শিশু মানেই কৌতূহল, খেলাধুলা আর প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক। গ্রামের বাড়ির উঠানে শিশুদের ধুলা-মাটি মেখে হেসে লুটিয়ে পড়া তাই খুব সাধারণ দৃশ্য। কিন্তু নগর যত বড় হচ্ছে, শিশুর সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্ক যেন ততো কমে যাচ্ছে। শহরের শিশুদের জীবন এখন আটকে আছে ইট-কংক্রিটের চার দেয়ালে, প্রযুক্তির পর্দায় আর স্কুল-কোচিংয়ের ব্যস্ততায়।
Advertisement
কাদা মাটিতে খেলা শুধু আনন্দের জন্যই জরুরি না, এর পেছনে আছে আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ কারণ। তবে শিশুরা মাটির সংস্পর্শে গিয়ে যে আনন্দ পায়, তা অন্য কোনভাবে পায়না। তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে এই অভিজ্ঞতা গভীর প্রভাব ফেলে।
আজ (২৯ জুন) আন্তর্জাতিক কাদা দিবস। শুনতে অদ্ভুত লাগছে? এই দিবসটি উৎপত্তির গল্পটাও এমনই অদ্ভুত-
২০০৯ সালে ওয়ার্ল্ড ফোরাম ফাউন্ডেশন নামে একটি শিশু-উন্নয়নভিত্তিক সংগঠন একটি আন্তর্জাতিক শিশু শিক্ষা সম্মেলন আয়োজন করে। সেই সম্মেলনে অস্ট্রেলিয়ার শিক্ষানবিশ ও শিশুবিকাশকর্মী জিলিয়ান ম্যাকঅলিফ এবং নেপাল-এর সমাজকর্মী বিষ্ণু ভট্ট একটি আলোচনায় অংশ নেন।
Advertisement
বিষ্ণু জানান, নেপালের অনেক শিশুই গরিব; ভালো জামাকাপড় নেই বলে তারা কাদামাটিতে খেলতে চায় না। অপরদিকে অস্ট্রেলিয়ার শিশুদের জন্য প্রকৃতির সঙ্গে খেলার সুযোগ একেবারে উন্মুক্ত। এই বৈপরীত্য দেখে তারা ভাবেন – সব দেশের শিশুরাই কি একদিন একসঙ্গে কাদা মেখে খেলতে পারে না?
এই চিন্তা থেকেই শুরু হয় একটি পরীক্ষামূলক পাইলট প্রোগ্রাম, যার মাধ্যমে ২০১০ সালে প্রথমবার অস্ট্রেলিয়া ও নেপালে একসঙ্গে কাদা দিবস উদযাপন করা হয়। এর সাফল্যের পর ২০১১ সাল থেকে প্রতি বছর ২৯ জুন বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক কাদা দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে।
এই দিবসের মূল উদ্দেশ্য-
১. সকল শিশুর জন্য সমান খেলার সুযোগ সৃষ্টি করা।২. আর্থ-সামাজিক ভেদাভেদ ভুলিয়ে দিয়ে সামাজিক সমতা গড়ে তোলা।৩. প্রকৃতির সঙ্গে শিশুদের সংবেদনশীল সম্পর্ক গড়ে তোলা।৪. শিশুদের অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিক্ষা নিশ্চিত করা।
Advertisement
কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে শহরে যেমন খেলার মাঠের অভাব, তেমনি অভিভাবকদের অতিরিক্ত সচেতনতাও শিশুদের কাদামাটির ছোঁয়া থেকে বঞ্চিত করছে। অনেক অভিভাবক মনে করেন, কাদামাটি নোংরা – রোগবালাইয়ের উৎস। ফলে শিশুরা অভিভাবকদের বকাবকির ভয়ে স্কুলের মাঠে বৃষ্টির কাদায় দৌড়াদৌড়ি বা খেলাধুলা করতে সাহস পায় না। অথচ তাদের মন চায় কাদামাটিতে ছুটতে, গড়াগড়ি দিতে, এক কথায় কাদামাটির সংস্পর্শে পাওয়ার জন্য তারা ছটফট করে। কাদামাটি শুধু শিশুদের মনেই আনন্দ দেয় না রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
কাদামাটির সংস্পর্শ না পেয়ে শিশুরা মূল্যবান শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক বিকাশের যে সব সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে-
১. রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতালাইভ সায়েন্সের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, শিশুদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বা ইমিউন সিস্টেম তাদের শৈশবেই গড়ে ওঠে। এ সময়ে মাটিতে খেলার মাধ্যমে তাদের ইমিউন সিস্টেম ক্ষতিকারক জীবাণুকে চিহ্নিত করে ও তা প্রতিরোধ করার ক্ষমতা বাড়াতে পারে।
২. উপকারী জীবাণুমাটিতে থাকা কিছু উপকারী জীবাণু ‘অন্ত্রের মাইক্রোবায়োম’কে উন্নত করে। এই মাইক্রোবায়োম শরীরে ভিটামিন উৎপাদন এবং খাবার হজমে সহায়তা করে। যদিও প্রসবের সময় ও বুকের দুধের মাধ্যমে শিশুরা অন্ত্রের এই জীবাণু পায় তবে শৈশবে এটি আরও পরিপূর্ণ হয়।
৩. সংক্রমণ থেকে সুরক্ষামাটিতে খেলা শিশুদের ত্বকে উপকারী জীবাণুর পরিমাণ এবং রক্তে ইমিউন সেল বাড়ায়। এই পরিবর্তন পরবর্তীতে শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে কার্যকরী ভূমিকা রাখে। বিশেষ করে অ্যালার্জি, হাঁপানি ও নানা সংক্রমণ থেকে শিশুদের রক্ষা করতে সহায়তা করে।
৪. সৃজনশীলতা, সমস্যা সমাধানের দক্ষতাযারা শৈশবে মাটি, গাছ, জলাশয় এবং খোলা পরিবেশের সঙ্গে পরিচিত হয়, তাদের মধ্যে সৃজনশীলতা, সমস্যা সমাধানের দক্ষতা এবং আত্মবিশ্বাস অনেক বেশি গড়ে ওঠে। কিন্তু শহরের শিশুদের সেই সুযোগ ক্রমেই কমে আসছে – খেলার মাঠ নেই, নিরাপত্তার অভাবে একা বাইরে যাওয়া যায় না, আর অভিভাবকদের অতিরিক্ত শাসনও বড় একটি বাধা।
৫. শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যখোলা পরিবেশে খেলাধুলা শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপরও ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। প্রকৃতির মধ্যে সময় কাটালে মানসিক চাপ কমে, মনোযোগের স্থায়িত্ব বাড়ে এবং আচরণগত সমস্যাও কম দেখা যায়। কিন্তু শহরের শিশুরা যখন শুধুমাত্র ডিজিটাল দুনিয়ার মধ্যে বড় হচ্ছে, ফলে তারা একঘেয়ে ও বিচ্ছিন্ন জীবনের দিকে ধাবিত হচ্ছে।
৬. সামাজিক মৌলিক শিক্ষাশুধু শারীরিক ও মানসিক দিকই নয়, মাটির সঙ্গে সংযোগ না থাকলে শিশুরা সামাজিকভাবেও কিছু কিছু মৌলিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়। মাটির সঙ্গে কাজ করা শেখায় ধৈর্য, শ্রমের মূল্য এবং সৃষ্টির আনন্দ। কৃষি, উদ্যান বা এমনকি একটি গাছ লাগানোর অভিজ্ঞতা শিশুর মনে ভূমির প্রতি ভালোবাসা ও দায়িত্ববোধ জাগিয়ে তোলে। এসব অভিজ্ঞতা শহরের শিশুরা প্রায় সম্পূর্ণভাবে হারাচ্ছে।
শহরের বাস্তবতা মেনে চললেও, কিছু উদ্যোগের মাধ্যমে শিশুকে প্রকৃতির স্পর্শে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। তবে প্রথমেই অভিভাবকদেরও মানসিকতা বদলাতে হবে। কাদামাটি মানেই নোংরা নয়, বরং জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য শহরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বা আবাসিক এলাকায় ছোট পরিসরের বাগান, কাদার মাঠ, কিংবা স্কুলে প্রকৃতি-ভিত্তিক শিক্ষার ব্যবস্থা শিশুদের প্রকৃতির কাছাকাছি নিয়ে আসতে পারে। শুক্রবার বা ছুটির দিনে বাসায় বসে না থেকেও অল্প সময়ের জন্য হলেও অভিভাবদের উচিত শিশুদের পার্কে, খোলা মাঠে, গ্রামে বা নদীর পাড়ে নিয়ে ঘুরাঘুরি করা। যেখানে তারা প্রকৃতির ছোঁয়া পাবে এবং কাদামাটিতে খেলার সুযোগ পাবে।
শহরের শিশুরা যদি কাদামাটি ও প্রকৃতির স্বাভাবিক ছোঁয়া থেকে বঞ্চিত হয়, তবে তারা শুধু খেলার আনন্দ থেকেই নয়, বরং সুস্থ, সজীব ও মানবিক হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া থেকেও পিছিয়ে পড়বে। তাই আমাদের দায়িত্ব তাদের সেই ছোঁয়া ফিরিয়ে দেওয়া, যাতে তারা প্রকৃতি ও মানুষের সঙ্গে একটি সত্যিকারের সংযোগ গড়ে তুলতে পারে।
আজকের শহুরে শিশুরা জানে না কাদা মেখে খেলার আনন্দ, মাটির ঘ্রাণ, কিংবা গায়ে কাদা লাগলে কী সুন্দর অনুভূতি হয়। আন্তর্জাতিক কাদা দিবস তাদের সেই সহজ আনন্দে ফেরাতে পারে – যেখানে নেই কোনো মোবাইল গেম, নেই পরীক্ষা কিংবা প্রতিযোগিতা, আছে শুধু প্রকৃতি আর মুক্তির স্বাদ।
সোহেল রানা/এএমপি/এমএস