১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। স্বাধীনতার চার বছর পর জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রবর্তন করা হয়। যা বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের একমাত্র রাষ্ট্রীয় ও সর্বোচ্চ পুরস্কার। ১৯৭৫ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রবর্তনের পর ৪০ বছরে ১৩টি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করে।
Advertisement
১৯৭৫ সালে প্রথম চলচ্চিত্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখার জন্য পুরস্কার প্রদান শুরু হয়। প্রতি বছর সরকার নিযুক্ত জাতীয় প্যানেল বিজয়ীদের নির্বাচন করে। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রদানের প্রথম অনুষ্ঠানিকতা ১৯৭৬ সালের ৪ এপ্রিল সম্পন্ন হয়। এর পরের বছর ১৯৭৬ সালে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র ‘মেঘের অনেক রং’ শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রের পুরস্কার পায়। চলচ্চিত্রটি পরিচালনা করেন হারুনর রশীদ। রত্না কথাচিত্রের ব্যানারে চলচ্চিত্রটি প্রযোজনা করেন আনোয়ার আশরাফ ও শাজীদা শামীম। এতে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন মাথিন, ওমর এলাহী, রওশন আরা, আদনান প্রমুখ।
১৯৭৭ সালে ‘বসুন্ধরা’ চলচ্চিত্রটি শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবে নির্বাচিত হয়। ঔপন্যাসিক আলাউদ্দিন আল আজাদের উপন্যাস ‘তেইশ নম্বর তৈলচিত্র’ অবলম্বনে চলচ্চিত্রটি পরিচালনা করেন প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সুভাষ দত্ত। বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ কল্যাণ ট্রাস্ট প্রযোজিত ছবিটির প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন ববিতা, ইলিয়াস কাঞ্চন, নূতন, সৈয়দ হাসান ইমাম, শর্মিলী আহমেদ প্রমুখ। এটি শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রসহ মোট ৬টি বিভাগে পুরস্কার অর্জন করে।
১৯৯০ সালে পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের পাশাপাশি শ্রেষ্ঠ স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র হিসেবে ‘আমরা তোমাদের ভুলব না’ পুরস্কার পায়। ১৯৯২ সালে ‘শঙ্খনীল কারাগার’ চলচ্চিত্রকে শ্রেষ্ঠ কাহিনির জন্য পুরস্কার দেওয়া হয়। এতে শ্রেষ্ঠ কাহিনিকার হিসেবে পুরস্কার পান নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ। তার একবছর পর হুমায়ূন আহমেদের ‘আগুনের পরশমণি’ শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবে নির্বাচিত হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রটি হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মাণ করা হয়। এটিই তার পরিচালিত প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। এতে অভিনয় করেন বিপাশা হায়াত, আসাদুজ্জামান নূর, আবুল হায়াত, ডলি জহুরসহ অনেকে। বাংলাদেশ সরকারের অনুদানের ছবি আগুনের পরশমণি শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রসহ আটটি বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করে।
Advertisement
১৯৯৫ সালে তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদ পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বাংলা প্রামাণ্যচিত্র ‘মুক্তির গান’ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করে। প্রামাণ্যচিত্রটি দক্ষিণ এশিয়া চলচ্চিত্র পুরস্কারে বিশেষ উল্লেখযোগ্য পুরস্কার এবং ২০তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে ‘শ্রেষ্ঠ স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র’ বিভাগে পুরস্কার লাভ করে।
১৯৯৭ সালে সেলিনা হোসেনের উপন্যাস ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ অবলম্বনে নির্মিত ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ চলচ্চিত্রটি ৩টি বিভাগে পুরস্কৃত হয়। এটি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র। এই ছবিটি পরিচালনা করেন বাংলাদেশের বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার চাষী নজরুল ইসলাম। ছবিতে বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেন সুচরিতা, সোহেল রানা, অরুণা বিশ্বাস, অন্তরা, ইমরান, দোদুল ও আশিক প্রমুখ। হাঙর নদী গ্রেনেড সিনেমার জন্য শ্রেষ্ঠ পরিচালক হিসেবে চাষী নজরুল ইসলাম, শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী হিসেবে সুচরিতা এবং শ্রেষ্ঠ কাহিনীকার হিসেবে সেলিনা হোসেন পুরস্কার অর্জন করেন।
‘বীর সৈনিক’ ২০০৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত যুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র। ছবিটি রচনা ও পরিচালনা করেন দেলোয়ার জাহান ঝন্টু। এসডি প্রডাকশন্সের ব্যানারে ছবিটি নির্মিত ও পরিবেশিত হয়। এতে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন মান্না, মৌসুমী, সাথী, নাসির খান, হুমায়ুন ফরীদি, রোজী আফসারী প্রমুখ। মান্না এই চলচ্চিত্রে দ্বৈত ভূমিকায় অভিনয় করেন। চলচ্চিত্রটি ২৮তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে দুটি বিভাগে পুরস্কার লাভ করে। মান্না শ্রেষ্ঠ অভিনেতা এবং সাথী শ্রেষ্ঠ পার্শ্বচরিত্র (অভিনেত্রী) বিভাগে পুরস্কৃত হন।
২০০৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘জয়যাত্রা’ ছবিটি সে বছর শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রের পুরস্কার পায়। বিখ্যাত সম্পাদক, কাহিনিকার ও চলচ্চিত্র পরিচালক আমজাদ হোসেনের কাহিনি নিয়ে সংলাপ, চিত্রনাট্য ও পরিচালনা করেন তৌকির আহমেদ। এটি তার পরিচালিত প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছবিটি প্রযোজনা ও পরিবেশনা করে ইমপ্রেস টেলিফিল্ম। ‘জয়যাত্রা’ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন একদল মানুষের হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ, মৃত্যু ও বেঁচে থাকার সংগ্রামের গল্প। ছবির বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেন বিপাশা হায়াত, আজিজুল হাকিম, মাহফুজ আহমেদ, হুমায়ুন ফরীদি, তারিক আনাম খান, আবুল হায়াত, মেহবুবা মাহনূর চাঁদনী। ছবিটি শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ ২৯তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র, শ্রেষ্ঠ পরিচালক ও শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকারের পুরস্কার লাভ করে। এছাড়া ছবিটি শ্রেষ্ঠ কাহিনিকার, শ্রেষ্ঠ সংগীত পরিচালক, শ্রেষ্ঠ পার্শ্বচরিত্রে অভিনেত্রী ও শ্রেষ্ঠ চিত্রগ্রাহক বিভাগে পুরস্কার লাভ করে।
Advertisement
‘গেরিলা’ ছবিটি ২০১১ সালে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবে পুরস্কার লাভ করে। নাসির উদ্দীন ইউসুফ পরিচালিত চলচ্চিত্রটি মূলত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে নির্মিত। সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের ‘নিষিদ্ধ লোবান’ উপন্যাস অবলম্বনে নির্মাণ করা হয়েছে চলচ্চিত্রটি। এর চিত্রনাট্য করেন যৌথভাবে নাসির উদ্দীন ইউসুফ ও এবাদুর রহমান। গেরিলা ছবিতে অভিনয় করেন সহস্রাধিক শিল্পী। প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন জয়া আহসান, ফেরদৌস, এটিএম শামসুজ্জামান, রাইসুল ইসলাম আসাদ, পীযুষ বন্দ্যোপাধ্যায়, শতাব্দী ওয়াদুদ, শম্পা রেজা, গাজী রাকায়েত প্রমুখ। এছাড়াও সিনেমাটি ২০১১ সালে বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে অংশগ্রহণ করে। এমনকি ১৭তম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে নেটপ্যাক পুরস্কার জিতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে বিশেষ ভূমিকা রাখে।
২০১৪ সালে মাসুদ পথিক পরিচালিত ‘নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ’ প্রাথমিকভাবে পাঁচটি বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের জন্য ঘোষিত হয়। পরে ‘বৃহন্নলা’ চলচ্চিত্রের বিরুদ্ধে গল্প চুরির অভিযোগ উঠলে নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র বিভাগেও পুরস্কৃত হয়। অন্য বিভাগগুলো হলো- শ্রেষ্ঠ গীতিকার, শ্রেষ্ঠ সংগীত পরিচালক, শ্রেষ্ঠ সুরকার, শ্রেষ্ঠ নারী কণ্ঠশিল্পী, শ্রেষ্ঠ রূপসজ্জাকার। কবি নির্মলেন্দু গুণের ‘নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ’ কবিতা অবলম্বনে সিনেমার চিত্রনাট্য লিখেছেন মাসুদ পথিক। সংলাপ লিখেছেন রাজিব আহসান ও মাসুদ পথিক। সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত চলচ্চিত্রটি প্রযোজনা ও পরিবেশনা করে ব্রাত্য চলচ্চিত্র। এতে নামচরিত্রে অভিনয় করেন জুয়েল জহুর এবং ফাতেমা চরিত্রে অভিনয় করেছেন শিমলা। কয়েকটি উল্লেখযোগ্য চরিত্রে মামুনুর রশীদ, প্রবীর মিত্র, রানী সরকার, বাদল শহীদ, রেহানা জলি প্রমুখ। এছাড়াও অভিনয় করেন কবি নির্মলেন্দু গুণসহ আরো পনেরো কবি। চলচ্চিত্রে কাহিনিচিত্রের পাশাপাশি তথ্যচিত্রের আবহকে ধারণ করার চেষ্টা করে প্রেম, প্রকৃতি ও মুক্তিযুদ্ধের ইমেজ ধরে আবহমান বাংলার নিবিড় সংস্কৃতি, জীবনের অন্তর্গত দর্শন তথা জীবনবোধকে তুলে ধরা হয়।
২০১৫ সালে ‘অনিল বাগচীর একদিন’ ও ‘বাপজানের বায়স্কোপ’ যৌথভাবে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র বিভাগে পুরস্কার লাভ করে। দুটিই মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র। ‘অনিল বাগচীর একদিন’ পরিচালনা করেন মোরশেদুল ইসলাম। প্রযোজনা করে বেঙ্গল ক্রিয়েশন্স। ছবিতে অনিল বাগচীর চরিত্রে অভিনয় করেন নবাগত অভিনেতা আরেফ সৈয়দ। অন্যান্য চরিত্রে গাজী রাকায়েত, তৌফিক ইমন, জ্যোতিকা জ্যোতি, ফারহানা মিঠু এবং মিশা সওদাগর অভিনয় করেন। মোরশেদুল ইসলাম এর আগে খেলাঘর (২০০৬) এবং আমার বন্ধু রাশেদ (২০১১) নামে দুটি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন।
অনিল বাগচীর একদিন চলচ্চিত্রের উদ্বোধনী প্রদর্শনী হয় ২০১৫ সালের অক্টোবরে শ্রীলঙ্কার কলম্বো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে। পরে ২০১৫ সালের ১১ ডিসেম্বর ছবিটি মুক্তি পায়। ছবিটি ২০১৫ সালে ২৩ ডিসেম্বর কলকাতায় উপ হাইকমিশনে এবং ২০১৬ সালের ২৮ মে কানাডায় মন্ট্রিলে প্রদর্শিত হয়। ছবিটি ৪০তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে যৌথভাবে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র ও শ্রেষ্ঠ পরিচালক পুরস্কারসহ ছয়টি বিভাগে পুরস্কৃত হয়। এছাড়া ১৮তম মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কারে তিনটি মনোনয়নের মধ্যে দুটি বিভাগে পুরস্কৃত হয়।
একই বছর রিয়াজুল রিজু পরিচালিত ও প্রযোজিত ‘বাপজানের বায়স্কোপ’ সিনেমাটিও শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রসহ আটটি বিভাগে পুরস্কার লাভ করে। কারুকাজ ফিল্মসের ব্যানারে নির্মিত চলচ্চিত্রটি রিয়াজুল রিজু পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র। ছবির কাহিনি লিখেছেন মাসুম রেজা। চিত্রনাট্য লিখেছেন মাসুম রেজা ও রিয়াজুল রিজু। এতে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন শহীদুজ্জামান সেলিম, শতাব্দী ওয়াদুদ ও সানজিদা তন্ময়। চলচ্চিত্রটি ২০১৫ সালের ১৮ ডিসেম্বর মুক্তি পায়। ৪০তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে ছবিটি যৌথভাবে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রসহ আটটি বিভাগে পুরস্কার লাভ করে।
সবশেষে বলতে চাই- চল্লিশ বছরে মাত্র ১৩টি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র পুরস্কার পাওয়ার সংখ্যাটি খুব বেশি বলে মনে হয় না। আমরা চাই, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রের সংখ্যা আরো বাড়ুক, সেই সঙ্গে বাড়ুক চলচ্চিত্র পুরস্কারে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রের সংখ্যাও।
এসইউ/এলএ/আইআই