ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) আবাসিক হলগুলোর ক্যান্টিনে খাবারের মান নিয়ে শিক্ষার্থীদের দীর্ঘদিনের অসন্তোষ নতুন কিছু নয়। বছরের পর বছর ধরে শিক্ষার্থীরা মানসম্মত ও পুষ্টিকর খাবারের প্রত্যাশা করলেও বাস্তবে তা আজও মেলেনি। দিন দিন খাবারের মান আরও খারাপ হচ্ছে।
Advertisement
প্রতিদিনের খাবারে পুষ্টি ঘাটতি, মানহীন উপকরণ, অস্বাস্থ্যকর রান্নার পরিবেশ এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অভাব এমনভাবে গেঁথে গেছে যে অনেক শিক্ষার্থী বাধ্য হয়ে বাইরে খাওয়া কিংবা নিজেরা রান্না করার পথ বেছে নিচ্ছেন।
চাল, ডাল, তেল, মাংস, মাছ- প্রতিটি উপকরণেই মানের ঘাটতি চোখে পড়ে। শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেন, রান্নার জন্য ব্যবহৃত চাল অনেক সময় নিম্নমানের, যা খাওয়ার অযোগ্য বললেই চলে। ডাল বা সবজির মধ্যে পোকা পাওয়া যেন একপ্রকার স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তেলের গুণগত মান নিয়েও রয়েছে অভিযোগ। অনেক সময় তেলের গন্ধ থেকেই বোঝা যায় তা ব্যবহার উপযোগী নয়।
শিক্ষার্থীরা জানান, মাঝে মধ্যে যে মাছ পরিবেশন করা হয় তা পচা বা বাসি, যার দুর্গন্ধে খেতে বসে অস্বস্তি লাগে। সবজির মধ্যে থাকে ময়লা বা পোকামাকড়, এমনকি অনেক সময় রান্না করা তরকারিতেও দেখা যায় ছোট ছোট পোকা বা অজানা বস্তু। খাবারের রং, গন্ধ ও স্বাদ সবকিছুতেই যেন একটা নষ্ট, পচা ভাব থাকে।
Advertisement
এই পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিরক্তি ও অসন্তোষ ক্রমেই বাড়ছে। খাবার শুধু পেট ভরানোর বিষয় নয়, এটি স্বাস্থ্য, মনোযোগ এবং একাডেমিক জীবনের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে। অথচ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো দেশের সবচেয়ে প্রাচীন ও মর্যাদাপূর্ণ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এমন খাবার পরিবেশনা নিঃসন্দেহে হতাশাজনক বলেও মনে করছেন শিক্ষার্থীরা।
হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের সরোয়ার জাহান নামে এক শিক্ষার্থী ৩ জুলাই ফেসবুকে গ্রুপে লিখেছেন, ‘আজকে রাতের খাবারে ব্রিগেড মাছকে রুই মাছ বলে ৫০ টাকায় বিক্রি করে আসছিল। হঠাৎ এক ভাই এটা বুঝে ফেললে ক্যান্টিন মালিক বলেন হলে এটা রুই হিসেবেই চলে।’
“ক্যান্টিন মালিককে যখন বললাম কোন হলে ব্রিগেড মাছ রুই নামে পরিচিত? কোনো উত্তর নাই। আবার যখন বলা হলো ব্রিগেড মাছ আর রুই মাছের দামের পার্থক্য আছে কি না তখন বললেন, ‘আছে’। তাহলে কেন ৫০ টাকা রাখছেন তখন আর কোনো উত্তর নেই।”
একই হলের পালি অ্যান্ড বুদ্ধিস্ট বিভাগের শিক্ষার্থী জিহাদুল ইসলাম বলেন, মুহসীন হলের ক্যান্টিনের খাবার যেন শুধু খেয়ে পেট ভরার মতোই। সেটা হোক আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য ভালো বা খারাপ। পচা সবজি দিয়ে রান্না করা খাবার খেতে বাধ্য হই আমরা। মাঝে মধ্যে খাবারে পোকামাকড় পাওয়া যায়। বলতে গেলে একপ্রকার বিষাক্ত খাবার খেয়ে পরিতৃপ্তির ঢেকুর তুলি আমরা। হাউজ টিউটররা এগুলো খেয়াল করে না। অভিযোগ করলেও প্রতিকার আসে না।
Advertisement
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে মাহমুদুল হাসান নামে এক ক্যান্টিন কর্মচারী জানান, ক্যান্টিনে কোনো হাউজ টিউটর আসেন না দেখতে। ঈদের পর একদিন আর গতকাল (৪ জুলাই) শুধু প্রভোস্ট স্যার এসেছিলেন।
আরও পড়ুনঢাবি ক্যান্টিনের খাবারে মিললো ১০ টাকার নোটঢাবির হল ক্যান্টিনের ফ্রিজে পচা মাছ-মাংস, মালিককে জরিমানারোকেয়া হলের শিক্ষার্থী সুস্মিতা চৈতি জাগো নিউজকে বলেন, হলের খাবারের মান এতটাই খারাপ যে প্রথমবার কেউ এই খাবার খেলে তার পেটে ব্যথা করবে। তবে অভ্যস্ত হয়ে গেলে ভিন্ন কথা। খাবারের মধ্যে ছোট পোকা, চুল পাওয়া তো নিত্যনৈমত্তিক বিষয়। ক্যান্টিন মালিককে অভিযোগ করলে এড়িয়ে যান। পরেরবার আর এমন হবে না আশ্বাস দিলেও উন্নতি দেখি না। হল প্রশাসন এসব জেনেও যেন না জানার ভান করেন।
সুফিয়া কামাল হলের শিক্ষার্থী সুমাইয়া আক্তার বলেন, হলের খাবারে মাঝে মাঝেই পোকামাকড় পাওয়া যায়। আবার রান্নাঘরের অগোছালো, অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ আমাদের জন্য স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করছে। ক্যান্টিন পরিচালনায় থাকা দাদুদের উচিত এখন আরও দায়িত্বশীল হওয়া, কঠোর পরিচ্ছন্নতা মান বজায় রাখা এবং নিয়মিত পরিদর্শনের ব্যবস্থা করা। যেন আমরা স্বাস্থ্যকর ও নিরাপদ খাবার নিশ্চিতভাবে পেতে পারি।
রোকেয়া হলের প্রাধ্যক্ষ ড. হোসনে আরা বেগম অভিযোগ প্রসঙ্গে বলেন, আমাদের তিনটা ক্যান্টিনের জন্য তিনটা টিম করা আছে। আমি যতটুকু জানি, তারা নিয়মিত তদারকি করেন। তবে একটি ক্যান্টিনে সমস্যা কিছুটা বেশি। আমরা অভিযোগ পেলে তাদের ডেকে বকাঝকা করলে তারা কিছুদিন ভালো থাকে, পরে আবার যেমন তেমন হয়ে যায়। তবে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর সহযোগী অধ্যাপক সাইফুদ্দিন আহমেদ বলেন, প্রতিটি হলে ক্যান্টিন তদারকির জন্য এক বা একের অধিক হাউজ টিউটরকে নিযুক্ত করা থাকে। আমরা তাদের কাজের তদারকি করি। কখনো অভিযোগ পেলে সে ব্যাপারে তাদের অবহিত করা হয়। গত কয়েকদিন আগে আমরা সূর্যসেন হল এবং বঙ্গবন্ধু হল নিয়ে কয়েকটি অভিযোগ পেয়েছি।
তবে শিক্ষার্থীরা বলছেন ভিন্ন কথা। তাদের অভিযোগ, হলগুলোতে হাউজ টিউটররা অনেকটা নিষ্ক্রিয়, ক্যান্টিন নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই।
কবি জসীম উদদীন হলের শিক্ষার্থী সৈয়দ আব্দুর রহীম বলেন, আমাদের হলের খাবারের মান এখন কিছুটা ভালো হয়েছে শিক্ষার্থীদের তদারকির কারণে। তবে অন্যান্য হলের চেয়ে এখানে ভাতের মানটা খারাপ। হাউজ টিউটররা আমাদের হলের খাবারের মান নিয়ে তদারকি করে না, ক্যান্টিনে আসে না।
আবার জসীম উদদীন হলের প্রাধাক্ষ অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শাহীন খান বলেন, আমি হলে চারজন হাউজ টিউটরের একটি টিম করেছি, যারা হলের ক্যান্টিনের খাবারসহ দোকান ও মেসের খাবারের তদারকি করে। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের সমন্বয়েও রয়েছে একটি টিম।
মুহসীন হলের শিক্ষার্থী জিহাদুল ইসলাম অভিযোগ করেন, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় খাবারের মান পরীক্ষা করার মতো অনেক বিভাগ বা ইনস্টিটিউট আছে। তবে কখনোই হয়তো হলের খাবারের মান পরীক্ষা হয় না। যার কারণে আমরা যে কত নিম্নমানের খাবার খেয়ে বেঁচে থাকি তা কেউ জানতেও পারে না। সবচেয়ে দুঃখের বিষয়, হল কর্তৃপক্ষ খাবারের মান সম্পর্কে অবগত থাকলেও এ পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
এ বিষয়ে জানতে কথা হয় পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইনিস্টিউটের পরিচালক ড. মুহম্মদ সাইদুল আরেফিনের সঙ্গে। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, এখানে শুধু খাবারের প্রোটিনের মান পরীক্ষা করা সম্ভব। হলগুলোর ক্যান্টিনের খাবারের মান পরীক্ষা করা হয়েছে কি না জানতে চাইলে বলেন, পাশের ক্যান্টিনের খাবারের মান কিছুদিন আগে পরীক্ষা করা হয়েছিল। তবে অন্য কোনো হলের খাবারের মান পরীক্ষা করা হয়নি। প্রশাসন থেকেও কখনো বলেনি। তবে কোনো হলেই কখনো করা হয়েছে কি না এটা আমি সঠিক বলতে পারবো না, মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ সেটি ভালো বলতে পারবে।
আরও পড়ুনজবির ছাত্রী হলে খাবারের দাম বেশি মান খারাপঢাবির বিজয় একাত্তর হলের ক্যান্টিন ম্যানেজারকে অবাঞ্ছিত ঘোষণামাইক্রোবায়োলজি বিভাগের চেয়ারম্যান ড. শাকিলা নার্গিস খানের কাছে জানতে চাওয়া হয় খাবারের মান পরীক্ষা করার মতো কোনো ইনস্ট্রুমেন্ট আছে কি না? জানতে চাইলে চেয়ারম্যান বলেন, খাবারের মান পরীক্ষার ক্ষেত্রে রাসায়নিক ও জীবাণু আছে কি না- এই দুটো বিষয় রয়েছে। খাবারে জীবাণু আছে কি না তা পরীক্ষা করা আমাদের বিভাগের কাজ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোর কোনো ক্যান্টিনের খাবারের মান কখনো পরীক্ষা করা হয়েছে কি না প্রশ্নের উত্তরে বলেন, আমাদের শিক্ষার্থীরা গবেষণার কারণে কখনো কখনো কোনো কোনো হলের খাবারের মান পরীক্ষা করে। তবে আমার জানামতে প্রশাসনিক উদ্যোগে হল পর্যায়ে এটি কখনো করা হয়নি।
তিনি মনে করেন, পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট, অনুজীববিজ্ঞান বিভাগ, বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগসহ একজন হল প্রভোস্টের সমন্বিত এটি গ্রুপ করে যদি প্রশাসন খাদ্যের মান পরীক্ষা করার উদ্যোগ নেয় তাহলে বোঝা যাবে শিক্ষার্থীরা কেমন খাবার খাচ্ছে।
বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগের চেয়ারম্যান ড. মো. এনামুল হক বলেন, বিভাগটিতে খাদ্যের মান পরীক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় ইন্সট্রুমেন্ট পর্যাপ্ত রয়েছে। কোনো হল ক্যান্টিনের খাবারের মান কখনো পরীক্ষা করা হয়েছে কি না প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, গবেষণার অংশ হিসেবে দুই/একটি খাবার পরীক্ষা করা হয়েছে। তবে ঢালাওভাবে নিজ উদ্যোগে করা হয়নি।
সার্বিক বিষয়ে জানতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও উপ-উপচার্যের (প্রশাসন) সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলে তাদের মুঠোফোনে পাওয়া যাইনি।
এফএআর/এমআরএম/জেআইএম