ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ। আওয়ামী লীগ সরকারের গত মেয়াদে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী ছিলেন। সুপ্রিম কোর্টের বিশিষ্ট এ আইনজীবী আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য। প্রধান বিচারপতির পদত্যাগ, ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়, রায়ের পর্যবেক্ষণ প্রসঙ্গ নিয়ে সম্প্রতি মুখোমুখি হন জাগো নিউজ’র। বিচারপতি অপসারণ, নিম্ন আদালতের বিচারকদের আচরণবিধি এবং নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের বিচারিক ক্ষমতাসহ নানা বিষয় উঠে এসেছে সাক্ষাৎকারে।
Advertisement
সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন জাগো নিউজ’র জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক সায়েম সাবু। দুই পর্বের সাক্ষাৎকারের প্রথমটি আজ প্রকাশিত হলো..
জাগো নিউজ : প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার পদত্যাগ নিয়ে নানা বিতর্কের জন্ম নিল। এমন ঘটনা ‘নজিরবিহীন’ বলে মনে করা হচ্ছে। অনেক বিতর্কের জন্ম দিল ওই ঘটনা। এ বিষয়ে আপনার প্রতিক্রিয়া জানতে চাচ্ছি?
ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ : প্রধান বিচারপতির পদত্যাগের ঘটনা আমাদের বিচার ব্যবস্থার ইতিহাসের জন্য সত্যিই নজিরবিহীন। আগে এমনটি ঘটেনি বলেই আমরা জানি। মূলত সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়কে কেন্দ্র করে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহাকে নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়।
Advertisement
জাগো নিউজ : রায় নিয়ে কেন ওই বিতর্ক?
ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ : ষোড়শ সংশোধনীতে গুরুত্বপূর্ণ কিছু ব্যবস্থা নিয়েছিল জাতীয় সংসদ। এর মধ্যে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে নেয়া ছিল অন্যতম। সংবিধানের ওই সংশোধনী চ্যালেঞ্জ করে আদালতে রিট করা হয়। আর আদালত ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করতেই ওই রায় দেন। এটি আদালতের জন্যও চ্যালেঞ্জ ছিল বলে মনে করি।
সরকারের যেকোনো বিষয়ে আদালত রায় দিতে পারেন। সমস্যাটা অন্য জায়গায়। ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় দিয়ে আদালত যে পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন, তা অযাচিত এবং অপ্রাসঙ্গিক বলে মনে করি।
জাগো নিউজ : কেন অপ্রাসঙ্গিক মনে করছেন?
Advertisement
ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ : একটি রায়ে এমন পর্যবেক্ষণ আগে কখনও লক্ষ্য করা যায়নি। চারশরও অধিক পাতায় ওই পর্যবেক্ষণে সরকারে নানা বিষয় নিয়েই হস্তক্ষেপ করা হয়েছে।
জাগো নিউজ : দু’পক্ষের আইনজীবীদের মন্তব্য থেকেই তো ওই পর্যবেক্ষণ?
ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ : না। আইনজীবীদের শুনানি থেকে ওই পর্যবেক্ষণ নয়। যেটি দেয়া হয়েছে তা আদালতের নিজস্ব মন্তব্য। আইনজীবীদের শুনানি যদি মন্তব্য হতো তাহলে তা হুবহু তুলে দেয়া হতো। সেটি করা হয়নি। আদালত এমনটি করেও না।
জাগো নিউজ : যেকোনো রায়ে আদালতের মন্তব্য থাকতেই পারে?
ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ : অবশ্যই, আদালত তার পর্যবেক্ষণ ব্যক্ত করতে পারেন। আমরা আদালতের পর্যবেক্ষণ লক্ষ্য করে আসছি। কিন্তু অপ্রাসঙ্গিক বিষয় আদালত পর্যবেক্ষণে দিতে পারেন না। পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, সংসদ অপরিপক্ব। পর্যবেক্ষণে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। সংসদ এবং সংসদ সদস্যদের কঠোর সমালোচনা করা হয়েছে। সংসদ এবং সংসদ সদস্যদের ওপর অনাস্থা জ্ঞাপন করে ওই পর্যবেক্ষণ দেয়া হয়।
জাগো নিউজ : সংসদ অপরিপক্ব- এটি তো অনেকেই বলছেন। ১৫৩ জন সংসদ সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হলেন। জনমনে অনাস্থা তো আছেই?
ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ : সেটি এই আদালত বলতে পারেন না। সংবিধান অনুসারে নির্বাচন হয়েছে। আদালত এমন পর্যবেক্ষণ দিলে সংবিধানের ওপর আস্থা থাকে না। রায়ের পর্যবেক্ষণে এতকিছু বলার দরকার আছে বলে আমি মনে করি না। বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাত থেকে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের হাতে ফিরে আনতে এত কিছু বলার দরকার ছিল না।
জাগো নিউজ : কিন্তু এমন একটি রায়ে ব্যাকগ্রাউন্ড নিয়ে আলোচনা করতেই হয়। সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধে যখন ইয়াবা ব্যবসা, খুনের অভিযোগ ওঠে, তখন আদালতের মন্তব্য জরুরি হতেই পারে?
ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ : অভিযোগ উঠলেই আদালত তা আমলে এনে অন্য একটি মামলার রায়ের পর্যবেক্ষণে অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন না। বিচার বিভাগের কাজ সংসদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া নেয়। সংসদ কোনো আইন করলে তা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কি না, তা পর্যবেক্ষণ করা। এস কে সিনহা সংসদকে খাটো করেছেন। আদালতের নিজস্ব কাজ রয়েছে। এর বাইরে গিয়ে হস্তক্ষেপ করা সমুচিত নয়।
জাগো নিউজ : তাহলে কি ওই ‘হস্তক্ষেপ’র দায়ে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহাকে বিদায় নিতে হলো?
ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ : আমি তা মনে করি না। এস কে সিনহার পদত্যাগের বিষয়টি অন্য কারণে হতে পারে। তিনি এখন দেশের বাইরে। তবে আমি যতটুকু জানি, আপিল বিভাগের অন্য বিচারপতিরা প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার প্রতি অনাস্থা এনেছিলেন। তার সঙ্গে কাজ করতে দ্বিমত পোষণ করেছিলেন।
জাগো নিউজ : দ্বিমত পোষণের কারণ কী থাকতে পারে?
ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ : এস কে সিনহার বিরুদ্ধে ১১টি অভিযোগ উঠেছে। এর মধ্যে মানি লন্ডারিংও রয়েছে। আইনমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পর বিচারপতিরা এস কে সিনহার প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করেন। মূলত এ কারণে এস কে সিনহা পদত্যাগ করে থাকতে পারেন।
জাগো নিউজ : এস কে সিনহা দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। অভিযোগ উঠলো তিনি ছুটিতে যাওয়ার পর...
ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ : অভিযোগ আগেই উঠেছে। সামনে এসেছে তিনি ছুটিতে যাওয়ার পর। তিনি দেশে ফিরে এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারতেন।
জাগো নিউজ : বিষয়টি তদন্তসাপেক্ষ। বিচারে দোষী সাব্যস্ত হয়, তার আগেই অনাস্থা!
ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ : এর আগে আর কোনো প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ উঠেনি। এটি আদালতের জন্য বড় একটি ঘটনা। প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের ঘটনা ছোট কোনো বিষয় নয়। মানুষের ভরসার জায়গা আদালত। প্রধান বিচারপতি আদালতের সর্বোচ্চ কর্তা। এটি অন্য বিচারপতিরা হয়তো ভালোভাবে নেননি।
ষোড়শ সংশোধনীর রায়ের যে পর্যবেক্ষণ, তাতেও অন্য বিচারপতিরা দ্বিমত পোষণ করেছেন। অনেকেই আপত্তি জানিয়েছিলেন এমন মন্তব্যে। কিন্তু একতরফাভাবে পর্যবেক্ষণ দেয়া হয়েছে।
জাগো নিউজ : অভিযোগ যে কেউ করতেই পারেন। অভিযুক্তের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ থাকে…
ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ : আত্মপক্ষ সমর্থন করে তিনি অভিযোগের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ নিচ্ছেন না কেন? কেন দেশের বাইরে? একজনের কারণে তো গোটা বিচার ব্যবস্থা থমকে যেতে পারে না।
জাগো নিউজ : বিতর্ক তো আগে থেকেই চলে আসছিল। আইন মন্ত্রণালয় বললো- প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা অসুস্থ। আর ছুটিতে যাওয়ার সময় এস কে সিনহা বললেন, তিনি সুস্থ।
ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ : তিনি রাষ্ট্রপতির কাছে ছুটি চেয়েছেন চিকিৎসার কথা বলে। কিন্তু বিদেশে যাওয়ার সময় মিডিয়ার কাছে যা বলে গেলেন, সেটাও একজন বিচাপতির কাছে প্রত্যাশা করা যায় না।
জাগো নিউজ : তিনি তো বলার সুযোগ পাননি?
ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ : সুযোগ ছিল। তিনি বলেননি।
জাগো নিউজ : অভিযোগ ছিল ‘কার্যত গৃহবন্দি’ ছিলেন এস কে সিনহা। মিডিয়াকর্মী এমনকি আইনজীবীরাও তার সঙ্গে দেখা করতে পারলেন না…
ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ : অসুস্থ থাকলেও তিনি স্বাভাবিক ছিলেন বলে খবর পাঠিয়েছিলেন আইনজীবীদের কাছে। মিডিয়াকর্মীরা তার সঙ্গে দেখা করতে যাবেন কেন? চাইলেই একজন প্রধান বিচারপতির সঙ্গে যে কেউ দেখা করতে পারেন না। আইনজীবীরা প্রধান বিচারপতির সঙ্গে চাইলেই দেখা করবেন- এমন রেওয়াজও নেই।
জাগো নিউজ : কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সদস্যরা তো এর আগে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে দেখা করেছেন।
ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ : সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা তো নিজেই বলেছিলেন, তিনি ভালো আছেন। আইনজীবীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন না। ওই পরিস্থিতিতে বারের সদস্যদের সাক্ষাৎ করা জরুরি ছিল বলে মনে করি না।
জাগো নিউজ : প্রধান বিচারপতির ছুটি এবং সর্বশেষ তার পদত্যাগ নিয়ে যা ঘটলো, তা আদালতের কতটুকু ক্ষতি করলো?
ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ : ওই ঘটনায় আদালত বা বিচার ব্যবস্থার কোনো ক্ষতি হয়েছে, তা মনে করার কোনো কারণ নেই। এতে মানুষের কোনো আস্থার ঘাটতি হয়েছে বলেও মনে করি না।
জাগো নিউজ : কিন্তু সরকারের লোকজন তো ক্ষোভ জানালেন। প্রধান বিচারপতির প্রতি বিরাগভাজন হয়ে কথা বললেন মন্ত্রীরাও।
ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ : প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা নানা মন্তব্য করে বিতর্ক সৃষ্টি করে আসছিলেন আগে থেকেই। এভাবে আর কোনো প্রধান বিচারপতি জনসম্মুখে কথা বলেননি। ভারত-আমেরিকার দিকে তাকান। কোনো বিচারপতিকে এভাবে মন্তব্য করতে দেখা যায়নি।
জাগো নিউজ : ভারত-আমেরিকার বিচার ব্যবস্থার সঙ্গে আমাদের বিচার ব্যবস্থার তুলনা চলে?
ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ : তাই বলে একজন প্রধান বিচারপতি চাইলেও সব বিষয়ে জনসম্মুখে কথা বলতে পারেন না। তার পদের তো ওজন আছে। সাংবিধানিক পদ তার। তার সঙ্গে যুদ্ধাপরাধী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পরিবারের সদস্যরা সাক্ষাৎ করলেন। ওই পরিবারের সদস্যদের কথা মতো ট্রাইব্যুনাল থেকে শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিককে সরিয়ে রাখলেন। শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক যখন এস কে সিনহার কাছে বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলেন, তখন তিনি বললেন, সাকার পরিবার চাইছে না আপনি থাকেন।
এটি তো কোনো নীতির মধ্যে পড়ে না। চাইলেই আসামিপক্ষের অনুরোধে একজন বিচারপতিকে বিচারকাজ থেকে সরিয়ে রাখা যায় না।
জাগো নিউজ : পানি তো ঘোলা হলো? তাহলে এস কে সিনহার কারণেও তো মানুষের আস্থা কমলো বিচার ব্যবস্থার প্রতি?
ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ : আমাদের সমাজ, রাজনীতি, বিচার ব্যবস্থায় এমন ঘটনা নতুন নয়। একটি ঘটনা দিয়ে সামগ্রিক বিচার ব্যবস্থাকে মূল্যায়ন করা ঠিক হবে না। এসব ঘটনায় সাধারণ মানুষের আস্থা কমবে বলে মনে করার কোনো কারণ নেই।
এএসএস/এসআর