লিবিয়ার সির্তে শহর থেকে জঙ্গি গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটকে উৎখাত করা হয়েছে প্রায় দু’বছর আগেই। কিন্তু এই লড়াইয়ে যাদের ফেলে যাওয়া হয়েছিল তাদের মধ্যে কিছু শিশুও ছিল। এদের মধ্যে অধিকাংশই আইএস-এ যোগ দেয়া নিহত বিদেশি যোদ্ধাদের সন্তান।
Advertisement
এদের মধ্যে অনেককেই নিজের দেশে আত্মীয়-স্বজনের কাছে ফিরিয়ে দেয়া হলেও এখনও প্রায় ২০ জন শিশু পশ্চিমাঞ্চলীয় মিসরাটা শহরেই রয়ে গেছে। সেখানে থাকা শিশুদের বয়স দুই থেকে ১৪ বছর।
লিবিয়ার গৃহযুদ্ধ থেকে এরা প্রাণে বেঁচেছে ঠিকই। কিন্তু সেই যুদ্ধের ক্ষত রয়ে গেছে তাদের দেহ আর মনে। সারা জীবন এই ক্ষত তাদের বয়ে বেড়াতে হবে। এই শিশুদের প্রায় সবার দেহে রয়েছে গভীর ক্ষত, পোড়া দাগ, আঘাতের চিহ্ন।আঘাতের কারণে ওই শিশুদের মধ্যে একজনের হাত কেটে ফেলা হয়েছে।
তাদের সময় কাটে টিভিতে কার্টুন দেখে, গান গেয়ে, নয়তো চোর-পুলিশ খেলে। এর বাইরে তাদের করারও কিছু নেই।এক বছর ধরে তারা এই অবস্থায়ই আছে।
Advertisement
এই শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে নজর রাখছেন মনোবিজ্ঞানী ফয়সাল। শিশুদের সাথে মাসের পর মাস দীর্ঘ আলাপ করার পর তিনি এই শিশুদের পরিচয় সম্পর্কে কিছুটা আঁচ করতে পেরেছেন। এদের সাথে প্রথম দেখা হওয়ার দিনটির কথা তিনি এখনও মনে করতে পারেন।
ফয়সাল বলেন, এই শিশুরা সব সময় প্যানিক অ্যাটাকে ভুগতো। তাদের ঘুম হতো খুবই কম। এরা যখন তখন প্রস্রাব করে ফেলতো। তারা কথা বলতে চাইতো না। তারা একা একা থাকতে চাইতো।
এই আশ্রয় শিবিরের বেশিরভাগ শিশুই মিসরীয়। এদেরই একজন জুমানা। দশ বছর বয়সী এই মেয়েটি যুদ্ধে তার বাবা-মা আর দুই ভাইয়ের মধ্যে একজনকে হারিয়েছে।
তার ছোট ভাই ইসমাইলকে নিয়ে এখন সে এই শিবিরের বাসিন্দা। সে জানালো, সব সময় তার বাবা-মার কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে মিশরে পরিবারের অন্য সদস্যদের কথা। তার দাদা, দাদী, চাচার কথা।
Advertisement
জুমানাসহ অন্য শিশুরা মাসের পর মাস ধরে লিবিয়ার যুদ্ধ-বিধ্বস্ত এলাকায় আটকা পড়ে ছিল। সেখানে খাবার ও পানির ছিল তীব্র সঙ্কট। যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেন সমর্থিত বাহিনী যখন আইএস-এর বিরুদ্ধে লড়ছিল তখন বহু আবাসিক এলাকা ধূলিসাৎ হয়ে গিয়েছিল।
বিবিসি জানিয়েছে, অনেক খোঁজ-খবর করে মিসরে জুমানার পরিবারের সন্ধান পাওয়া গেছে। তার দাদা-দাদী এবং চাচার সঙ্গে যখন সাংবাদিকদের দেখা হয় তখন তাদের মুখে ছিল মলিন হাসি। আশাভঙ্গের চিহ্ন দেখা যাচ্ছিল তাদের চোখেমুখে। সব সময় বাড়ির কথা মনে পড়ে জুমানার।
জুমানার দাদী আজিজা বলেন, তিন বছর আগে যখন আমার ছেলে লিবিয়ায় চলে যায় তারপর থেকে নাতি-নাতনির মুখ দেখতে পাইনি। প্রতিবারই যখন আমি গাড়ির হর্ন শুনি, আমার মনে হয় এই বুঝি তারা ফিরে এল। আমার মনে হয় এই বুঝি তারা দরজায় কড়া নাড়বে।
জুমানা, তার ভাই এবং অন্য মিসরীয় শিশুদের দেশে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া চলছে দীর্ঘদিন ধরে। জুমানার চাচা রামাদান এই নিয়ে বহু জায়গায় চেষ্টা করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, এ বিষয়ে সরকারি প্রক্রিয়া বেশ ধীর।
তিনি বলেন, তারা যদি বলতো শিশুদের ফেরত পেতে আমাকে এক বছর অপেক্ষা করতে হবে, সেটা বুঝতে পারতাম। কিন্তু সুনির্দিষ্ট করে তারা কিছু বলছে না। তারা শুধু আইন দেখায়। বলে এটা বাকি, ওটা বাকি। আমি চেয়েছিলাম আমি নিজে গাড়ি চালিয়ে লিবিয়া যাব এবং বাচ্চাদের ফেরত আনবো।
কিন্তু তারা আমাকে সেই অনুমতিও দিচ্ছে না। সুতরাং, সরকারি প্রক্রিয়া যতদিন শেষ না হয় ততদিন এই শিশুদের থাকতে হবে রেড ক্রিসেন্টের এই আশ্রয় শিবিরে। সে সময় পর্যন্ত দিন গুণতে হবে কবে তারা আবার মিলিত হবে আত্মীয় পরিজনের সাথে।
টিটিএন/এমএস