মতামত

জীবন কিনেছে অল্প দামে

বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দক্ষতার ওপর আমার আস্থা আছে। রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয়ে দায়িত্ব পালন করতে পারলে তারা অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারে। জঙ্গীদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান প্রশংসা পেয়েছে সব মহলের। বিচারবহির্ভূত হত্যা বাদ দিলে চলমান মাদকবিরোধী অভিযানও স্বস্তি এনেছে।

Advertisement

পুলিশের দক্ষতার অনেক উদাহরণ আছে। তবে আমি সবার আগে বলি এমপি পিনু খানের ছেলেকে গ্রেপ্তারের ঘটনাটিকে। বাংলাদেশে মানুষ বেশি, অপরাধও বেশি। তাই পুলিশের পক্ষে সব ঘটনায় সমান নজর দেয়া সম্ভব হয় না। চাঞ্চল্যকর, আলোচিত ঘটনাগুলো নিয়ে ব্যস্ত থাকে পুলিশ। কিন্তু এই ঘটনাটি ব্যতিক্রম।

২০১৫ সালের ১৩ এপ্রিল গভীর রাতে নিউ ইস্কাটনে দৈনিক জনকণ্ঠের সামনে যানজটে আটকা পড়েছিল একটি দামি গাড়ি। মধ্যরাতে জ্যাম সহ্য হয়নি গাড়ির যাত্রীর। তিনি এলোপাতাড়ি গুলি করেন। তাতে এক রিকশাচালক এবং এক অটোরিকশাচালক আহত হন। দুর্বৃত্ত অজ্ঞাত, আহত দুজনও নিন্মবিত্তের মানুষ; তাই ঘটনাটি গণমাধ্যমের নজর কাড়তে পারেনি। কোনো কোনো পত্রিকায় ভেতরের পাতায় সিঙ্গেল কলাম সংবাদেই হারিয়ে যায় ঘটনাটি। পরে আহত দুজন মারা যান।

যেহেতু এ ঘটনার কোনো ভিডিও নেই, তাই এ নিয়ে গণমাধ্যম বা সামাজিক মাধ্যম কোথাও কোনো আলোড়ন ওঠেনি। কিন্তু কারো কোনো চাপ ছাড়াই পুলিশ নীরবে তদন্ত চালিয়ে যায়। ঘটনাটি প্রায় ক্লুলেস। জনকণ্ঠের সিটিভিতে চলমান গাড়িটির এক ঝলক ছবি ছাড়া আর কোনো সূত্র ছিল না। কিন্তু কেচো খুড়তে গিয়ে বেরিয়ে আসে অজগর সাপ। সেই ঝাপসা ছবি থেকেই নাম্বার বের করে খোঁজ নিয়ে পুলিশ জানতে পারে প্রাডো মডেলের গাড়িটির মালিক সংসদ সদস্য পিনু খান।

Advertisement

প্রথমে গাড়ির চালককে আটক করা হয়। পরে তার বক্তব্যের সূত্র ধরে ঘটনার দেড় মাস পর পিনু খানের বাসা থেকে তার ছেলে বখতিয়ার আলম রনিকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরে জানা যায়, দুই বন্ধুসহ মাতাল রনি বাসায় ফিরছিলেন । তখন যানজটে বিরক্ত হয়ে পিস্তল দিয়ে গুলি ছুঁড়েন। সেই দুই বন্ধু এবং গাড়ির চালক স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছেন। মামলাটি এখন রায়ের অপেক্ষায়। রনি এখনও কারাগারেই আছেন।

কোনো রাজনৈতিক চাপ নেই, গণমাধ্যম, সামাজিক মাধ্যম কোথাও কোনো আওয়াজ নেই। তারপরও প্রায় রহস্য উপন্যাসের মত জটিল তদন্তে সরকারি দলের একজন এমপির ছেলেকে হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার করা- পুলিশের সক্ষমতার উদাহরণ হয়ে থাকবে। পুলিশ চাইলেই গোটা তদন্তটা গিলে ফেলতে পারতো। তদন্তের পরও সরকার চাপ দিয়ে ঘটনাটি আড়াল করতে পারতো। কিন্তু তেমন কিছুই ঘটেনি। আইন সত্যি সত্যি চলেছে তার নিজের গতিতে।

এখন আলোচনায় আরেক এমপিপুত্র। নোয়াখালী-৪ আসনের সংসদ সদস্য একরামুল হক চৌধুরীর ছেলে শাবাব চৌধুরীর বিরুদ্ধে দুর্ঘটনায় এক লোককে হত্যার অভিযোগ এসেছে। আগের ঘটনার তুলনায় এটি মোটেই জটিল নয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, ১৯ জুন রাতে মহাখালী ফ্লাইওভার থেকে নামার সময় শাবাব চৌধুরীর অডি গাড়ি সেলিম বেপারী নামে এক গাড়িচালককে চাপা দেয়।

প্রথমে সেলিম বেপারীর পায়ের ওপর দিয়ে যায় গাড়িটি। তারপর সেলিম বেপারী গাড়িটি আটকাতে এর বাম্পার ধরে ঝুলে পড়েন। তাকে খসাতে চালক গাড়িটি পিছিয়ে এনে তার মৃত্যু নিশ্চিত করে পালানোর চেষ্টা করেন। এক মোটর সাইকেল আরোহী গাড়িটি অনুসরণ করতে থাকেন। তার আহ্বানে আরো এক গাড়িও তাদের অনুসরণ করে। অডি গাড়িটি মানিক মিয়া এভিনিউর পাশের ন্যাম ফ্ল্যাটে ঢুকে পড়ে। সেখানে নেমেই গাড়ির চালক বলতে থাকেন, এটা আমার এলাকা। এবার কে কে আসবি আস।

Advertisement

মোটরসাইকেল আরোহীর মোবাইলে দুর্ঘটনার ভিডিও ছিল। সেই চালক তার মোবাইলটি ছিনিয়ে নিয়ে বলতে থাকেন, কত কোটি টাকা লাগবে। নিরাপত্তারক্ষীরা তাকে শাবাব বলে ডাকছিল। পেছনে অনুসরণকারী গাড়ির আরোহীরা পৌঁছে দেখেন, শাবাব এবং তার লোকজন মোটরসাইকেল আরোহীকে মারছেন এবং তার মোবাইলটি ছিনিয়ে নিয়েছেন।

শাবাব চৌধুরী সাংসদ একরামুল হক চৌধুরীর ছেলে। আর ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার গাড়ির নাম্বার প্লেট অনুসরণ করে দেখা গেছে, সেটি শাবাব চৌধুরীর মা কবিরহাট উপজেলা চেয়ারম্যান কামরুন্নাহার শিউলির নামে রেজিস্ট্রেশন করা। প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা এবং নাম্বার প্লেট অনুযায়ী কামরুন্নাহান শিউলির মালিকানার অডি গাড়িটি চালাচ্ছিলেন তার ছেলে শাবাব চৌধুরী। কিন্তু এমন সুস্পষ্ট অভিযোগের পরও পুলিশ গাড়িটি আটক করেনি। আটক করেনি অভিযুক্ত শাবাব চৌধুরীকেও।

দুর্ঘটনা ঘটানো গাড়িটি তার, এটি স্বীকার করেছেন কামরুন্নাহার শিউলি। কিন্তু তিনি বলছেন, গাড়িটি তাদের চালক চালাচ্ছিল। শাবাব চৌধুরী গাড়িতেই ছিলেন না। তিনি এই ঘটনায় ঢাল হিসেবে দলকেও টেনে আনছেন। বলছেন, শাবাবের বাবা-মা আওয়ামী লীগ করেন বলেই তাকে অভিযুক্ত করা হচ্ছে। কিন্তু যা ঘটেছে, তা দুর্ঘটনা। সেটা কে করেছে, পুলিশ তা তদন্ত করে বের করবে এবং অভিযুক্তকে আইনের আওতায় আনবে। এখানে আওয়ামী লীগের কোনো ভূমিকা নেই, আওয়ামী লীগকে টানারও দরকার নেই।

শোনা যাচ্ছে, তারা নিহত সেলিম বেপারীর পরিবারের সাথে সমঝোতার চেষ্টা করছেন শাবাব চৌধুরীর পরিবার। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি সেলিম বেপারীর জীবনের দাম নাকি ৩০ লাখ টাকা উঠেছে। মানুষের জীবন অমূল্য। কখনোই টাকার অঙ্কে তা বিবেচনা করা সম্ভব নয়, উচিতও নয়। তবে ছেলেকে বাঁচাতে তার বাবা সাংসদ একরামুল হক চৌধুরী এবং মা উপজেলা চেয়ারম্যান কামরুন্নাহার শিউলির চেষ্টা আমার কাছে অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে না।

একমাত্র ছেলেকে বাঁচাতে বাবা-মা সর্বোচ্চ চেষ্টাটাই করবেন। কিন্তু এখানে পুলিশের ভূমিকা রহস্যজনক। কামরুন্নাহার শিউলির মালিকানাধীন অডি গাড়িটিই যে দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে এটা তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন। এর আগেই বিআরটিএ থেকেও পুলিশ বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছে। অথচ পুলিশ এখনও গাড়িটিও জব্দ করেনি। গাড়িটি কে চালচ্ছিলেন, তা প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে নিশ্চিত হয়ে তাকেও আইনের আওতায় আনতে হবে।

পরিবার সমঝোতার চেষ্টা করছে। কিন্তু পুলিশের তো সেদিকে তাকিয়ে থাকার কথা নয়। তারা নিয়ম মত আইনের নিজস্ব গতিতে এগিয়ে যাওয়ার কথা। দুর্ঘটনায় মানুষ মেরে ফেলার মত ফৌজদারি অপরাধ তো নিশ্চয়ই আপসযোগ্য নয়। দেখেশুনে মনে হচ্ছে, সেলিম বেপারীর পরিবার হয়তো টাকা পাবেন, কিন্তু বিচার পাবেন না। টাকা দিয়ে আইন কিনে নেয়া হবে হয়তো।

অল্প দামে কিনে নেয়া হবে সেলিম বেপারীর জীবন। শাবাব চৌধুরীর সমঝোতার চেষ্টা দেখে মনে হচ্ছে, ডাল মে কুচ কালা হ্যায়। সত্যি যদি গাড়ির চালকই দুর্ঘটনা ঘটাতেন, তাহলে নিশ্চয়ই তারা ৩০ লাখ টাকায় সমঝোতা করতে যেতেন না। আমরা বলছি না, শাবাব চৌধুরীই দুর্ঘটনা ঘটিয়েছেন। তবে সেটা আদালতে নিষ্পত্তি হতে হবে, সমঝোতা নয়।

সিনিয়র সাংবাদিক মহসিন আব্বাসের কাছে শোনা একটি কথা দিয়ে লেখাটি শেষ করছি। গরীবে গরীবে মামলায় জড়ালে দুইপক্ষই হারিয়ে যায়। ধনীতে গরীবে মামলায় জড়ালে গরীব হারিয়ে যায়। আর ধনীতে ধনীতে মামলায় জড়ালে আইন হারিয়ে যায়। এখানে ধনীতে আর গরীবে লড়াই। তবুও মনে হচ্ছে আইন হারিয়ে যাচ্ছে।

এইচআর/জেআইএম