মো. আরিফুল ইসলাম আকাশ
Advertisement
পড়াশোনার চাপ, কারিগরি প্রশিক্ষণ, টিউশনি, ইন্টার্নশিপসহ বহু ব্যস্ততায় দিশেহারা শরীর ও মস্তিষ্ক। শত ব্যস্ততার মধ্যে একটু রিফ্রেশমেন্ট দরকার। দরকার বুকভর্তি নিঃশ্বাস নেওয়ার। তাই প্রকৃতির গহীনে ডুবে মনকে উৎফুল্ল করতে ১১ জন পরিকল্পনা করি লম্বা ভ্রমণের। যেতে চাই সাগর, পাহাড় আর ঝরনার রাজ্য সীতাকুণ্ড। যেই ভাবা সেই কাজ, সব কাজ শেষ করে ঝালকাঠি থেকে বাসে চেপে রওয়ানা দিলাম বরিশাল। আপাতত গন্তব্য বরিশাল লঞ্চঘাট। আমি এলাম ঝালকাঠি থেকে। নয়ন, ইমন, আরাফাত, সাকিল এলো তালতলা থেকে। জুবায়ের আব্দুল্লাহ, বাবু, জাহিন, জুবায়ের রহমান, আরিফ, সাব্বির বরিশালেই ছিল।
সবাই লঞ্চঘাটে একত্রিত হলাম সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায়। লঞ্চের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। আমরা চাঁদপুর নেমে সেখান থেকে ট্রেনে চট্টগ্রাম যাবো। কথা হচ্ছে—বরিশালের লঞ্চগুলো চাঁদপুরে ঘাট দেয় না। তাই ঝালকাঠি-নলছিটির লঞ্চের জন্য অপেক্ষা। লঞ্চ ঘাটে পৌঁছলো সন্ধ্যা সাড়ে আটটায়। দ্রুত উঠে লঞ্চের ডেকে দোতলায় একপাশে একটি চাদর ও কয়েকটি তোয়ালে বিছিয়ে নিলাম। এরপর সবাই মিলে আড্ডা দিয়ে রাতের খাবার খেয়ে শরীরটা এলিয়ে দিলাম। রাত আড়াইটায় লঞ্চ চাঁদপুর ঘাট দেবে। সেখান থেকে ট্রেন ছাড়বে ভোর পাঁচটায়। লঞ্চে না ঘুমালে আর ঘুমানোর সুযোগ নেই। লঞ্চ ভোর তিনটায় ঘাট দিলো চাঁদপুরে। আমরা ব্যাগ গুছিয়ে নেমে পড়ি। লঞ্চঘাট থেকে রেলস্টেশনে অটোরিকশায় ২০ টাকা করে ভাড়া। আমাদের হাতে অঢেল সময়। তাই অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয়দের সাথে নিয়ে হেঁটে যাওয়াই উপভোগ্য।
চাঁদপুর স্টেশন থেকে ট্রেন ছাড়লো ভোর পাঁচটায়। চট্টগ্রাম পৌঁছলাম ১১টা ২০ মিনিটে। লোকাল ট্রেন স্টেশনে থেমে থেমে ভালোবাসা কুড়িয়েছে। আমাদের গন্তব্যে পৌঁছতে একটু দেরী হলো। চট্টগ্রাম থেকে মিনিবাসে চেপে ঘণ্টাখানেক জার্নি করে সীতাকুণ্ড বাজারে পৌঁছলাম। হোটেল বুক করে দ্রুত গোসল সেরে জুমার নামাজে গেলাম। নামাজ পড়ে সীতাকুণ্ড বাজারে সবজি পানি ডাল দিয়ে সাদা ভাত মেখে তার ওপর কাগজি লেবুর রস মিশিয়ে নিলাম। ভাত খেতে খেতে সিদ্ধান্ত হলো বিকেলে সুপ্তধারা ঝরনায় যাবো। এটাই হবে প্রথম অ্যাডভেঞ্চার।
Advertisement
সীতাকুণ্ড বোটানিক্যাল গার্ডেন ইকোপার্ক চন্দ্রনাথ পাহাড়ের পাদদেশে ৮০০ হেক্টর জায়গায় গড়ে তোলা হয়েছে। বন বিভাগের প্রচেষ্টায় গড়ে তোলা পার্কটিতে আছে বিরল প্রজাতির গাছপালা, হাজার রকমের ফুলের গাছ, কৃত্রিম লেক ও নানা প্রজাতির জীববৈচিত্র্য। এ ছাড়া আছে সুপ্তধারা ও সহস্রধারা ঝরনাসহ ঝিরিপথের ছোট-বড় বেশ কয়েকটি ঝরনা, বিশ্রামের ছাউনি। ভেতরে প্রবেশের জন্য ৩০ টাকায় টিকিট সংগ্রহ করে হেঁটে যাত্রা শুরু করি। পাহাড়ে ওঠার জন্য রাস্তা করা আছে। বোটানিক্যাল গার্ডেন ও ইকোপার্কের প্রধান ফটকের ভেতরে ডানপাশে আছে প্রধান নার্সারি এবং অফিস। নার্সারিতে আছে দেশ-বিদেশের প্রচলিত ও বিলুপ্ত প্রজাতির ফুল, ফল ও ওষুধি গাছ। সামনে এগিয়ে উঁচু-নিচু নির্জন পাহাড়, পাখির কলরব, প্রাকৃতিক ঝরনা, চির সবুজ বৃক্ষরাজি খুবই মনোমুগ্ধকর। সবুজের বুক চিড়ে সূর্যের চাহনি যেন এক নৈসর্গিক পরিবেশের সৃষ্টির সম্ভার। উঁচুনিচু পথ ধরে এগোতে এগোতে ঝরনার শব্দ শুনতে শুনতে পৌঁছে গেলাম সুপ্তধারা ঝরনায়। সৌন্দর্য দেখে বহু পথ পাড়ি দিয়ে আসা পায়ের ব্যথা, মাংসপেশীর যন্ত্রণা, পরস্পরের দোষারোপ যেন এক নিমিষেই বিলীন হয়ে গেলো। বরফ শীতল ঝরনার পানিতে মুছে গেলো সব গ্লানি।
পরদিন সকাল সকাল উঠে বেরিয়ে পড়লাম চন্দ্রনাথ পাহাড় অভিযানে। প্রবেশপথে এসে ৩০ টাকা দিয়ে বাঁশের লাঠি কিনে নিলাম। পাহাড়ে ওঠার সময় মাঝপথে একবার পা পিছলে গেলো। ভয়ানক সেই অভিজ্ঞতা। পাহাড় কেটে সিঁড়ি বানানো পিচ্ছিল রাস্তা বেয়ে ওপরে ওঠা কষ্টের। নিচে তাকালে ভয়ে কলিজা শুকিয়ে যায়। ওপরে তাকালে ভয়ে নিজের অজান্তেই মুখ থেকে বেরিয়ে আসে, ‘আমি আর ওপরে উঠতে পারবো না’। পাহাড়ের মাঝামাঝি পথ এতটাই ভয়ংকর নির্জন যে, কোনো শব্দ নেই। মনে হবে পৃথিবীও স্তব্ধ হয়ে আছে ভয়ে। নিজের হৃৎপিণ্ডের ধকধকানি শুনতে পাওয়া যায়। বামপাশে সুবিন্যস্ত খাড়া পাহাড়; ডানপাশে তাকালেই পাহাড়ের পাদদেশ। পাহাড় মানেই কঠিন বাস্তবতা। না পারা যায় ছেড়ে আসতে, না পারা যায় ওপরে উঠতে। উনিশ-বিশ হলেই মৃত্যু অনিবার্য। সিঁড়ির আদলে পাহাড় কাটা আর প্রতিটা ধাপেই যেন মৃত্যু লেখা।
আরও পড়ুনবর্ষায় ভ্রমণে সতর্ক থাকবেন যে বিষয়েঝরনা ও পাহাড় ভ্রমণে যেসব সতর্কতা জরুরিদুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে চন্দ্রনাথের চূড়ায় পৌঁছে গেলাম। সত্যি এক অফুরন্ত সৌন্দর্যের সম্ভার। সব ক্লান্তি এক নিমিষেই উবে গেলো। চোখ ধাঁধানো প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে। সবাই স্মৃতি ধরে রাখতে ফটোসেশন করলাম। কিন্তু বিপত্তি বাঁধলো বাবু আর আরাফাতের বেলায়। এই দুই ভদ্রলোক সমতল থেকে হাজার ফুট উচ্চতায় বসে মারামারি বাঁধালো, তা-ও ছবি তোলা নিয়ে। যারা চন্দ্রনাথ পাহাড়ে গেছেন; তারা জানেন এটার দুটি চূড়া। আমরা উত্তর পাশে উঠেছি। এবার দক্ষিণ পাশের চূড়ায় ওঠার পালা। অনেক কষ্ট করে দক্ষিণ পাশের চূড়ায় পৌঁছলাম। যত ক্লান্তি, পায়ের ব্যথা আর মাংসপেশীর টান সবকিছু তলিয়ে যায় মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য দেখে।
এ চূড়ায় একটি দোকান আছে। দোকানে রেফ্রিজারেটরও আছে। হুট করে সবকিছু বাদ দিয়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আসে রেফ্রিজারেটর ও বৈদ্যুতিক খুঁটি। কেউ বলে এগুলো হেলিকপ্টারে এনেছে, আবার কেউ বলে এগুলো ঘারে করে এনেছে। অঘোষিত এক যুক্তি-তর্কের মহড়া চলছে। দুই দলেরই দাবিগুলো যৌক্তিক। এ নিয়ে দু’পক্ষের মধ্যে বাজি ধরাও হলো। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, একটু সামনে এগোতেই চক্ষু চড়কগাছ। কারণ চন্দ্রনাথ পাহাড়ের দক্ষিণ পাশ দিয়ে একদম পাদদেশ বেয়ে প্রায় চূড়ার কাছাকাছি পাকা রাস্তা উঠে গেছে। এ রাস্তা ধরেই সিএনজি, প্রাইভেটকার ওপরে চলে আসে। এটা আমরা আগে জানতাম না। চূড়া থেকে সম্ভাব্য দুশ ফুট নিচে সিঁড়ি বেয়ে আমরা নেমে এলাম। যেখানে পাকা রাস্তা শেষ হয়ে গেছে এবং চূড়ায় ওঠার রাস্তা শুরু। এখানে খানিকটা বিন্যাস্ত জায়গা। গোটা কয়েক ভ্রাম্যমাণ দোকানও আছে। এখানে লেবুর শরবত খেয়ে মন এখন ঝরঝরা লাগছে।
Advertisement
পাহাড় বেয়ে সমতল ভূমিতে ফিরে আসা আরও কঠিন। হোটেলে ফিরে ফ্রেশ হয়ে খাবার খেয়ে খানিকটা বিশ্রাম নিলাম। বিকেলে বের হলাম গুলিয়াখালীর দিকে। গুলিয়াখালী প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপূর্ব মিলনস্থল। সবচেয়ে আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হলো সবুজ ঘাসে ঢাকা ম্যানগ্রোভ বন ও ছোট ছোট জলধারা, যা সরাসরি বঙ্গোপসাগরে মিশেছে। সৈকতের বালুকাময় উপকূল নয় বরং কাদা, ঘাস ও গাছপালায় ভরা এক বিশুদ্ধ পরিবেশ। যা অন্যসব সৈকত থেকে আলাদা করেছে। সূর্যাস্তের সময় জায়গাটি রঙের জাদুকরী খেলায় পরিণত হয়। এটি প্রকৃতি ও নির্জনতাকে ভালোবাসা মানুষদের জন্য এক আদর্শ গন্তব্য। সবাই স্মৃতি ধারণের জন্য ফটোসেশন করছিলাম। হুট করেই জুবায়ের ও আরিফ উধাও।
তৃতীয় দিন তথা শেষ দিন আমাদের গন্তব্য খৈয়াছড়া ঝরনা। খৈয়াছড়া ঝরনা সীতাকুণ্ডের মিরসরাই সীমান্তে অবস্থিত। অন্যতম বিখ্যাত এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত জলপ্রপাত। ইজিবাইক থেকে নেমে শুরুতে কোর্টা-স্বচ্ছ ঝিরি পথ, পরে খাড়া-উঁচু পাথুরে পথ ধরে হাঁটা শুরু করলাম। সামনে এগোতে প্রতিটি ধাপে ওঠার সময় মুগ্ধতা ও মায়া অনুভব হয়; যত ওপরে উঠি; দৃশ্য ততই মন্ত্রমুগ্ধকর। খৈয়াছড়া ঝরনা প্রকৃতিপ্রেমী ও অ্যাডভেঞ্চারপিপাসুদের জন্য অমূল্য উপহার। এটি নির্জনতা, পাহাড়ি-সৌন্দর্য ও প্রাকৃতিক প্রশান্তির এক ভারসাম্যপূর্ণ সমাহার। অপরূপ সৌন্দর্যে ঘেরা।
অপরূপ সৌন্দর্যের প্রকৃতি দেখতে দেখতে ফুরিয়ে এলো ট্যুরের বেলা। সবাই তড়িঘড়ি করে হোটেলে চেক আউট করে বের হওয়ায় পালা। আরাফাত ট্যুরজুড়েই দেরী করছেন সবকিছুতে। ৬টায় ট্রেনের টিকিট কাটা। খাওয়া-দাওয়া না করেই সবাই বো হয়ে ছুটলাম ট্রেন ধরতে। ট্রেন মিস হওয়ায় উপক্রম। সবাই হাফাতে হাফাতে চট্টগ্রাম রেলস্টেশনে এসে পৌঁছলাম। ট্রেন ছাড়ার দু’মিনিট আগে। কিন্তু সেই একজন পেছনেই পরে গেলো। তার গতি অনুযায়ী পাঁচ মিনিটের দূরত্বে আছে সে। ট্রেন ছাড়ার সময় বাকি আছে দু’মিনিট। ট্রেন এবার মিস হওয়া অনিবার্য। আমরা তাহলে বড়সড় হতাশায় পড়বো। কারণ পকেট সবার ইতোমধ্যে ফাঁকা। ট্রেন ছাড়ার কয়েক মুহূর্ত বাকি। স্টার্ট দিয়ে লম্বা হুইসেল বাজালো। সবাই চমকে উঠে বলল, ‘আরাফাইত্তা লম্বা পা ফেল’।
লেখক: শিক্ষার্থী, বিবিএ (হিসাববিজ্ঞান) তৃতীয় বর্ষ, ঝালকাঠি সরকারি কলেজ।
এসইউ/জেআইএম