপ্তির ঢেুঁকর তোলার উপায় নেই। আমরা কেউ শিক্ষণ-অক্ষমতায় ভুগছি, কেউ মানসিক-অক্ষমতা বা আচরণগত অক্ষমতায় ভুগছি। এবং ভাবছি, এই বেশ ভাল আছি!
২০০৭ সালের অন্যতম বেস্ট সেলিং বই, জন এল্ডার রবিসনের লুক মি ইন দ্য আই প্রকাশিত হয়। জন এন্ডার অটিজম নিয়ে বড় হয়েছেন। একজন অটিজম আক্রান্ত ব্যক্তির জীবকাহিনী বিশ্বজুড়ে অসংখ্য মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছে নিজেদের লড়াইয়ের কথা প্রকাশ্যে বলার জন্য। ২০১০ সালে এইচবিও মুক্তি দেয় টেম্পল গ্রান্ডিন চলচ্চিত্রটি। ক্লেয়ার ডেনিস অভিনীত এই চলচ্চিত্র আসলে ড. টেম্পল গ্রান্ডিন নামের বিখ্যাত পশু ডাক্তারের জীবনকাহিনী, যিনি জীবনের প্রায় শুরুতেই জেনে ফেলেছিলেন, তিনি অটিজমে আক্রান্ত। বেশ কয়েকটা এমি অ্যাওয়ার্ড পাওয়া ছবিটি উদ্বুদ্ধ করেছে ডিজাবল মানুষদেরকে বিনোদন দুনিয়ার বিষয় বানিয়ে ফেলতে।
কাজেই, এর পর যদি অটিজম নিয়ে বাস করা কোন মানুষের সাথে কখনো দেখা হয়, তার সাথে কথা বলুন, জেনে নিন তার জীবনের অভিজ্ঞতাগুলো। যদি কোন শিশুকে দেখেন, খুব সহজ কোন বিষয় বুঝতে পারছে না, তবে রাগারাগি বা বকাঝকা করবেন না। বুঝতে চেষ্টা করুন, শিখতে সমস্যা হয় কি না ওর। মুখচোরা সন্তানকে লক্ষ্মী-শান্ত-চুপচাপ-নিরিবিলি থাকতে চায় বলে ঝামেলাহীন আপনি তৃপ্তির শ্বাস না ফেলে দেখুন তো, ওর আচরণগত অক্ষমতা আছে কি না।
কখনো কখনো সহনশীলতার মাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়া অক্ষমতা জীবনকে জটিল করে ফেলতে পারে। আপনজনরাই পারে, সেই জটিলতার আভাস পেয়ে সহজ করে তোলার কৌশল করতে। সেই পারাটা সহজ নয়। তবে অন্যরা পারছেন, এটা জানতে পারলে সহজ হয়ে যায় অনেক কিছু। অক্ষমতাজয়ী মানুষদের সাফল্যের কথা, চ্যালেঞ্জ উতরে যাওয়ার গল্প অন্যদেরকে শেখায় সফল হতে, চ্যালেঞ্জ জয় করতে।
ফেসবুকের আবিষ্কর্তা মার্ক জুকারবার্গ সব রঙ দেখতে অক্ষম। তাতে তিনি থেমে থাকেননি। তিনি দেখতে পান নীল রঙ। সেই নীল রঙ দিয়ে তিনি কী সুন্দর সামাজিক যোগাযোগ কৌশলে গোটা দুনিয়াটাকে বেঁধে ফেলেছেন, দেখুন তো!
লেখক : কথাসাহিত্যিক।
এইচআর/এমকেএইচ