ক্যাম্পাস

দিনটি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের একযুগ পূর্তির

বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে একযুগ পূর্ণ হলো পুরনো ঢাকার ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের। শুক্রবার (২০ অক্টোবর) বিশ্ববিদ্যালয় ১২বছর পূর্ণ করলেও প্রতিষ্ঠানটি ১৫৯ বছর আগে ‘ঢাকা ব্রাহ্ম স্কুল’ নামে যাত্রা শুরু করেছিল। গৌরব, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের জগন্নাথকে আজকের এই দিনে কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপ দেয়া হয়। ২০০৫ সালের ২০ অক্টোবর জাতীয় সংসদে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় আইন পাসের মাধ্যমে ‘জগন্নাথ কলেজ’ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত হয়।

Advertisement

অনাবাসিক হিসেবে যাত্রা শুরু করা বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীরা প্রতিনিয়ত মেধামননে তাদের অবস্থান প্রমাণ করে এসেছেন । জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ৩৫তম বিসিএস পরীক্ষায় সংখ্যাগরিষ্ঠতায় ২য় স্থান অর্জন করে এবং ৩৬তম বিসিএসেও ব্যাপক সাফল্যের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটির গৌরবকে শাণিত করেছে।

এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে ২০১২ সালে বিশ্ববিদ্যালয় আইনের ২৭/৪ ধারা (নিজস্ব আয়ে চলা) বাতিল করতে বাধ্য হয় সরকার। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে শিক্ষা মন্ত্রণালয় চলতি বছর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়কে অাধুনিক ও বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করতে ২০০ একর জমি অধিগ্রহণের অনুমতি দিয়েছে। ঢাকা জেলা প্রশাসকের সহায়তায় এই জমি অধিগ্রহণ করবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

এদিকে নানা সঙ্কটের মধ্যেই জবির একমাত্র নির্মাণাধীন আবাসিক ‘বঙ্গমাত বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব হল’ এর কাজ চলছে। ২০ তলা ভিত্তির উপর ১৬ তলার এই হলটি ইতোমধ্যে ১০ম তলার কাজ চলছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০১৮ সালের শেষের দিকে হলটি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের হাতে হস্তান্তর করা হবে।

Advertisement

সেইসঙ্গে ২০ তলা ভিত্তির উপর ১৩ তলাবিশিষ্ট নতুন ভবনের (বিজনেজ স্টাডিজ ভবন) ঊর্ধমুখী সম্প্রসারণ শেষের দিকে। চলছে ১৩ তলা থেকে আরও উপরে সম্প্রসারণের পরিকল্পনা। এ নিয়ে বুয়েটের কাছে অনুমোদনের জন্য আবেদন জানিয়েছে শিক্ষাপ্রকৌশল অধিদফতর।

বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রশংসা করে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক আব্দুল মান্নান বলেন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান অনেক বৃদ্ধি পাচ্ছে। নীরবে শিক্ষাকেন্দ্রিক বিপ্লব ঘটাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। আগামী কয়েক বছর পর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় আরও গর্ব করার মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রূপ নেবে।

শিক্ষার্থীদের অর্জন নিয়ে বিশ্ববিদ্যায়লয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান বলেন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় একটি অপার সম্ভাবনাময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানটি পুরান ঢাকার মূল সংস্কৃতিক বলয়ে পরিণত হবে।

তবে সম্ভাবনাময় এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাছে পরিতাপের বিষয় হিসেবে বিবেচিত হয়েছে যে তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের এক যুগ পূর্তি হলেও এখন পর্যন্ত একটি সমাবর্তনও পাননি তারা।

Advertisement

ব্রাহ্ম স্কুল থেকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

পুরান ঢাকার আরমানিটোলায় ব্রাহ্ম সমাজের নিজস্ব প্রাঙ্গণে ১৮৫৮ সালে ব্রাহ্ম ধর্মের মূল মতবাদ সম্পর্কে সাধারণ ছাত্রদের জানানোর জন্য চালু হয় অবৈতনিক ‘ঢাকা ব্রাহ্ম স্কুল’। পরবর্তীতে প্রতিষ্ঠানটি আর্থিক সঙ্কটে পড়ে। যার কারণে মালিকানা পরিবর্তন করে ব্রাহ্ম স্কুলের ভার ১৮৭২ সালে তুলে দেয়া হয় বালিয়াটির জমিদার কিশোরী লাল রায় চৌধুরীর হাতে। কিশোরী লাল জমিদারের বাবার নামে এর নতুন নাম হয় ‘জগন্নাথ স্কুল’।

এরপর ১৮৮৪ সালে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দ্বিতীয় ও ১৯০৮ সালে প্রথম শ্রেণির কলেজে উন্নীত হয়। ১৯২০ সালে ইন্ডিয়ান লেজিসলেটিভ কাউন্সিল ‘জগন্নাথ কলেজ আইন’ পাস করে। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর জগন্নাথ কলেজে স্নাতক শিক্ষা বন্ধ করে ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত শিক্ষা সীমিত করা হয়। ১৯৪২ সালে মেয়েরাও জগন্নাথ কলেজে ভর্তির সুযোগ পান। পরে দরিদ্র শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার পাশাপাশি কাজের সুযোগ দিতে জগন্নাথ কলেজে প্রথম নৈশকালীন পাঠদান শুরু হয়।

১৯৬৮ সালে জগন্নাথকে সরকারি (প্রাদেশিকীকরণ) করা হয়। ১৯৬৯ এর গণঅভুত্থানে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ১১ দফায় এর বিরোধীতা করলে ওই বছরই কলেজটি আগের অবস্থায় ফিরে যায়। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে জগন্নাথ কলেজকে আবারও স্নাতক (সম্মান) এবং স্নাতকোত্তর পর্যায়ে উন্নীত করা হয়।

১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর থেকে পুরান ঢাকার বেশকিছু পরিত্যক্ত হিন্দু বাড়িকে জগন্নাথ কলেজের শিক্ষার্থীরা হল হিসেবে ব্যবহার করে আসছিলেন। কিন্তু আশির দশকের পরে সেগুলো হাতছাড়া হয়ে যায়। বেদখল হয়ে যাওয়া হল পুনরুদ্ধারের দাবিতে বেশ কয়েকবার আন্দোলন করে জগন্নাথ বিম্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এর ধারাবাহিকতায় দুটি হল দখলমুক্ত হলেও তা এখন পর্যন্ত ব্যবহার উপযোগী হয়নি।

রাষ্ট্রে জগন্নাথের অবদান

ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সময় এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অনেক শিক্ষক ক্ষমতাসীনদের রোষের শিকার হন। ভাষা শহীদ রফিক এ কলেজের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন। ছয় দফা আন্দোলন, বাষট্টির শিক্ষানীতি বাতিল আন্দোলন, ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান ও মুক্তিযুদ্ধে জগন্নাথের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল।

মুক্তিযুদ্ধের সময় এ কলেজকে ‘ক্যাম্প’ হিসেবে ব্যবহার করে পাকিস্তানি বাহিনী। স্বাধীনতার পরে কলেজের ছাত্র সংসদ ভবনের কাছে গণকবরেরও সন্ধান পাওয়া যায়।

জানা যায়, ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর সাবেক জগন্নাথ কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ অনেককেই ঢাবিতে নিয়ে যাওয়া হয়। এ প্রতিষ্ঠানের লাইব্রেরি থেকে অসংখ্য বই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে দেয়া হয়েছিল।

একযুগ পূর্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্ণিল আয়োজন

শুক্রবার (২০ অক্টোবর) বিশ্ববিদ্যালয়টি এক যুগে পূর্তি হলেও এর উদযাপন করা হবে একদিন পিছিয়ে ২২ অক্টোবর (রোববার)। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন জানিয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ডি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা শুক্রবার হওয়ায় জবির যুগপূর্তি অনুষ্ঠান পেছানো হয়েছে।

রোববার সকাল ৯টা ১০ মিনিটে জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে জাতীয় পতাকা উত্তোলন ও সেইসঙ্গে বেলুন-পায়রা উড়িয়ে বিশ্ববিদ্যালয় দিবসের শুভ উদ্বোধন করবেন উপাচার্য অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান। সকাল সাড়ে ৯টায় প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর সুসজ্জিত শোভাযাত্রা উপাচার্যের নেতৃত্বে শহীদ মিনার চত্বর হতে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করে রায়সাহেব বাজার মোড় ঘুরে ভিক্টোরিয়া পার্ক পরিভ্রমণ করে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এসে শেষ হবে।

এরপর বেলা ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয় সংগীত বিভাগের উদ্যোগে সংগীতানুষ্ঠান, বেলা ১২টায় আলোচনা সভা এবং দুপুর ১টা থেকে ৩টা পর্যন্ত নাট্যকলা বিভাগের উদ্যোগে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বিজ্ঞান ভবন চত্বরে অনুষ্ঠিত হবে।

এছাড়াও সন্ধ্যায় দেশের সনামধন্য কণ্ঠশিল্পী বাপ্পা মজুমদারের ব্যান্ডদল ‘দলছুট’ নিয়ে জমজমাট কনসার্টের আয়োজন করা হয়েছে।

এসএম/জেডএ/আইআই