নূর হোসেন মরেননি। আবার বেঁচেও নেই! নূর হোসেনের মারা যাওয়া আর বেঁচে থাকার দ্বন্দ্ব মেশানো দুটি বাক্যকে ভাবাবেগ মনে হতে পারে। ইতিহাস অবশ্য ভাবাবেগ আশ্রয়ী নয়। ইতিহাসে নূর হোসেন মৃত। আবার চেতনায় নূর হোসেন জীবিত। তাই দেয়াল লিখনে কিংবা দেয়ালের গায়ে সেঁটে দেয়া পোস্টারে নূর হোসেন বেঁচে আছেন।
Advertisement
একত্রিশ বছর আগে এক যুবক বুকে আর পিঠে লিখেছিলেন, গণতন্ত্র মুক্তিপাক। স্বৈরাচার নিপাত যাক। ‘নূর হোসেন জীবন্ত এক পোস্টার হয়ে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে রাজপথে নেমেছিলেন। গণতন্ত্রকে মুক্ত করার আকাঙ্খায়। স্বৈরাচারের পতন হয়েছিল। গণতন্ত্র এসেছিল। কিন্তু তার সেই আসা যেন ফেরারির মতো।
এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় ঘুরে বেড়ানো। তবে অত্যন্ত সন্তর্পণে! নূর হোসেনের গণতন্ত্র এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় আটকে গেলো। সেটা বার বার। স্বৈরাচারমুক্ত বাংলাদেশে মানুষ যে গণতন্ত্র দেখতে চেয়েছিল, তারা দেখলো ঠিক উল্টো! যার বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে প্রাণ দিলেন নূর হোসেনসহ অসংখ্য মানুষ, সেই লোকটাও এখন গণতন্ত্রের কথা বলেন!
অবশ্য তাকে দোষ দিয়ে আর লাভ কী! স্বৈরাচারকে রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত করার দায় নিতে হবে এদেশের রাজনীতিবিদদের। গণতন্ত্র মুক্ত হওয়ার পর যারা যখন ক্ষমতায় এসেছেন বা আসতে চেয়েছেন তারা সবাই এরশাদকে ব্যবহার করেছেন। ক্ষমতার ভাগ দিয়েছেন। আরও ক্ষমতাবান করার স্বপ্ন দেখিয়েছেন। আর সেই স্বপ্ন তিনি এখনো দেখছেন। তাই বলছেন; দেশের মানুষ নাকি আরও একবার এরশাদের সরকার দেখতে চায়!
Advertisement
মানুষ চান বা নাই চান, এরশাদ ক্ষমতায় ছিলেন। আছেন। সেটা কখনো পরোক্ষভাবে। কখনো প্রত্যক্ষভাবে। তাকে ক্ষমতায় দেখতে চাননি শুধু জয়নাল-দিপালী-সেলিম-দেলোয়ার- রউফুন বসুনিয়া- নূর হোসেন -জেহাদ- ডা. মিলনরা। কিন্তু তাদের চাওয়া না চাওয়া একেবারেই মূল্যহীন। অর্থহীন এক প্রসঙ্গ আজকের বাংলাদেশে।
একুশ শতকের বাংলাদেশে গণতন্ত্র রক্ষার অন্যতম অংশীদার হয়ে পড়েছেন গত শতাব্দীর স্বৈরাচার হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এবং তার দল। আবার নব্বইয়ে স্বৈরাচারের পতনের পর মুক্ত গণতন্ত্র যাদের হাতে পড়েছিল, তারা গণতন্ত্র চর্চার চেয়ে ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে উদ্যোগী হলেন। জনগণের ইচ্ছা-অনিচ্ছার চেয়ে ক্ষমতাই বড় কথা হয়ে দাঁড়ালো গণতন্ত্রের জন্য রাজপথে লড়াই -সংগ্রাম করা রাজনীতিবিদদের জন্য।
স্বৈরাচারের যারা পতন চেয়েছিলেন তারাই আবার ক্ষমতার হাত বাড়িয়ে দিলেন পতিত স্বৈরাচারকে টেনে তুলতে! তিনি উঠে দাঁড়ালেন। হয়তো কোমর সোজা করে দাঁড়াতে পারলেন না। তবে বাঁকা কোমর নিয়েও গণতন্ত্রের পূজারীদের পুতুলের মত নাচাতে পারছেন; সেটাই বা কম কী!
নূর হোসেন জীবন্ত পোস্টার হলেন। শহীদ হলেন। হয়তো মরে গিয়েই বেঁচে গেলেন। তাকে দেখতে হয়নি এরশাদ আপসহীন নেত্রীর পাশে। কিংবা তার জননেত্রীর পাশে। তারই হাতে নিয়োগ পাওয়া বিশেষ দূত হিসেবে! আপসহীন নেত্রীর চারদলীয় জোট সঙ্গী থেকে এরশাদ জননেত্রীর মহাজোট সঙ্গী! নূর হোসেন মুক্ত গণতন্ত্রে পতিত স্বৈরাচারের কি দারুণ রাজনীতি! আর গণতন্ত্রের জন্য লড়াই সংগ্রাম করা রাজনীতিবিদদের রাজনীতির কী কদর্য চেহারা এখন মানুষের সামনে।
Advertisement
আসলে নূর হোসেনের মুক্ত গণতন্ত্রে রাজনীতি এখন শুধুই পাটিগণিত নির্ভর অংক। আদর্শ- মূল্যবোধ-গণতান্ত্রিক চেতনা এগুলো এখন অর্থহীন। নূর হোসেন গণতন্ত্রকে এতটাই মুক্ত করে দিয়ে গেছেন, যে গণতন্ত্রে পতিত স্বৈরাচার সরকারেও থাকে। বিরোধী দলেও থাকতে পারে। জোটেও থাকে। মহাজোটেও থাকে।
নূর হোসের মারা গেছেন। তার চেতনাটা বেঁচে আছে। তাই এদেশের মানুষ এখনও গণতন্ত্র, গণতন্ত্র বলে চেঁচামেচি করেন। চিৎকার করেন। গণতন্ত্র রক্ষার কথা বলেন। সংবিধান রক্ষার কথা বলেন। কিন্তু ক্ষমতায় গিয়ে কেউ বলেন না; গণতন্ত্র চর্চার কথা। দলের মধ্যেও কেউ গণতন্ত্রের চর্চা করে দেখান না। অবশ্য চর্চার সুযোগও নেই। যে গণতন্ত্রকে আমরা মুক্ত বলছি, সে বার বার একজনের হাত থেকে আর একজনের হাতে গিয়ে বন্দি হচ্ছে।
যার হাত ছাড়া হয়ে যাচ্ছে তিনি আবার গণতন্ত্রকে মুক্ত করার কথা বলেছেন। স্লোগান দিচ্ছেন। পোস্টার লাগাচ্ছেন। শুধু ভুলে যান নূর হোসেন নামের সেই জীবন্ত পোস্টারের কথা।
অবশ্য ভুলে যাওয়াই ভালো। কারণ, মনে রাখলে গণতন্ত্র চর্চার জন্য অন্যদের জায়গা ছাড়তে হবে। মুক্ত গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা আর বেড়ে ওঠার জন্য পরিসর বৃদ্ধির কাজটা করতে অনীহা সবার। তারচেয়ে আহত, পঙ্গু, অগ্নিদগ্ধ গণতন্ত্রকে শ্রেয় মনে করেন এদেশের রাজনীতিবিদরা! নূর হোসেন আপনার জীবন উৎসর্গ করেছিলেন কী গণতন্ত্রের মুক্তির জন্য। না মুক্ত গণতন্ত্রের পঙ্গুত্বের জন্য।
লেখক: সিনিয়র জার্নালিস্ট ও কলাম লেখক।
এইচআর/এমআরএম/এমএস