মতামত

ভেজাল ওষুধে অসহায় জীবন

ভেজালের সাথে বাঙালির সখ্য মনে হয় বহু পুরোনো। না হলে কিশোর কবি সুকান্ত সেই বহুকাল আগে কেন লিখবেন “ভেজাল, ভেজাল ভেজাল রে ভাই, ভেজাল সারা দেশটায় / ভেজাল ছাড়া খাঁটি জিনিস মিলবে নাকো চেষ্টায়!”  কবি মনে হয় সেই শতাব্দীকাল পূর্বেই আমাদের চারিত্র্যিক এ অধঃপতনের শুরুটা দেখতে পেয়েছিলেন। আজ তাই প্রশ্ন জাগে মনে, দিনে দিনে আমরা কিভাবে আরো এত  অধঃপতনে নেমে যাচ্ছি যে, বর্তমানে নকল ও ভেজাল ওষুধ তৈরি এবং তা বিক্রি করতে আমাদের বিবেকে একটুও বাধছে না?

Advertisement

সত্যিই আজ ভেজালময় একটা পরিবেশে আমরা বেড়ে উঠছি। ভেজাল আমাদের কর্মে, ভেজাল আমাদের মর্মে। খাবারের ভেজাল নিয়ে তো রীতিমত আতঙ্ক মানুষের মনে মনে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে এখন ভেজাল ওষুধ নামক বিষবৎ জিনিসের ভয়াবহ আতংক। পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে  যখন হামেশাই মানহীন, ভেজাল এবং নিম্নমানের ওষুধের তথ্য  দেখতে পাই তখন আমরা স্বাভাবিকভাবেই অবাক হয়ে যাই। তবে চিকিৎসকেরা শুধু অবাকই হন না তারা বিস্মিতও হন বটে। কারণ চিকিৎসকেরাই তো শেষমেষ রোগীর কাছে জবাবদিহিতার সম্মুখীন হন। যথাযথ ওষুধ প্রয়োগের পরেও যদি রোগী ভালো না হন তাহলে চিকিৎসকের বিস্ময়ের কি আর সীমা থাকে বলুন? তাছাড়া ভেজাল ওষুধ খেয়ে রোগী মারা গেলে তো রোগীর মৃত্যুর দায়ভারও চিকিৎসকের কাঁধে আসার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। রোগীর লোকজন ধরে নিতে পারে যে, চিকিৎসকের ভুল চিকিৎসার কারণে রোগীর মৃত্যু হয়েছে! এ এক উদ্ভট বাস্তবতা।

প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দিয়ে রোগীকে ভালো করে তুলতে হলে সঠিক রোগ নির্ণয় করে অতঃপর যথাযথ ওষুধ  প্রয়োগ করা খুবই দরকার-এটা সবাই জানেন। কিন্তু যে সর্ষে দিয়ে আপনি ভূত তাড়াবেন তাতেই যদি ভেজাল থাকে তাহলে কিভাবে ভূত তাড়াবেন বলুন? অর্থাৎ ওষুধ যদি হয় ভেজাল ও নিম্ন মানের তাহলে রোগ নিরাময়ের হাজার চেষ্টা করেও কি কোনরকম লাভ হবে? উত্তর হচ্ছে,  লাভ তো হবেই না বরং উল্টো ভেজাল, নকল এবং নিম্নমানের ওষুধ খেয়ে রোগীর স্বল্পমেয়াদী থেকে দীর্ঘমেয়াদী শারীরিক ও মানসিক ক্ষতিসহ মৃত্যুও হতে পারে। সঠিক চিকিৎসা দিয়েও রোগী যখন ভালো হয় না অথবা ক্ষতিগ্রস্থ হয় বা মৃত্যু হয় তখন অধিকাংশ সময়ই দেখা যায়, আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশসমূহে দায়ভার শেষমেষ চিকিৎসকের উপরে গিয়ে বর্তায় এবং ঢালাওভাবে তাদেরকে দায়ী করে তাদের শাপশাপান্ত করা হয়।এমনকি তারা শারীরিক লাঞ্ছনারও শিকার হন! প্রকৃত সত্যটা এখানে মানুষের চিরায়ত ধারণার কাছে চাপা পড়ে যায়।

খাবারে ভেজাল থাকলে সে খাবার আপনি না খেয়ে এড়িয়ে যেতে পারেন। কিন্তু চিকিৎসা চলাকালীন যে ওষুধ আপনি কিনছেন তাতে যদি ভেজালও থাকে তাহলেও তো তা আগেভাগে জানার সুযোগ নেই। খাওয়ার পরে হয়ত উপকার  না হলে বা রোগী ক্ষতিগ্রস্থ হলে বা দুঃখজনকভাবে যদি তার মৃত্যু হয় তাহলেই হয়ত কেবলমাত্র সন্দেহ হতে পারে যে ওষুধটাতে ভেজাল থাকলেও থাকতে পারে। আর রোগীর অবস্থা যদি আগে থেকেই গুরুতর হয়ে থাকে তাহলে তো সে সন্দেহ করারও অবকাশ থাকে না!

Advertisement

ভেজাল, মানহীন বা নিম্নমানের ওষুধ তৈরি, বাজারজাত এবং বিক্রি করতে পারার সুযোগ পাওয়া মানেই হচ্ছে দেশময় বৈধভাবে মানুষ হত্যা করার অবারিত সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়া। সন্ত্রাসীর হাতে অস্ত্র থাকলে তা দিয়ে কতিপয় মানুষ খুন করা যায় কিন্তু ওষুধ যদি হয় নিম্নমানের, নকল আর ভেজালে পূর্ণ তাহলে তা দিয়ে একটা গোটা রাষ্ট্রকেই পঙ্গু করে দেয়া যায়। শহরের চেয়ে গ্রামে এ ভেজাল ওষুধের লোভনীয় ব্যবসা চলছে গ্রাম্য হাতুড়ে ডাক্তারদের মাধ্যমে। মিটফোর্ড থেকে এ ভেজাল ওষুধ নাকি ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশময়। অথচ বিশ্বের ১০৭টি দেশে আমাদের উৎপাদিত ওষুধ রপ্তানি হচ্ছে। আর আমরা দেশের ভেতরে ভেজাল ওষুধের কাছে রীতিমত অসহায় হয়ে পড়ছি। কি লজ্জা! কি লজ্জা!

আমাদের দেশে ওষুধ উৎপাদনের নামে এমন প্রাণঘাতী কর্মকাণ্ড  কিভাবে চলছে-এ প্রশ্ন তাই সামনে এসেই যায়। প্রশ্ন জাগে, এসব দেখার কি কেউ নেই? নাকি সব সম্ভবের দেশ বলে যে বদনাম আমাদের আছে সেটা সত্যি প্রমাণ করতে ফ্রিস্টাইলে যা ইচ্ছা তা করে পার পেয়ে যাওয়ার প্রবণতার কারণে এসব ঘটছে? এর উত্তর একক নয় বরং  মিশ্র। অর্থাৎওষুধের মান নিয়ন্ত্রণ করার অথরিটি আছে, তারা কাজও যে করছে না তাও কিন্তু নয়। কিন্তু তাদের সংক্ষমতা অত্যন্ত কম। তারা চাইলেও সব ওষুধের মান তদারকি করতে পারে না। আর এর সুযোগটাই নিচ্ছে কতিপয় ওষুধ প্রস্তুতকারক ব্যবসায়ী নামক অতি লোভী, মুনাফাখোর। চাইলে  তাদেরকে কি  লাইসেন্সধারী সন্ত্রাসী বলা যায়?  বলা না বলাটা আপনার মন মর্জির ওপর ছেড়ে দিয়ে বরং  ঐ যে আমি বললাম  আমাদের ওষুধ নিয়ন্ত্রণকারী অথরিটি নামক যন্ত্রটির সক্ষমতার ঘাটতি আছে সেটা পরিষ্কার করতে আসুন একটু পরিসংখ্যানের দিকে তাকাই। তাহলে আপনিও বুঝতে পারবেন যে, চাইলেও কেন এ অথরিটি সকল ওষুধের মান নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না।

আমাদের দেশে নাকি বর্তমানে ২৪৬ টি অ্যালোপ্যাথিক, ২২৪টি আয়ুর্বেদিক, ২৯৫টি ইউনানী ও ৭৭টি হোমিওপ্যাথিকসহ মোট ৮৪২ ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে ৭০০ প্রতিষ্ঠানই নাকি ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ তৈরি করছে। আর এদের সাথে আছে লাইসেন্সবিহীন অসংখ্য ভেজাল ও নকল ওষুধ তৈরির কারখানা। (সূত্র: জাতীয় ভেজাল প্রতিরোধ ফাউন্ডেশন) প্রতি বছর নাকি ১২ হাজার রকম আইটেমের ওষুধ বাজারে আসছে।  কিন্তু ওষুধ প্রশাসনের যে লোকবল ও যন্ত্রপাতি রয়েছে তাতে তারা মাত্র সাড়ে ৩ হাজার আইটেমের ওষুধ পরীক্ষা করতে পারে। বাকি ৭০ শতাংশ ওষুধের মান তাই যাচাইহীন অবস্থায় রয়ে যায়। (সূত্র: সম্পাদকীয়, জাগো, ২৮/২/১৭)।  বুঝুন  এবার তাহলে কি ভয়ানক ওষুধ নামক জৈবিক ও রাসায়নিক মারণাস্ত্র খেয়ে আমরা অসুখ সারানোর চেষ্টা করছি! এমন ওষুধে অসুখ সারবে কি! নাকি উল্টো অসুখের মাত্রা ও ধরন বদলে তা ভয়ঙ্করী হয়ে জীবন সংহার করতে পারে?

আমাদের দেশে এ যাবৎকাল নকল ও ভেজাল ওষুধের কারণে কত লোকের প্রাণহানি ঘটেছে তার সঠিক কোন পরিসংখ্যান নেই। তবে বলা হয়ে থাকে গত ২৭ বছরে (২০১৬ সাল অবধি) ভেজাল প্যারাসিটামল খেয়ে কয়েক হাজার শিশুর মৃত্যু হয়েছে। প্যারাসিটামল খেয়ে কিডনি বিকল হয়ে শিশুমৃত্যুর খবর আমরা প্রথম জানতে পারি ১৯৯২ সালে কিডনিরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ হানিফ স্যারের গবেষণা থেকে। সে বছর অ্যাডফ্লেম নামক কোম্পানির তৈরিকৃত “ফ্লামোডল” নামক ভেজাল প্যারাসিটামলে খেয়ে অনেক শিশুর মৃত্যু হয়। পরে সে প্যারাসিটামল সিরাপে ডাই ইথিলিন গ্লাইকল এর উপস্থিতি ধরা পড়লে এ কোম্পানির বিরুদ্ধে ১৯৯৩ সালে মামলা হয়। অবশেষে ২০১৪ সালে দীর্ঘ ২২ বছর পর প্রতিষ্ঠানটির পরিচালকসহ  তিন জনের ১০ বছর করে সাজা হয়।

Advertisement

তবে, এত কিছুর পরে আমরা ধরে নিয়েছিলাম আর হয়ত ভেজাল ওষুধ তৈরি করতে কেউ  সচেষ্ট হবে না। কিন্তু অবাক করা ব্যাপার হলো ২০০৯ সালে জুন থেকে আগষ্ট মাস অবধি রিড ফার্মা নামক কোম্পানীর বিরুদ্ধে একই রকম অভিযোগ উঠে যে তাদের তৈরি ভেজাল প্যারাসিটামল খেয়ে ২৮ টি  শিশুর মৃত্যু হয়েছে। ঐ বছরের আগস্ট মাসেই ৫ জনকে দায়ী করে ড্রাগ আদালতে  যে মামলা হয় ২০১৬  সালের ২৭ নভেম্বর সে মামলায় আসামিরা বেকসুর খালাস পেয়ে যায়। খুব দুঃখজনক ব্যাপার বটে! যেখানে একজনকে খুনের অপরাধে সাজা হয় মৃত্যুদণ্ড সেখানে এতো গুলো শিশুর মৃত্যু হলো যাদের ভেজাল ওষুধ তৈরির কারণে তারা  একদম বেকসুর খালাস পায় কিভাবে?

অ্যাডফ্লেমের কেসে তাও তো অন্তত ১০ বছর করে সাজা হয়েছিলো আর রিড ফার্মার ক্ষেত্রে সব আসামি একদম বেকসুর খালাস!! বলিহারি যাই!  রিড ফার্মার  মামলার রায়ে আদালত অবশ্য বাদীপক্ষের অযোগ্যতা, অবহেলা ও অদক্ষতাকে আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ার কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। একই রকম অভিযোগে ওঠায় বিসিআই (বেঙ্গল কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ) এবং পলিক্যাম ফার্মাসিউটিক্যালস এর বিরুদ্ধে ৪টি মামলা এখনো ঝুলে আছে। সিটি ফার্মাসিউটিক্যালস নামক আরো একটি কোম্পানির বিরুদ্ধে এমন একটা মামলা হলেও সব অভিযুক্তরাই বেকসুর খালাস পান। এদিকে মামলা চলমান অবস্থায় পলিক্যাম ফার্মাসিউটিক্যালস নাম বদলে লিয়ন ফার্মাসিউটিক্যালস নামে ওষুধ উৎপাদন ও তা বাজারজাতকরণ করে চলেছে। (সূত্র: ২৩, জুলাই, ২০১৪; দৈনিক কালের কণ্ঠ)

এই যখন অবস্থা তখন করণীয় নির্ধারণ করা জরুরি প্রয়োজন। কারণ ওষুধ নামক জীবন রক্ষাকারী জিনিস যদি ভেজাল আর নিম্নমানের হয় তাহলে তা নিঃসন্দেহে জীবন সংহারী হয়ে ওঠে। এমতাবস্থায় ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরকে আরো শক্তিশালী করা, আইনের কঠোর প্রয়োগ,  জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং চিকিৎসা পেশার সাথে জড়িত  সকলকে ঐক্যবদ্ধ করে এ দুর্বৃত্তায়নকে রুখে দেয়ার বিকল্প নেই। চিকিৎসকদের দায়িত্ব রোগীকে  প্রেসক্রিপসনে লেখা ঐ ওষুধটিই কিনতে  উৎসাহিত করা এবং নতুন করে গজিয়ে ওঠা ওষুধ কোম্পানির ওষুধ লিখতে আরো সতর্ক হওয়া।

এখন হাসপাতালগুলোতে মডেল ফার্মেসি চালু হচ্ছে। খুব দ্রুত সেগুলোকে দেশময় ছড়িয়ে দিতে হবে। তাহলে আমরা সহজেই গুণগত ও মানসম্পন্ন ওষুধ কিনতে পারবো। সঠিক ওষুধ প্রাপ্তি জনগণের একটা মৌলিক অধিকার। কোনোভাবেই কেউ যেন তা ক্ষুণ্ন না করতে পারে সে ব্যাপারে রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিরা আশু উদ্যোগী হবেন বলে বিশ্বাস করি। অতীতের খারাপ যেন কোনোভাবেই  আমাদের অপার সম্ভাবনার ভবিষ্যতকে নষ্ট না করতে পারে সে কামনা করি।

ভেজালমুক্ত হোক আমাদের মন। ভেজালমুক্ত হোক আমাদের চারপাশ। লোভের কাছে যেন মনুষ্যত্বের এমন নিকৃষ্টতম বলি না হয় সে ব্যাপারে সবাইকে সজাগ ও সতর্ক থাকতে হবে।লেখক : চিকিৎসক।

এইচআর/আরআইপি