দেশজুড়ে

ফরিদপুরের এক যৌথ পরিবারে রোজ এক হাঁড়িতে রান্না হয় ৩০ জনের খাবার

ফরিদপুরের এক যৌথ পরিবারে রোজ এক হাঁড়িতে রান্না হয় ৩০ জনের খাবার

কালের বিবর্তনে যৌথ পরিবার দিনদিন যেন বিলুপ্তির পথে। প্রতিনিয়ত যৌথ পরিবার ভেঙে ছোট হচ্ছে। তবে ফরিদপুরের বোয়ালমারীতে এখনো টিকে রয়েছে একটি যৌথ পরিবার। এখনো এক হাঁড়িতে পরিবারের ৩০ সদস্যদের জন্য রান্না হয়। ব্যবসা থেকে শুরু করে সবকিছু এখনো চলছে একসঙ্গে।

Advertisement

সময় পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পরিবার কাঠামোতেও পরিবর্তন এসেছে। যৌথ পরিবার বা একান্নবর্তী পরিবার অনেক আগেই বদলে গেছে। শহরাঞ্চলে যৌথ পরিবার ভেঙে গিয়ে একক পরিবার গড়ে উঠেছে অনেক আগেই। একক পরিবারের ধারণা এখন গ্রামেও পৌঁছে গেছে। শহর কিংবা গ্রামে এখন আর যৌথ পরিবার যৌথ ব্যবসা নেই বললেই চলে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উপজেলার ঠাকুরপুর গ্রামের মৃত ষষ্ঠী চরণ পাল একজন দরিদ্র পাল ছিলেন। মাটির হাঁড়ি-পাতিল বানিয়ে মানুষের দ্বারে দ্বারে বিক্রি করে চলতো তার অভাবের সংসার। ষষ্ঠী পালের স্বপ্ন ছিল ছেলেদেরকে দিয়ে তিনি পালের কাজ করাবেন না। সেই ভাবনা থেকে ৫০ বছর আগে বোয়ালমারী বাজারে নিজের স্ত্রীর নামে গড়ে তোলেন মহামায়া ভান্ডার নামের একটি মুদির দোকান। শুরুতে ব্যবসা ভালো চলতো না। ১৯৯৭ সালে ১৪ এপ্রিল ষষ্ঠী পাল গত হন। মৃত্যুকালে তার ছেলেদের নির্দেশ দেন সারাজীবন একসঙ্গে থাকার।

আরও পড়ুন ঘণ্টা বাজলেই শৈশব ফিরে আসে  গ্রামীণ বাংলার বিলুপ্তপ্রায় খেলা  নির্যাতিত হওয়ার কথা স্বীকার করতে পৌরুষে বাধে কেন? 

বাবার আদেশ গুরু দায়িত্ব মনে করে ছয় ভাই পরিকল্পনা করেন বাবার হাতে গড়ে তোলা মায়ের নামে প্রতিষ্ঠিত জরাজীর্ণ মুদি দোকানটিই তারা একসঙ্গে পরিচালনা করবেন। সেই থেকে ষষ্ঠী পালের ছয় ছেলে একসঙ্গে মুদি দোকানটি চালাচ্ছেন। এখন আর সেটি জরাজীর্ণ দোকান নয়, সব ধরনের মালামালের সমাহারে পরিপূর্ণ।

Advertisement

সরেজমিনে দেখা যায়, ছয় ভাইয়ের যৌথ দোকান। কেউ মালপত্র ওঠাচ্ছেন, কেউ করছেন বেচাকেনা, আবার কেউ রাখছেন হিসাবের খাতা। কারো মাঝে নেই হিংসা-বিভেদ। যুগ যুগ ধরে এভাবেই কাজ করে যাচ্ছেন তারা। প্রতিদিন বড় এক পাতিলেই যৌথ পরিবারের ৩০ সদস্যের রান্না হয়। নিজেদের মধ্যে নেই কোনো কোলাহল, বিভেদ আর হিংসা। যেন একটি উৎসবের পরিবার। উৎসবমুখর পরিবারটির উৎসবের মূল উৎস মহামায়া ভান্ডার।

দোকানটি পরিচালনা করেন ছয় ভাই। একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধা ভালোবাসার প্রতীক হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন দীর্ঘ ৫০ বছর। ভালো পণ্যের নিশ্চয়তা আর দামে সাশ্রয়ী হওয়ায় ক্রেতাদের ভিড়ও থাকে চোখে পড়ার মতো।

মহামায়া ভান্ডারের কর্মচারী রনজিৎ কুমার জাগো নিউজকে বলেন, আমরা দুই-তিনজন কর্মচারী আছি। এখানে কাজ করেও নিজের কাছে ভালো লাগে। ভাইয়ে ভাইয়ে কত মিল। কোনো ঝগড়াঝাঁটি নেই। পরিবারের সবাই আমাদের সঙ্গেও ভালো আচরণ করেন।

মহামায়া ভান্ডারের নিয়মিত ক্রেতা ও ব্যাংকার মোহাম্মদ শামীম প্রধান জাগো নিউজকে বলেন, যৌথ পরিবার যেখানে বিলুপ্তির পথে, সেখানে মহামায়া ভান্ডারের ছয় ভাইয়ের যৌথ পরিবার, যৌথ ব্যবসা যেন এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। পিতৃবিয়োগ হওয়ার পর তারা ছয় ভাই বাবার রেখে যাওয়া ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা করে আসছেন। যা ছোটকাল থেকেই দেখে আসছি। তারা যেন একে অপরের পরিপূরক। তারা আমাদের বোয়ালমারীর গর্ব।

Advertisement

জানতে চাইলে পরিবারের বড় ছেলে গোবিন্দ পাল (৭৪) জাগো নিউজকে বলেন, বাবা-মা মারা যাওয়ার পরও আমরা ছয় ভাই একসঙ্গে আছি। মূলত ব্যক্তি শাসনতন্ত্র প্রথাকে এড়িয়ে চলেছি। আমাদের মধ্যে কোনো হিংসা-প্রতিহিংসা তৈরি করি না। বাড়ির বৌদের সেভাবে গড়ে তুলেছি। কারণ তারা অন্য পরিবার থেকে এসেছে। তাদের মধ্যে আমাদের চিন্তার প্রতিফলন ঘটতে নাও পারে। সেজন্য তাদের মাঝে আমরা যৌথ পরিবারের ভালো দিকগুলো তুলে ধরেছি। আমাদের মতো করে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে যদি বাজে প্রভাব না পড়ে তাহলে ভবিষ্যতেও এভাবেই যৌথ পরিবার নিয়ে বসবাস করে যাবো।

মেজ ছেলে বিমল পাল জাগো নিউজকে বলেন, বাবার আদর্শ বুকে ধারণ করে বেঁচে আছি। বাবা বলে গেছেন, ছয় ভাই একসঙ্গে মিলেমিশে থাকতে। বাবার নির্দেশ পালন করছি। আমাদের ছয় ভাইয়ের মধ্যে কোনো বিভেদ নেই। খাওয়া দাওয়া থেকে শুরু করে ব্যবসা-বাণিজ্য সব একসঙ্গে চলে। প্রতিদিন এক হাঁড়িতে ৩০ জনের খাবার রান্না হয়।

কথা হয় পরিবারটির সেজ ছেলে অমল পালের সঙ্গে। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের মধ্যে কোনো ঝগড়াঝাঁটি, বিভেদ নেই। আমাদের প্রত্যেকের স্ত্রীদের মাঝেও মিল রয়েছে। আমাদের কোনো সমস্যা নেই। বাবার পরলোক গমনের পর আমরা দোকানটি রক্ষা করে যাচ্ছি।

বোয়ালমারী শিল্পকলা একাডেমির সদস্য ও সাংস্কৃতিক কর্মী খান মোস্তাফিজুর রহমান সুমন জাগো নিউজকে বলেন, যৌথ পরিবার ভাঙার মারাত্মক কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বিদেশি চ্যানেলগুলো। বর্তমানে নানা কারণেই যৌথ পরিবারগুলোর এক থাকা খুবই কষ্টকর। আমাদের দাদা-বাবারা যেভাবে যৌথ পরিবার দুঃখ দুর্দশার মধ্যে টেনে নিয়েছেন বছরের পর বছর, এখন আর সেটা নেই। সবাই যার যার স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত। মনে করেন আলাদা হলেই জীবনব্যবস্থা আরও উন্নত হবে। আমি মনে করি এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা।

শাহজাফর টেকনিক্যাল অ্যান্ড বিএম কলেজের অধ্যক্ষ লিয়াকত হোসেন লিটন জাগো নিউজকে বলেন, যৌথ পরিবারগুলো যখন এক ছিল তখন সবাই ব্যক্তিস্বার্থ পরিত্যাগ করে এক থাকার চেষ্টা করে গেছে। পরিবারের সন্তানরা বাবা-মা ছাড়াও দাদা-দাদি, চাচা-চাচিদের কাছে বড় হয়েছে। কিন্তু এখন যৌথ পরিবার নানা কারণে বিলুপ্ত হচ্ছে। যৌথ পরিবার থেকে বেরিয়ে আসা চাকরিজীবী বাবা-মায়ের সন্তানরা কাজের লোক, চাইল্ড কেয়ারে বড় হচ্ছে। অনেকেই বৃদ্ধ মা-বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসছেন। নানা কারণের মধ্যে পেশাগত কারণেও যৌথ পরিবার ভেঙে যাচ্ছে। সবমিলিয়ে যৌথ পরিবারে বড় পাতিলে রান্না, একসঙ্গে থাকা-খাওয়া ও চলার মতো অসাধারণ ব্যাপারগুলো এখন শুধুই স্বপ্ন।

বোয়ালমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তানভীর হাসান চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, যৌথ পরিবার সমাজে অনেকটাই বিলুপ্তির পথে। আসলে বিষয়টি শুনে খুবই ভালো লাগলো যে বোয়ালমারীতে যৌথ পরিবার যৌথ ব্যবসা এখনও টিকে আছে। পরিবারের সদস্যদের ধন্যবাদ জানাই।

এ বিষয়ে ফরিদপুর জেলা পরিসংখ্যান কার্যালয়ের উপপরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) মো. নাজমুল হক জাগো নিউজকে বলেন, কালের বিবর্তনে যৌথ পরিবার, যৌথ ব্যবসা যেন বিলুপ্তির পথে। আত্মকেন্দ্রিক ও নিজেদের স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়ায় ভাঙছে যৌথ পরিবার। বড় পরিবার ভেঙে ছোট পরিবারে রূপ নেওয়ায় শিথিল হচ্ছে সম্পর্কের বন্ধন।

তিনি আরও বলেন, ২০২২ সালের জন শুমারি-গৃহগণণা তথ্য মতে ফরিদপুরে মোট জনসংখ্যা ২১ লাখ ৬২ হাজার ৭৫৪ জন। এর মধ্যে পুরুষ ১০ লাখ ৫০ হাজার ৩৭৭ জন। মহিলার সংখ্যা ১১ লাখ ১২ হাজার ৩৭৭ জন। জেলায় মোট পরিবারের সংখ্যা ৫ লাখ ২৫ হাজার ৫৮০ টি। তবে এর মধ্যে যৌথ পরিবারের কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে সুনির্দিষ্ট করে যৌথ পরিবারের সংখ্যা বলা না গেলেও যৌথ পরিবার, যৌথ ব্যবসা অনেকাংশে কমেছে। এক কথায় অনেকটাই বিলুপ্তির পথে।

এফএ/জিকেএস