পণ্ডিত মশাইয়ের আটজনের পরিবার ও লাটসাহেবের তিনঠেঙে কুকুরের গল্প পড়েছিলাম স্কুলপাঠ্য বইতে। দরিদ্র স্কুল শিক্ষক পণ্ডিত মশাই বেতন পেতেন পঁচিশ টাকা। আর লাটসাহেবের তিনঠেঙে কুকুরের জন্য ব্যয় হতো মাসে পঁচাত্তর টাকা। তাহলে আট সদস্যের দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবার লাট সাহেবের কুকুরের কয় ঠ্যাঙের সমান প্রশ্নটি রেখেছিলেন হতভাগ্য পণ্ডিত মশাই। তার প্রশ্নটি আবারও মনে পড়লো প্রেসক্লাবের সামনে শিক্ষকদের আমরণ অনশন কর্মসূচি দেখে।
Advertisement
এবতেদায়ী শিক্ষকরা বেশ কিছুদিন ধরেই সরকারি বেতনভাতার দাবিতে অনশন করছেন। বছরের পর বছর বিনা বেতনে এরা কাজ করছেন। সরকারি বেতনভাতার আশায় তাদের এই বিনামূল্যের শ্রম। তাদের দারিদ্র্য ভীষণ অমানবিক। প্রেসক্লাবের আশপাশে বাংলা একাডেমি ও ঢাকার অন্যান্য জায়গায় চলছে পৌষমেলা, পিঠা উৎসব। সেখানে বন্ধুবান্ধব নিয়ে পিঠা খেতে গেলেই হাজার টাকার বেশি খরচ হয়ে যায়। অন্য কিছু কেনাকাটা করলে তো খরচ আরও অনেক বেশি পড়ে।
আর বাণিজ্য মেলায় অসংখ্য মানুষের ঢল নামার খবর তো প্রতিদিনই গণমাধ্যমে দেখছি। সেখানে হাজার হাজার টাকার জিনিস কিনছে ক্রেতারা। তার বেশিরভাগই সৌখিন পণ্য। অন্যদিকে একজন এবতেদায়ী শিক্ষক মাত্র এক হাজার টাকা বেতনে সংসার চালানোর জন্য বসে আছেন কনকনে শীতের মধ্যে রাস্তার উপর। অনেকে অসুস্থও হয়ে পড়েছেন। সমাজের এই শ্রেণী-বৈষম্যের চিত্রগুলো আমাকে খুব বেশি পীড়া দেয়।
নগরীতে এখানে সেখানে পৌষ উদযাপন চলছে। তা চলুক। তাতে আপত্তি নেই। পৌষ পার্বণ উদযাপন আমাদের সংস্কৃতির অংশ। চলছে কবিতা উৎসব, সাহিত্য উৎসবও। এসবই ইতিবাচক। কিন্তু সেইসঙ্গে শীতার্ত দরিদ্র মানুষদের কথাও তো মনে রাখতে হবে। প্রতিটি উৎসবস্থলে যদি একটি করে দানবাক্স থাকে তাহলে কেউ অল্প করেও তো দান করতে পারেন। এমনিতে ফেসবুকে কম্বল বিতরণের দৃশ্য অবশ্য খুবই চোখে পড়ছে। সেটা যত না দানের উদ্দেশ্যে তারচেয়ে বেশি সেলফি তোলার নেশায়। যে পরিমাণ পোস্ট ফেসবুকে দেখছি, সে পরিমাণ কম্বল যদি সত্যিই বিতরণ করা হয়ে থাকে তাহলে বাংলাদেশের কোন দরিদ্র মানুষের তো বাদ পড়ার কথা নয়।
Advertisement
ছোটবেলায় শুনেছিলাম দান নাকি এমনভাবে করা দরকার যেন ডান হাত দান করলে বামহাত জানতে না পারে। কিন্তু ‘সে যুগ হয়েছে বাসি’। এ যুগে সেলফিই শেষ কথা। দান করে ছবি তুললেও অবশ্য সমস্যা নেই। দে বাবা, ছবি তোলার জন্য হলেও কিছু দে। কিন্তু সমস্যা হলো দানটা ঠিকমতো হচ্ছে না তেলা মাথায় কেবলি তেল ঢালা হচ্ছে? ঢাকায় চলছে কম্বল বিতরণ। ফলে ঢাকার গৃহহীনরা অনেকে একাধিক করে কম্বল পাচ্ছেন। অন্যদিকে প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলো রয়ে যাচ্ছে বিতরণ সীমার বাইরে। এজন্য প্রয়োজন হলো সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে ত্রাণকার্য পরিচালনা।
এ বছর রেকর্ডভাঙা শীত পড়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই হয়তো এমনটি ঘটছে। যদি এমন শীত প্রতিবছরই পড়তে থাকে তাহলে বাড়তি কিছু সতর্কতার দরকার বৈকি। আমাদের দেশের ঘরবাড়িগুলো ঠিক শীতের উপযোগী নয়। আমাদের পোশাক পরার পদ্ধতিতেও রয়েছে সমস্যা। আমরা গায়ে শীতবস্ত্র দিলেও পায়ের দিকটাতে তেমন মনোযোগ দেই না। সাধারণ মানুষ শাড়ি, লুঙ্গি বা সালোয়ার কামিজের উপরেই একটা সোয়েটার বা শাল চাপিয়ে শীত পার করতে চান। কিন্তু প্রয়োজন হলো পায়ের দিকে মনোযোগ দেওয়া।
শীতপ্রধান দেশের অনেকের কাছে শুনেছি আগে রক্ষা দরকার পায়ের। উলের তৈরি পোশাকে বা গরম কাপড়ে আগে পা ঢাকতে হবে। হাঁটুর জন্য চাই ‘নিগার্ড’। জুতাও চাই আলাদা রকমের। তারা বলে, পা ভালোভাবে সুরক্ষিত থাকলে নাকি খালি গায়েও ঠাণ্ডা লাগবে না। কিন্তু আমরা করি ঠিক উল্টো ব্যাপার। অনেক সময় চটিজুতো পরে, কানে একটা মাফলার জড়িয়ে শীত মোকাবেলার চেষ্টা করি। এ বিষয়ে প্রচারণাটা জরুরি। আর শীতে কোল্ড ডায়রিয়া ও অন্যান্য অসুখ বিসুখ থেকে জনগণকে রক্ষার জন্য সরকারি স্বাস্থ্যবিভাগকে সতর্ক থাকতে হবে। ঠিকমতো প্রচারণাও চালাতে হবে। নোংরা স্ট্রিটফুড থেকেও বিরত থাকতে হবে নগরবাসীকে।
যাহোক, শীত-প্যাঁচালের পর আবার ফিরে আসি শিক্ষকদের কথায়। প্রাথমিক বিদ্যালয় ও মাদ্রাসার শিক্ষকরা গ্রামেগঞ্জে বেশ বঞ্চিত অবস্থায়ই জীবন কাটান। টাকার প্রয়োজনে অনেকে শিক্ষকতায় মনোযোগ না দিয়ে অন্য কাজে অর্থ উপার্জনের চেষ্টা করেন। ক্ষতিগ্রস্ত হয় শিক্ষার্থীরা। সামগ্রিকভাবে ব্যাহত হয় শিক্ষার মান। এজন্য শিক্ষকদের দাবি-দাওয়া নিয়ে ভাবতে হবে। তাদের জীবনযাত্রা যেন ঠিকঠাকভাবে চলে তা দেখতে হবে। এই তীব্র শীতে শিক্ষকরা পথে পড়ে থাকবেন আর পৌষ পার্বণ নিয়ে আমরা মেতে থাকবো এ ছবি দেখতেই তো খারাপ লাগে। জুতোর কাঁটা হয়ে খোঁচা দেয় বিবেক। লাট সাহেবের কুকুর ভালো থাক, আপত্তি নেই। কিন্তু পণ্ডিত মশাইদেরও যেন পরিবার পরিজন নিয়ে ভালোভাবে চলার সঙ্গতি থাকে।
Advertisement
লেখক : কবি, সাংবাদিক।
এইচআর/জেআইএম