নতুন ভ্যাট আইন কার্যকরের সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে সরকারকে আরও ভাবা উচিত ছিল। তাহলে বাস্তবসম্মত ভ্যাট আইন বাস্তবায়নে সক্ষমতার অভাবে বারবার হোঁচট খেত না। গত বছরও প্রস্তুতি না থাকায় আইনটি বাস্তবায়ন করতে পারেনি সরকার। এ বছরও তাই হচ্ছে। তবে আইনটি বাস্তবায়ন না হলে অর্থনীতিতে তেমন কোনো সমস্যা হবে না বলে মনে করেন দেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদরা।
Advertisement
একই সঙ্গে সক্ষমতা বাড়িয়ে আইনটি বাস্তবায়ন জরুরি বলে মত দেন তারা।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এখন নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন না হলে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে না। বাজেটটি যেহেতু প্রস্তাবিত, চূড়ান্ত পাসের সময় তা পরিবর্তন করতেই হতো। এখন নতুন করে বাজেটের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা পুনর্গঠন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, এ পরিবর্তন যেন অন্যের ঘাড়ে বোঝা না হয়। এর মানে শুল্ক, ভ্যাট ও করের হার না বাড়িয়ে আওতা বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে তা আদায় নিশ্চিত করতে হবে বলেও মনে করছেন তারা।
২০১২ সালে নতুন ভ্যাট আইন পাস হলেও বাস্তবায়নে সক্ষমতা না থাকায় দীর্ঘদিন সেটি ঝুলে ছিল। আগামী অর্থবছরে নতুন মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট আইন চালুর কথা থাকলেও তা স্থগিতের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। ফলে আগামী ১ জুলাই থেকে আইনটি বাস্তবায়নের কথা থাকলেও তা আর হচ্ছে না। আগামী ২০১৭-১৮ অর্থবছরে চলমান ১৯৯১ সালের ভ্যাট আইনটিই বলবৎ থাকছে। তবে এ আইনের মধ্য থেকেই বাড়ানো হবে ভ্যাটের আওতা ও পরিধি। জোর দেয়া হবে অটোমেশন (স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা) পদ্ধতির ওপর।
Advertisement
আর নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন না হলে প্রস্তাবিত বাজেটে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্র পূরণে ২০ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি পড়ে যাবে।
এসব বিষয়ে দেশের চার বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ জাগো নিউজের কাছে তাদের মতামত ব্যক্ত করেন।
এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না। ভ্যাট আইন নিয়ে এমনটি হয়েছে। সরকার বাস্তবায়নের ঘোষণা দিয়ে এখন দেখছে এটা সম্ভব নয়। এ কারণে নতুন ভ্যাট আইন থেকে পিছিয়েছে সরকার।
Advertisement
বর্তমান পরিস্থিতিতে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা পুরোপুরি অর্জিত হবে না। এতে কোনো সমস্যা নেই। কারণ আগের অর্থবছরগুলোতেও রাজস্ব আদায় না হওয়ার রেকর্ড রয়েছে। বরং সরকারের উচিত অর্জিত রাজস্ব ব্যয়ের সক্ষমতা বাড়ানো।
ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, প্রস্তুতি না থাকার কারণেই নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন থেকে সরে এসেছে সরকার। ভ্যাটের হার সহনীয় রেখে আইনটি বাস্তবায়ন করা উচিত ছিল।
যেহেতু নতুন ভ্যাট আইন চালু হচ্ছে না। তাই আগের আইনই বহাল থাকবে। ফলে অর্থনীতিতে তেমন প্রভাব পড়বে না।
তিনি বলেন, নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন না হলে প্রস্তাবিত বাজেটে রাজস্ব আহরণ ও ঘাটতির বিষয়ে কিছু কাটছাট করতে হবে। যেহেতু এটা প্রস্তাবিত বাজেট, তা পরিবর্তন হতেই পারে। কিন্তু এ পরিবর্তন যেন অন্যের ঘাড়ে বোঝা না হয়। অর্থাৎ শুল্ক, ভ্যাট ও করের হার না বাডিয়ে আওতা বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে আদায় নিশ্চিত করতে হবে। এতে রাজস্ব ঘাটতি পূরণ সহজ হবে।
ড. জাহিদ হোসেন
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেন, নতুন ভ্যাট আইন নিম্ন আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতার ওপর আঘাত করত না। কারণ তারা যেসব পণ্য ব্যবহার করে, তার অধিকাংশই ভ্যাটের আওতামুক্ত ছিল। এছাড়া নিম্ন আয়ের মানুষরা যেসব জায়গা থেকে কেনাকাটা করেন, সেসব প্রতিষ্ঠানের টার্নওভার কম হওয়ায় ভ্যাটের আওতার বাইরে রাখা হয়েছিল। ফলে তাদের ক্রয়ক্ষমতার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা ছিল না।
তিনি বলেন, সক্ষমতার অজুহাতে ভ্যাট আইন বাস্তবায়নে পাঁচ বছর পিছিয়েছে সরকার। আর পেছানো ঠিক হবে না। বাস্তবায়ন শুরু হলে সক্ষমতাও গড়ে উঠবে।
আব্দুল মজিদ
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল মজিদ বলেন, নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়নে প্রস্তুত ছিল না এনবিআর’র। এছাড়া ব্যবসায়ী সংগঠনসহ বিভিন্ন মহল থেকে তা বাস্তবায়নের সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। সামনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন, সবকিছু বিবেচনায় আইনটি চালু করা সরকারের পক্ষে রিক্স ছিল। তাই নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন থেকে সরে এসেছে তারা। অর্থাৎ পুরোপুরি প্রস্তুত বা সক্ষমতা না থাকায় এটি চালুর ক্ষেত্রে প্রতি বছর যেরকম পেছায় এ বছরও সেভাবে পেছাচ্ছে।
তিনি বলেন, যেহেতু নতুন আইনটি এখনও বাস্তবায়ন হয়নি। তাই অর্থনীতিতে এর প্রভাব তেমন পড়বে না। এখন প্রস্তাবিত বাজেটে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা কিছুটা চেঞ্জ করতে হবে। এতে বড় ধরনের কোনো সমস্যা হবে না।
আগামী ১ জুলাই আইনটি চালু না হলে সরকার এক বছর সময় পাবে; এ সময়ের মধ্যে ভ্যাট আইন বাস্তবায়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের প্রশিক্ষণ দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন এনবিআরের সাবেক এ চেয়ারম্যান। যাতে আগামীতে নতুন ভ্যাট আইন চালুতে কোনো সমস্যা না হয়।
এসআই/এমএআর/বিএ