পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র সংগ্রামে বিজয় অর্জনের পর পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে আসেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সদ্যস্বাধীন দেশের মানুষজন সে সময় তাকে দেখার জন্য, তার কথা শোনার জন্য ব্যাকুল। তার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিনটি ঘিরে সাধারণ মানুষের মনে এক ধরনের উত্তেজনা কাজ করছিল। সেই সময়ের স্মৃতিচারণ করেছেন স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রখ্যাত গেরিলা যোদ্ধা কামরুল আলম খান খসরু।
Advertisement
তিনি বলেন, ‘৯ জানুয়ারি, বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যার্বতনের আগের দিন আমাকে ইকবাল হলে (বর্তমান সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) বিএলএফ’র তিন কমান্ডার তথা ‘নিউক্লিয়াসে’র নেতৃবৃন্দ সিরাজ (সিরাজুল আলম খান) ভাই, রাজ্জাক (প্রয়াত আবদুর রাজ্জাক) ভাই ও আরেফ (কাজী আরেফ আহমেদ) বললেন, বঙ্গবন্ধু আগামীকাল আসবেন। তারা আমাকে দেরাদুনে ট্রেনিং নেয়া গ্রুপের ছেলেদের নিয়ে তোমাকে এয়ারপোর্টে যেতে বললেন। তবে তাদের কাছে কোনো অস্ত্র থাকবে না। শুধু আমার কাছে অস্ত্র রাখতে বললেন।’
‘তারা আমাকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে থাকার নির্দেশ দিলেন এবং আমার গ্রুপের সদস্যদের নামের তালিকা চাইলেন। আমি সঙ্গে সঙ্গে একটি তালিকা দিয়ে দিলাম। তারা বললেন, আগামীকাল সকালে তোমাদের নেয়ার জন্য একটি ট্রাক আসবে। তুমি প্রস্তুত থাকবে। তোমার গ্রুপের ছেলেদের নিয়ে ওই ট্রাকে যাবে। আমি আমার সহযোদ্ধাদের ডেকে বিষয়টি বুঝিয়ে বললাম। সেখানে আমার সেকেন্ড ইন কমান্ড মুরাদ, বেবী, জাহাঙ্গীর, মনিসহ আরও অনেকে ছিলেন।’
‘১০ জানুয়ারি সকালে ইকবাল হলের সামনে ট্রাক আসল। ট্রাক যখন চলতে শুরু করল তখন আমরা স্লোগান দিতে শুরু করলাম। ‘জয় বাংলা’, ‘জয় বঙ্গবন্ধু’, ‘তোমার আমার ঠিকানা-পদ্মা মেঘনা যমুনা’ ইত্যাদি স্লোগান দিতে দিতে আমরা বিমানবন্দর অভিমুখে যাত্রা করি। লাখ লাখ লোক, রাস্তার দু ধারে, বাড়ির ছাদে, গাছের উপর। পথে পথে মানুষের ঢল। বিমানবন্দরে পৌঁছে ট্রাক থেকে নেমে দেখি রানওয়েতে লোকে-লোকারণ্য। লাখ লাখ মানুষ বঙ্গবন্ধুর জন্য অপেক্ষা করছে।’
Advertisement
তিনি আরও বলেন, ‘আমি বিমানবন্দরে যাওয়ার পর নিউক্লিয়াস ও বিএলএফ নেতারা আমাকে একটা সিঁড়ি দেখিয়ে বললেন, এই সিঁড়ি দিয়ে বঙ্গবন্ধু প্লেন থেকে নামবেন। আমি ওই সিঁড়িতে উঠে দাঁড়িয়ে থাকলাম। পুরো বিমানবন্দর এলাকায় বঙ্গবন্ধু নামে স্লোগান চলছে, মিছিল হচ্ছে। হঠাৎ আমি শুনতে পেলাম বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী ব্রিটিশ এয়ারওয়েজটি দিল্লি থেকে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হয়েছে। প্লেনটি ঢাকার তেজগাঁওয়ের পুরাতন বিমানবন্দরে যখন আসল তখন অপেক্ষার প্রহর শেষ হলো। প্লেনের পাইলট রানওয়ে থেকে সবাইকে সরে যাওয়ার আহ্বান জানান কন্ট্রোলরুমে। সময়ক্ষেপণের জন্য প্লেনটি আকাশে আরেকবার ঘুরে রানওয়েতে ল্যান্ড করল।’
ঢাকা অঞ্চলের গেরিলা বাহিনীর এ কমান্ডার বলেন, আমি যে সিঁড়িটিতে দাঁড়িয়ে ছিলাম সেই স্টেয়ার কেসটি সরিয়ে নিয়ে প্লেনের গেটে লাগিয়ে দেয়া হলো। বঙ্গবন্ধু যখন প্লেন থেকে নেমে এলেন সবাই চিৎকার করে, স্লোগান দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে অভিবাদন জানালেন।
স্বাধীনতার পর এটিই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার প্রথম সাক্ষাৎ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু আমাদের মাঝে ফিরে আসবেন, আমরা বঙ্গবন্ধুকে আবার দেখতে পাব, এটা কখনো ভাবতে পারিনি। আমি উনাকে দেখেই শিহরিত হয়ে উঠলাম। আমার পুরো শরীরের লোম দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। আমি আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ি। উনি আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘অনেক কষ্ট করেছিস। তাহলে তোরা পারলি।’ আমি কোনো কথা বলতে পারলাম না। শুধু চোখ দিয়ে আনন্দের জল গড়িয়ে পড়ল।’
কিছুটা আক্ষেপ করেই তিনি বলেন, ‘আমার পরেই দাঁড়ানো ছিল মহিউদ্দিন। বঙ্গবন্ধু মহিউদ্দিনের সঙ্গে হাত মেলালেন। তারপর আরেকজন দাঁড়িয়ে ছিল। উনি বঙ্গবন্ধুকে ফুলের মালা দিয়ে বরণ করে নিলেন। ফুলের মালা দেয়ার দৃশ্য থেকে এখন ভিডিওটি সম্প্রচার করা হয়। এটা অনেকটাই ইতিহাসের সত্য লুকানোর মতোই। স্বাধীনতার সংগ্রাম-সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ কারো একক বিষয় নয়, সম্মিলিত সংগ্রামের ফসল। সবার অবদানের প্রাপ্র্য স্বীকৃতি দেওয়া উচিত।’
Advertisement
‘এরপর তৎকালীন সেনাপতি শেখ কামাল, শফিউল্লাহ এবং আমি বঙ্গবন্ধুকে ‘গার্ড অব অনার’ প্রদাণ করি। তখন বঙ্গবন্ধু সালাম গ্রহণ করেন। পরে আমরা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ট্রাকের কাছে চলে আসি। আমি বঙ্গবন্ধুকে ধরে ট্রাকে তুলে নেই। এরপর একে একে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দকেও ট্রাকে উঠতে সহযোগিতা করি। ট্রাকে আরও অনেকে উঠতে চাইলেও আমার বাধায় আর কেউ উঠতে পারেনি।’
সেদিন অনেক মানুষ অশ্রু বিসর্জন দিয়েছেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘বিমানবন্দর থেকে ট্রাকটি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের দিকে রওনা হয়। রাস্তার দুই পাশে দাঁড়ানো মানুষ হাত উচিয়ে বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানাতে থাকেন। বঙ্গবন্ধুও মানুষের অভিবাদন গ্রহণ করেন। অনেককেই সেদিন আনন্দের অশ্রু বিসর্জন দিতে দেখেছি।’
এইউএ/বিএ