একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট গোলাম আরিফ টিপুকে একুশে পদক দেয়ার জন্য মনোনীত করা হয়েছে। ভাষা আন্দোলন ক্যাটাগরিতে তিনি এ পদক পাচ্ছেন। যে স্বীকৃতি আরও আগে পাওয়া উচিত ছিল সেটি এতদিন পরে পেয়েও তিনি খুশি বলে জাগো নিউজকে জানিয়েছেন।
Advertisement
গোলাম আরিফ টিপু বলেন, ৪৮ সালে রাজশাহী কলেজ থেকে ভাষা আন্দোলনের মিছিল শুরু করি। রাজশাহী কলেজ থেকে মেডিকেল কলেজ পর্যন্ত এই আন্দোলনের বিস্তৃতি ঘটেছিল। তারপর বহুদিন অতিবাহিত হলো। এ স্বীকৃতি পাওয়ার কথা ছিল আরও আগে। এখন পেলাম, এতে আমিও খুশি তোমরাও খুশি।
তিনি বলেন, আল্লাহর ইচ্ছায় মানুষের সঙ্গে ছিলাম বলে আজ সরকার আমাকে এ স্বীকৃতি দিয়েছে। আমি যে স্বীকৃতি পেয়েছি তার জন্য আল্লার কাছে কৃতজ্ঞ।
এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক ও অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মো. মোমতাজ উদ্দিন ফকির জাগো নিউজকে বলেন, ভাষা আন্দোলনের স্বীকৃতিস্বরূপ আইন অঙ্গন থেকে আইনজীবী গোলাম আরিফ টিপুকে একুশে পদক দেয়ার জন্য মনোনীত করায় আমরা আইনজীবীরা আনন্দিত। আইনজীবী সমাজের একজনকে রাষ্ট্রীয় পদক দিয়ে মূল্যায়ন করার জন্য সরকারের কাছে কৃতজ্ঞ।
Advertisement
তিনি বলেন, আমি আশা করব, ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতাযুদ্ধে অবদান রাখার জন্য ভবিষ্যতে যাতে আইনজীবীদের মধ্য থেকে মূল্যায়ন করা হয়। এ ধারাবাহিকতা যেন প্রতিবছর স্বাধীনতা পদক ও একুশে পদকে বহাল রাখেন, সরকারের কাছে এমন আশা করছি।
আরও পড়ুন >> একুশে পদক পাচ্ছেন ২১ বিশিষ্টজন
প্রবীণ আইনজীবী, রাজনীতিবিদ, ভাষাসৈনিক, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক গোলাম আরিফ টিপু ১৯৩১ সালের ২৮ আগস্ট চাঁপাইনবাবগঞ্জের কমলাকান্তপুরের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ছয় বোন তিন ভাইয়ের মধ্যে টিপু দ্বিতীয়। রাজশাহী কলেজে পড়ার সময় তিনি বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন এবং কারাভোগ করেন।
তিনি ছিলেন রাজশাহী ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের যুগ্ম-আহ্বায়ক। ছাত্রজীবন থেকেই বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ছাত্র রাজনীতির পাশাপাশি দেশের ফুটবল মাঠে একই সময় জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন।
Advertisement
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে প্রগতিশীল রাজনীতির সঙ্গে আরও সক্রিয় হন। পূর্বপাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম গোলাম আরিফ টিপু ১৯৫৩ সালে ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
সেসময় তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা দলের জনপ্রিয় ফুটবলার ছিলেন। আন্দোলন-সংগ্রামের কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত হয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম ব্যাচে ভর্তি হন এবং আইনে স্নাতক (সম্মান) ডিগ্রি লাভ করেন।
বাবা আফতাব উদ্দিন আহমদ জেলা রেজিস্ট্রার পদে সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিয়ে গ্রামের বাড়ি চলে গেলে আইন পেশায় যোগ দিয়ে পরিবারের হাল ধরেন টিপু। রাজশাহী আইনজীবী সমিতির একাধিকবার সভাপতি নির্বাচিত হন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ও সিন্ডিকেট সদস্য নির্বাচিত হন কয়েকবার। বাংলাদেশ বার কাউন্সিলেরও সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন একাধিকবার।
ছাত্রজীবন থেকেই রাজশাহী হয়ে ওঠে তার রাজনীতির তীর্থস্থান। মস্কোপন্থী ন্যাপ রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয় থেকে নব্বইয়োত্তর সময়ে রাজনীতি থেকে অবসর নেন।
তবে, গণমানুষের সঙ্গে সম্পৃক্ততা ছাড়েননি কখনো। স্থানীয় ও জাতীয় সব ইস্যুতে তিনিই সর্বজনশ্রদ্ধেয় হিসেবে সামনের কাতারে থেকেছেন। জীবনে বহুবার নানা প্রলোভন উপেক্ষা করেছেন। নিরহংকারী, নির্লোভ, সৎ, সাদামাটা জীবনের অধিকারী গোলাম আরিফ টিপু আদর্শচ্যুত হননি।
বহুল আলোচিত নীহারবানু হত্যা মামলায় ডিফেন্স আইনজীবী হিসেবে তার সুনাম ৭০’এর দশকে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। উত্তরবঙ্গসহ সারাদেশে অসংখ্য মামলায় তিনি ডিফেন্স আইনজীবী হিসেবে ভূমিকা রাখেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের হত্যা মামলায় ১৬০ ছাত্রনেতার হয়ে লড়ে খালাস করান।
জীবনে অনেক রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও গরিব মানুষের মামলা বিনা পারিশ্রমিকে করেছেন। মেজর জেনারেল মঞ্জু হত্যা মামলা এবং ওয়ান-ইলেভেনে আটক আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ডিফেন্স আইনজীবী হিসেবে তার যুক্তিতর্ক, বক্তব্য আদালতে উপস্থিত সবাইকে মুগ্ধ করে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র বিক্ষোভে আটক শিক্ষক-ছাত্রদের হয়েও আইনি লড়াই করেছেন এ ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ।
৫৯’এ চাঁপাইনবাবগঞ্জের মহারাজপুর চৌধুরীবাড়ির ডা. আবুল হোসেন চৌধুরীর বড় মেয়ে জাহানারা চৌধুরী লুইয়ের সঙ্গে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হন খ্যাতিমান আইনজীবী গোলাম আরিফ টিপু। চার কন্যা, এক পুত্র ও নাতি-নাতনি নিয়ে তাদের বিবাহিত জীবন অর্ধশতক পেরিয়েছে। আইনি পেশায়ও ৫০ বছর পার করেছেন বেশ আগে।
এখনো তারুণ্যের উদ্যম নিয়ে রাত জেগে বই পড়েন। মামলার নথি ঘাঁটেন। ক্লান্তি তাকে স্পর্শ করে না। আজীবন প্রচারবিমুখ, নিভৃতচারী গোলাম আরিফ টিপু দেশের সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অগ্রভাগে থেকেছেন। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন একসময়।
উল্লেখ্য, কণ্ঠশিল্পী সুবীর নন্দী, অ্যাডভোকেট গোলাম আরিফ টিপু, অভিনেত্রী সুবর্ণা মুস্তাফা, কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদানের জন্য ২১ বিশিষ্টজন চলতি বছর (২০১৯) একুশে পদক পাচ্ছেন।
গতকাল বুধবার সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে রাষ্ট্রীয় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পদকপ্রাপ্তদের তালিকা প্রকাশ করে। আগামী ২০ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আনুষ্ঠানিকভাবে একুশে পদক তুলে দেবেন।
এফএইচ/জেডএ/জেআইএম