দেশজুড়ে

বিরল রোগে আক্রান্ত শাহাদাত

‘এতটা ব্যথা নিয়ে বাস করা আমার জন্য খুব কঠিন। ঘাড়সহ শরীরে নানা জায়গায় চুলকানির সঙ্গে অনেক ভোগান্তি তো রয়েছেই, এর ওপর শরীরটা ভারী ভারী লাগে। যে কেউ আমাকে দেখে দূরে সরতে চেষ্টা করে। রাস্তায় হাঁটতে পারি না। আমার সঙ্গে কেউ কথা বলতে চায় না। বাচ্চারা যখন আমাকে দেখে, তারা শুধু ভূত বা দৈত্য বলে দৌড়ে পালায়।’বিরল রোগে আক্রান্ত সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার চরকাদাই গ্রামের তিন সন্তানের জনক শাহাদাত হোসেন (৫৩) ক্ষোভের সঙ্গে এ কথাগুলো বলেন।তিনি আরো বলেন, আমি খুব বেশি বাইরে বের হয় না, শিশুরা আমাকে দেখলে ভয় পায়। এক সময় আমার এ অবস্থা ছিল না, আমি তরুণ বয়সে সুদর্শন ছিলাম। আজকাল আমার ছেলে আবদুল্লাহ আমার সঙ্গে কথা বলতে আসে না। আমি জানি, কেন সে এমন করে, তবে আমি আমার ছেলে বা পরিবারের জন্য কিছুই করতে পারছি না। আমি খুব খারাপ বোধ করি, রাতে আমি চিন্তায় ঘুমাতে পারি না।শাহাদাত হোসেনের বয়স যখন ১৩ বছর তখন তার চোখের উপরে একটি ছোট গুটি দেখা যায়। আস্তে আস্তে গত ৩৫ বছরে শরীরের সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে গুটিগুলো। মুখ বিকৃত হওয়ায় খেতে পারেন না স্বাভাবিকভাবে। এ কারণে এখন ঠিকমত চোখেও দেখতে পারেন না। চলাচল করতে অনেক কষ্ট। আগে মাটি কেটে সংসার চালাতেন এখন সেটাও পারেন না। বিভিন্ন সময় চিকিৎসা করালেও তিনি সুস্থ হননি। দুই মেয়েকে বিয়ে দিলেও এক ছেলেকে নিয়ে খুব কষ্টে দিন চলে তার। রোগটি থেকে মুক্তি পেতে চান দিনমজুর শাহাদাত।শাহাদাত হোসেনের স্ত্রী তাজমহল খাতুন (৩৯) বলেন, আমার স্বামীর মাথা থেকে শুরু হওয়া এ রোগের বিস্তার দিন দিন ভয়ংকর হওয়ার পর্যায়গুলো আমি দেখেছি। কিন্তু আর্থিক অভাবে তাঁর চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে ব্যর্থ হয়েছি। আমাদের করুণ অবস্থা দেখে গ্রামবাসী জামা-কাপড় নিয়ে আসেন এবং ছোটখাটো সাহায্যমূলক কাজকর্ম করে দেন। এর মাধ্যমে আমরা কোনোমতে জীবিকা নির্বাহ করছি।শাহাদাতের এমন অবস্থার খবর ফেসবুক দিয়ে স্থানীয় মামুন বিশ্বাস নামের এক ব্যক্তি এগিয়ে আসেন। তিনি ফেসবুকে প্রচার চালিয়ে তহবিল সংগ্রহ শুরু করেন। মামুন বিশ্বাসের ফেসবুকে পোস্ট দেখে সিরাজগঞ্জ জেলা প্রশাসক কামরুন নাহার তাঁকে দেখতে যান ও শাহাদাৎ হোসেনকে চিকিৎসার আর্থিক অনুদান দেন এবং একটি বয়স্ক ভাতার কার্ড দেওয়ার জন্য উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে নির্দেশ দেন।এ ছাড়া ফেসবুকে শাহাদাতের পোস্ট দেখে সিরাজগঞ্জ সিভিল সার্জন ডা. শেখ মো. মনজুর রহমান তাকে দেখার জন্য তার বাড়ি পরিদর্শন করেছেন। পরিদর্শন শেষে ৭ ফেব্রুয়ারি শহীদ এম মনসুর আলী সরকারি মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সৈয়দ মনোয়ার আলীর নেতৃত্বে গঠিত তিন সদস্যের মেডিকেল বোর্ড গঠন করে শাহাদাৎ হোসেনকে পরীক্ষা করে নিউরোফাইব্রোমেটোসিস রোগ হিসেবে চিহ্নিত করে তাকে উন্নত চিকিৎসার সুপারিশ করেন।সিরাজগঞ্জ জেলা প্রশাসক ও সিভিল সার্জনের যৌথ উদ্যোগে ঢাকায় নিউরোসায়েন্স ইনস্টিটিউটে উন্নত চিকিৎসার জন্য শাহাদাৎকে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। আগামী ১ মার্চে উন্নত চিকিৎসার জন্য শাহাদাৎ হোসেনকে ঢাকায় নেয়া হবে।গত ১৫ ফেব্রুয়ারি মামুন বিশ্বাসের ফেসবুক থেকে সংগ্রহ করা এক লাখ চার হাজার ৮০০ টাকা জেলা প্রশাসক কামরুন নাহার সিদ্দিকার মাধ্যমে শাহাদাতের পরিবারের কাছে তুলে দেয়া হয়েছে।জেলার সিভিল সার্জন ডা. শেখ মো. মনজুর রহমান জানান, আগামী মাসেই শাহাদাৎ হোসেনকে চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নেয়া হচ্ছে। রোগটি কোনো অজানা রোগ নয়, এর সঠিক চিকিৎসা ব্যবস্থা রয়েছে। এই রোগের নাম নিউরোফাইব্রোমেটোসিস (Neurofibromatosis)। তবে এটি বংশগতভাবে হয়ে থাকলেও কোনো ছোঁয়াচে রোগ নয় বলে তিনি জানান।আরএআর/এমএস

Advertisement