ভ্রমণ

অবহেলায় ২০০ বছরের তাড়াশ ভবন, কবে হবে জাদুঘর

অবহেলায় ২০০ বছরের তাড়াশ ভবন, কবে হবে জাদুঘর

অযত্ন-অবহেলায় পড়ে আছে পাবনার সবচেয়ে প্রভাবশালী জমিদার রায় বাহাদুর বনমালী রায়ের জমিদারি ভবন ‘তাড়াশ’। নির্মাণ ও জমিদারি প্রথা বিলুপ্তির পর নামকাওয়াস্তে ছাড়া আর কেউই নেয়নি তাড়াশ ভবনের সংস্কারের উদ্যোগ। ফলে জরাজীর্ণতার ধূসরতা খেয়ে ফেলেছে ভবনটির যৌবন। তবে এত এত অবহেলার মাঝেও দুইশ বছরের ঐতিহ্য ধরে রেখেছে প্রাচীন গ্রিক স্থাপত্যশৈলীর এ জমিদার ভবন। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের প্রস্তাবনায় আগামী বছরের মধ্যেই এটি হতে পারে এ অঞ্চলের জাদুঘর। দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা পূরণে শুধু আশ্বাসে সন্তুষ্ট নন পাবনাবাসী। দ্রুত জাদুঘর স্থাপনের দাবি তাদের।

Advertisement

সূত্র জানায়, পাবনার সবচেয়ে প্রভাব ও প্রতিপত্তিশালী জমিদার ছিলেন রায় বাহাদুর বনমালী রায়। তিনি রাজা বনওয়ারী লাল রায়ের দত্তক পুত্র ছিলেন। তাদের মূল জমিদারি আবাসস্থল ছিল তৎকালীন বৃহত্তর পাবনা ও বর্তমান সিরাজগঞ্জ জেলার তাড়াশ উপজেলায়। তবে জমিদারি দেখভালের সুবিধার্থে ১৮০০ শতকের কোনো একসময় পাবনা শহরের মূল কেন্দ্রে আব্দুল হামিদ সড়কের পশ্চিম পাশে দেড় একর জায়গার ওপর আজকের এ তাড়াশ ভবন নির্মাণ করেন। ১৯৪২ সালের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রাজা বনমালী রায়ের বংশধরেরা এ ভবনে অবস্থান নিয়েছিলেন। যেটি ১৯৯৮ সালে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আওতাধীন পুরাকীর্তি হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়। এরপর থেকে দেখভালের দায়িত্বে রয়েছে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের বগুড়া আঞ্চলিক কার্যালয়। ভবনকে ঘিরে তেমন উদ্যোগ না থাকলেও নিরাপত্তার স্বার্থে ৮ জন আনসার ও বাগানসহ টুকটাক পরিচর্যার জন্য কয়েকজন মালি রাখা হয়েছে।

সরেজমিনে জানা যায়, শহরের আব্দুল হামিদ সড়কের পশ্চিম পাশেই ঠাঁয় দাঁড়িয়ে ২০০ বছরের বেশি বয়সী তাড়াশ ভবন। মূল সড়ক থেকে নেমেই চোখে পড়বে বিশালাকৃতির অর্ধবৃত্তাকার দৃষ্টিনন্দন প্রধান ফটক। যেটি চারটি স্তম্ভ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এ ফটক দিয়ে ঢুকতেই ভবনের সামনের দুপাশে তাকালেই চোখ জুড়াবে বিভিন্ন রঙের ফুল ও তার গাছে শোভা। এরপর একটু এগোতেই নজরে আসবে চারটি রোমান স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা পূর্বমুখী দ্বিতল ভবন। অপরূপ কারুকাজ সমৃদ্ধ এ জমিদার বাড়িতে নিচতলা ও দ্বিতীয় তলায় ১০টি করে মোট ২০টি কক্ষ আছে। পর্যাপ্ত আলো বাতাস প্রবেশের জন্য ভবনের মোট ৮০টি দরজা ও ৫৩টি জানালা আছে।

নিচতলা থেকে ওপর তলায় ওঠার জন্য ভবনের উত্তর দিকে একটি কাঠের সিঁড়ি আছে। সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে হাতের ডানেই রাজার কাছারি রুম। এখানেই রাজা বিভিন্ন দরবার করতেন। দক্ষিণ-পূর্ব পাশেই রাজা বনমালী রায়ের শোবার ঘর। এ ছাড়া আশেপাশে আছে বারান্দা ও রান্নাঘর থেকে শুরু করে অন্যান্য ঘর। এসব ঘর একদমই ফাঁকা পড়ে আছে। দেখা মেলেনি রাজা বা তার পরিবারের কোনো স্মৃতি বিজড়িত জিনিস। এ ছাড়া এসব ঘরের কোনোটির জানালাই অক্ষত নেই। কাচ ও অন্য উপকরণ ভেঙে গেছে। রাজার শোবার ঘরের দেওয়ালেই দেখা দিয়েছে ফাটল। খুলে পড়তে শুরু করেছে ছাদ ও দেওয়ালের পলেস্তরা। দীর্ঘ বৃষ্টিতে ছাদ চুইয়ে পড়ে পানি। এমন দশা হলেও কয়েক বছর আগে সীমানা প্রাচীর নির্মাণের পাশাপাশি খুবই সামান্য সংস্কার হয়। উপযুক্ত সংস্কারের মাধ্যমে ভবনটির যৌবন ফেরানোর উদ্যোগ নেয়নি কেউ। এদিকে সংস্কার করে একটি জাদুঘর স্থাপন পাবনাবাসীর দীর্ঘদিনের দাবি।

Advertisement

জমিদার ভবন ও বাগান পরিচর্যার দায়িত্বে থাকা মালি মিন্টু বলেন, ‘আমি এখানে ৫ বছর ধরে আছি। ভবনটা ছাড়া এখানে দেখার মতো কিছুই নেই। তাই তেমন লোক আসে না। যারা আসেন; তারা সামনের বাগান দিয়ে ঘোরাফেরা করে ছবি তুলে চলে যান। দূর-দূরান্ত থেকে স্কুল-কলেজের শিক্ষক ও শিক্ষার্থী বা অন্য প্রতিষ্ঠান থেকে কিছু লোক আসেন। তারা ভবন ঘুরে দেখেন। কিন্তু ভেতরে ঘুরে ঘুরে ফাঁকা রুম দেখা ছাড়া আর কিছুই দেখতে পান না। অধিকাংশই ফিরে যাওয়ার সময় বলেন, এখানে একটা জাদুঘর হলে ভালো হতো।’

আরও পড়ুন নজরুলের স্মৃতি বিজড়িত বটগাছ ও ত্রিশাল  খুলনায় চরের হাটে এক বিকেল

দর্শনার্থী মামুন হোসেন বলেন, ‘অধিকাংশ সময় গেটে তালা দেওয়া দেখি। আজ নিরাপত্তারক্ষীদের বলে ঢুকে ভেতরটাও দেখলাম। ভেতরে কিছুই নেই। ভেবেছিলাম অন্তত রাজার ব্যবহৃত বা স্মৃতিবিজড়িত আসবাবপত্র মিলবে। কিন্তু সেসবের কিছুই নেই। উল্টো দেখলাম বিভিন্ন জায়গায় ফেটে গেছে। কোথাও কোথাও দেওয়াল-ছাদের পলেস্তরা খুলে পড়ছে। অথচ এগুলো সংস্কারের তেমন কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না।’

তিনি বলেন, ‘সামনের বাগানের জন্য কিছুটা ভালো লাগা কাজ করে। কারণ এ শহরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার মতো একটা জায়গা নাই। বনমালী রায়ের ভবনটি সংস্কার করে যদি জাদুঘর করা যায়, তবে খুবই ভালো হয়। রাজাদের সম্পর্কে জানার পাশাপাশি এ জেলার অতীত ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কেও একটি ধারণা পাবে আগামী প্রজন্ম।’

স্থানীয় আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘পাবনা ইতিহাস ও ঐতিহ্যমণ্ডিত জেলা। অথচ জেলার কোথাও একটা জাদুঘর নেই। আগে কয়েকবার শুধু শুনলাম, এখানে জাদুঘর হবে। কিন্তু আজও হয়নি। উল্টো ভবনটি অযত্ন-অবহেলায় ফেলে রাখা হয়েছে। বনমালী রায়ের মতো জমিদারের বাড়ি এভাবে জরাজীর্ণ অবস্থায় পড়ে আছে। এটি বড় উদ্বেগের বিষয়। দ্রুত এটি সংস্কার করে জাদুঘর স্থাপনের পাশাপাশি দর্শনীয় স্থানে রূপ দেওয়ার দাবি জানাচ্ছি। কারণ এটি হলে যেমন এ শহরের মানুষ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার একটু জায়গা পাবে। তেমনই ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে জানতে পারবে আগামী প্রজন্ম। একইসাথে টিকিট ব্যবস্থায় প্রবেশ করলে সরকারও রাজস্ব পাবে।’

Advertisement

লেখক ড. আশরাফ পিন্টু বলেন, ‘পূর্বে একে মুহুরিরা (দলিল লেখক) ব্যবহার করেছেন। কিন্তু বর্তমানে ভবনটি কোনো কাজেই আসছে না। এরকম দৃষ্টিনন্দন একটি রাজবাড়ি অবহেলায় পড়ে আছে। সরকারের উচিত প্রয়োজনীয় সংস্কার করে এটিকে কাজে লাগানো। তাড়াশ জমিদারদের অগ্রাধিকার দেওয়ার পাশাপাশি অন্যান্য ঐতিহ্যমণ্ডিত পুরাকীর্তি বা এ জাতীয় জিনিসকে স্থান দিয়ে অবশ্যই জাদুঘর করা উচিত।’

প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদাপুরের কাস্টোডিয়ান শাউলী তালুকদার বলেন, ‘তাড়াশ ভবনকে জাদুঘরে রূপান্তর করা হবে। এ সংক্রান্ত একটি প্রস্তাবনা ঊর্ধ্বতন মহলে দেওয়া আছে। সেখানে ভবনটির প্রয়োজনীয় সংস্কার, জনবল ও অন্য যা কিছু লাগবে; সেগুলো জানানো হয়েছে। চলতি অর্থবছরেই এটি বাস্তবায়ন হওয়ার সম্ভাবনা আছে।’

প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের সহকারী পরিচালক ড. আহমেদ আব্দুল্লাহ বলেন, ‘এ সংক্রান্ত একটি প্রস্তাবনা দেওয়া আছে। এটি এখন অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয় দেখবে। প্রস্তাবনায় ওই ভবনে একটি জাদুঘর স্থাপনের কথা বলা আছে। যেটিতে ওই রাজ পরিবারের ইতিহাস ও ঐতিহ্য অগ্রাধিকার পাবে। তবে পাবনাকে গ্লোরিফাই করবে বা জেলার প্রতিনিধিত্ব করবে, এমন সব বিষয়ও জাদুঘরে স্থান পাবে।’

এসইউ/জিকেএস