‘কলম দিয়ে লেখা যায় ইতিহাস, আর কাদামাটি দিয়ে লেখা হয় সভ্যতা।’ এই কথাটি যেন আজকের কাদামাটি দিবসে, সবচেয়ে বেশি মেলে প্রাচীন মেসোপটেমিয়া সভ্যতার সঙ্গে। প্রায় ছয় হাজার বছর আগে টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদীর মাঝখানে গড়ে ওঠা পৃথিবীর প্রথম নগরসভ্যতা ছিল মেসোপটেমিয়া। সেখানে লেখালেখির সূচনা হয়েছিল কাদামাটির মাধ্যমে। তখন কাগজ ছিল না, কলম ছিল না, তবু তারা লিখেছিল আর সেই লেখাই আজও আমাদের কাছে ইতিহাস হয়ে আছে।
Advertisement
মেসোপটেমিয়ায় প্রথম প্রথম মানুষ মৌখিকভাবে তথ্য আদান-প্রদান করত। কিন্তু কৃষিকাজ, বাণিজ্য, কর আদায় এবং ধর্মীয় রীতিনীতির মতো বিষয়ের স্থায়ী রেকর্ড রাখার প্রয়োজনীয়তা থেকেই শুরু হয় লেখার ধারণা। এই লেখার মাধ্যম হিসেবে তারা বেছে নেয় নরম কাদামাটি। নদীর তীর থেকে সংগৃহীত এই কাদা ছিল সহজলভ্য এবং নমনীয়। তারা কাদামাটি দিয়ে ছোট ছোট চতুর্ভুজ বা গোল ট্যাবলেট তৈরি করত। এরপর বাঁশ বা খাগড়া জাতীয় উদ্ভিদের ছাঁটা মাথা দিয়ে বানানো একটি স্টাইলাস দিয়ে তাতে চাপ দিয়ে কোণাকুণি, ত্রিভুজ এবং পেরেকের মাথার মতো দেখতে চিহ্ন কাটত। এই চিহ্নগুলোর নাম ছিল কিউনিফর্ম, যা বিশ্বের প্রথম লিখিত লিপির অন্যতম এবং গড়ে তুলেছিল নতুন এক তথ্য সংরক্ষণের দিগন্ত।
লেখার জন্য ব্যবহৃত হতো মূলত তিন ধাপে প্রস্তুত কাদামাটির ফলক। প্রথমে নদীর তীরে জমে থাকা পলিমাটি সংগ্রহ করা হতো। এরপর সেটি আঙ্গুল দিয়ে বা কাঠের ছাঁচে চেপে ছোট ছোট ট্যাবলেট তৈরি করা হতো, যা সমতল বা মাঝে মাঝে বাঁকানো হত। এরপর ট্যাবলেট কিছুটা শুকনো অবস্থায় রেখে তাতে স্টাইলাস দিয়ে চাপ দিয়ে চিহ্ন তৈরি করা হতো। লেখা শেষ হলে ট্যাবলেট রোদে শুকিয়ে অথবা মাটির চুল্লিতে পোড়ানো হতো যাতে ট্যাবলেট শক্ত ও দীর্ঘস্থায়ী হয়।
এই ট্যাবলেটগুলোর মধ্যে লেখা থাকত কর আদায়ের রসিদ, কৃষি ও খাদ্যসংগ্রহের হিসাব, শ্রমিকদের মজুরির তালিকা, ধর্মীয় বিধান, ঐতিহাসিক দলিল, আইন ও বিচার সংক্রান্ত নথি, ব্যক্তিগত চিঠিপত্র এবং গল্প, কবিতা ও মহাকাব্যের অংশ। বিখ্যাত হাম্মুরাবির কোডও এই কিউনিফর্ম লিপিতে লেখা হয়েছিল।
Advertisement
আজ এই কাদামাটির ফলকগুলো আধুনিক প্রত্নতত্ত্বে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন হিসেবে বিবেচিত। এগুলো বিশ্বের নানা জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ব্রিটিশ মিউজিয়াম, লুভর, দ্য মেট্রোপলিটান মিউজিয়াম অব আর্ট এবং ইস্তানবুল আর্কিওলজি মিউজিয়াম।
ব্রিটিশ মিউজিয়ামে প্রায় এক লাখ ত্রিশ হাজারের বেশি কাদামাটির ট্যাবলেট রয়েছে, যেখানে বাবিলন, সুমের, অ্যাসিরিয়া ও আক্কাদ সভ্যতার নথিপত্র রাখা হয়েছে। লুভরে আছে হাম্মুরাবির কোডের বিখ্যাত ফলক, যা আজও প্রাচীন আইন ব্যবস্থার মূল দলিল হিসেবে গণ্য। নিউ ইয়র্কের দ্য মেট্রোপলিটান মিউজিয়ামে সংরক্ষিত রয়েছে অসংখ্য ছোট বড় ট্যাবলেট, যেখানে ব্যবসায়িক লেনদেন, কর সংগ্রহের হিসাব এবং ব্যক্তিগত চিঠিপত্র পাওয়া যায়। তুরস্কের ইস্তানবুল আর্কিওলজি মিউজিয়ামে রয়েছে বিভিন্ন সময়ের সুমেরীয়, আক্কাদীয় ও বাবিলনীয় ফলক, যা ঐ অঞ্চলের প্রাচীন ইতিহাস ও ভাষার গবেষণায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
মেসোপটেমিয়ার কাদামাটি শুধু একটি মাটির টুকরা ছিল নয়, বরং ছিল একটি সভ্যতার ডায়েরি। এই ট্যাবলেটগুলো আমাদের তাদের জ্ঞান সম্পর্কে ধারণা দেয় যে, কীভাবে হাজার হাজার বছর আগে মানুষ কাগজ কিংবা কলম না থাকলেও তথ্য সংরক্ষণ করত কাদামাটির সাহায্যে। আজকের আধুনিক যুগের তুলনায় অনেক প্রাচীন ও মৌলিক এই পদ্ধতিটি আজও আমাদের সভ্যতার ভিত্তি এবং ইতিহাস জানার গুরুত্বপূর্ণ কূটনীতির অংশ।
মেসোপটেমিয়ার কাদামাটি আমাদের ভাবিয়ে তোলে, ইতিহাস শুধু যুদ্ধ কিংবা রাজবংশের গল্প নয়; ইতিহাস লেখা যায় মাটিতেও, যদি সেটিতে চিন্তা, ভাষা এবং তথ্যের ছাপ থাকে। আজ আমরা সেই কাদামাটির ট্যাবলেটগুলো দেখে অবাক হই কীভাবে পৃথিবীর প্রথম দিকের মানুষগুলো মাটি দিয়ে কথা বলেছিল এবং সভ্যতার অগ্রগতি গড়ে তুলেছিল।
Advertisement
মেসোপটেমিয়ার কাদামাটির ফলকগুলো সভ্যতার এক নীরব সাক্ষী, যেখানে সেসময়ের মানুষের জ্ঞান ও ইতিহাস মিশে আছে মাটির প্রতিটি কণায়। আজকের এই কাদামাটি দিবসে আসুন আমরা চিন্তা করি, কীভাবে এই সাধারণ মাটিই সভ্যতার গল্প লিখে চলেছে শত বছর ধরে; আর আমাদের শিখিয়ে চলেছে অতীত থেকে জানার গুরুত্ব।
আরও পড়ুনরাজসভা থেকে বাড়ির হেঁশেলে বিরিয়ানিপুরান ঢাকা: ইতিহাসের অলিগলি ও ঐতিহ্যের পদচিহ্নতথ্যসূত্র: ব্রিটিশ মিউজিয়াম, ওয়ার্ল্ড হিস্ট্রি এনসাইক্লোপিডিয়া, ব্রিটানিকা
কেএসকে/জেআইএম