যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ন্যাটো জোট ও আরও কিছু উন্নত দেশ বহু দশক পর আবারও ব্যাপক হারে সামরিক প্রস্তুতির পথে হাঁটছে। ইউক্রেনে যুদ্ধ, মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা, তাইওয়ান নিয়ে দ্বন্দ্ব এবং ডোনাল্ড ট্রাম্পের অনিশ্চিত পররাষ্ট্রনীতি—এসবই প্রতিরক্ষায় বড় বাজেট বরাদ্দের তাগিদ সৃষ্টি করেছে।
Advertisement
জুনের শেষ সপ্তাহে ন্যাটোর সদস্যরা জিডিপির ৩ দশমিক ৫ শতাংশ সরাসরি প্রতিরক্ষা খাতে এবং ১ দশমিক ৫ শতাংশ নিরাপত্তা-সম্পর্কিত খাতে ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণে সম্মত হয়েছেন। এ পরিকল্পনা সফল হলে ২০৩৫ সালের মধ্যে তারা আগের তুলনায় বছরে ৮০০ বিলিয়ন ডলার বেশি ব্যয় করবে—যা বিশ্ব অর্থনীতিকে আমূল বদলে দিতে পারে।
অর্থনীতি ও বাজেটে চাপপ্রতিরক্ষা খাতে এমন বিপুল অর্থ ব্যয়ের সবচেয়ে তাৎক্ষণিক প্রভাব পড়বে সরকারি বাজেটে। এরই মধ্যে বিভিন্ন দেশ উচ্চ ঋণের ভারে নতজানু, তার ওপর বার্ধক্যজনিত স্বাস্থ্যসেবা ও সুদের হারের চাপে রাজস্ব খরচ বেড়েই চলেছে।
আরও পড়ুন>>
Advertisement
ন্যাটো সদস্যরা যদি প্রতিশ্রুতির মতো ব্যয় বাড়ায়, তাহলে তা সামাজিক ব্যয়ের অংশকে সংকুচিত করবে—যা স্নায়ুযুদ্ধ পরবর্তী ‘শান্তি লভ্যাংশ’-কে কার্যত শেষ করে দেবে। একইসঙ্গে বাজেট ঘাটতি বেড়ে যেতে পারে, যা সুদের হার বাড়িয়ে সরকারি অর্থনীতিকে আরও নাজুক করে তুলবে।
প্রবৃদ্ধির ফলাফল কী?এ ধরনের বড় বাজেট ঘাটতি ‘কেইনসীয় প্রণোদনা’ হিসেবে অল্প সময়ের জন্য কাজ করলেও, তা দীর্ঘমেয়াদে অস্বস্তিকর হতে পারে—বিশেষ করে যখন উন্নত বিশ্বে মজবুত শ্রমবাজার ও অব্যাহত মূল্যস্ফীতি বিদ্যমান। পাশাপাশি, অস্ত্র কিনে কারও জীবনমান সরাসরি উন্নত হয় না।
তবে প্রতিরক্ষা গবেষণা ও প্রযুক্তি কিছু ইতিবাচক ফল বয়ে আনতে পারে। সামরিক খাতে গবেষণা ও উন্নয়ন বেসরকারি খাতের উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করে। যেমন, ইন্টারনেট ও পারমাণবিক শক্তি—দু’টিই উদ্ভব হয়েছিল সামরিক গবেষণা থেকে। সাম্প্রতিক এক বিশ্লেষণ বলছে, যদি কোনো শিল্পে সামরিক গবেষণার অবদান ১ শতাংশ বাড়ে, তাহলে সেক্টরটির বার্ষিক উৎপাদনশীলতা ৮ দশমিক ৩ শতাংশ বেড়ে যেতে পারে।
কর্মসংস্থানের বিভ্রমরাজনীতিকরা ধারণা করছেন, সামরিক ব্যয় শিল্পায়নহীনতা মোকাবিলায় ভূমিকা রাখবে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। আধুনিক অস্ত্র উৎপাদন পদ্ধতি এখন খুবই স্বয়ংক্রিয় ও দক্ষতাভিত্তিক। এর ফলে সামরিক শিল্পে ব্যাপক কর্মসংস্থান হওয়ার সম্ভাবনা কম।
Advertisement
ইউরোপীয় ন্যাটো দেশগুলোতে সামরিক খাতে অতিরিক্ত ব্যয়ে মাত্র পাঁচ লাখ নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হতে পারে বলে অনুমান, যা তিন কোটি শিল্প কর্মীর ইউরোপীয় শ্রমবাজারে সামান্যই প্রভাব ফেলবে।
ইউক্রেন যুদ্ধ দেখিয়ে দিয়েছে, ড্রোন নির্মাণের মতো কাজ তুলনামূলকভাবে সহজ এবং এতে ব্যাপক শ্রমের প্রয়োজন হয় না। উপরন্তু, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার আরও মানবশক্তির প্রয়োজন কমিয়ে প্রযুক্তিনির্ভর প্রতিষ্ঠানের কাছে মুনাফার ভাগ তুলে দিচ্ছে।
কৌশলগত সমন্বয় জরুরিরাষ্ট্রের মূল দায়িত্ব নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। কিন্তু পাবলিক ফিন্যান্স যখন ভঙ্গুর, তখন প্রতিটি অর্থ খরচ করতে হয় খুব হিসাব করে। শুধু ভোটারদের খুশি করতে গিয়ে বিশেষ এলাকা বা শিল্পে টাকার ঢালাও বরাদ্দ শেষ পর্যন্ত বেকারত্ব নয়, বরং কর বৃদ্ধি অথবা সামাজিক খাতে কাটছাঁট বয়ে আনবে।
নিরাপত্তার প্রয়োজনেই যদি এই ব্যয় বাড়ানো হয়, তাহলে সেটি স্বচ্ছভাবে জনগণকে জানিয়ে করতে হবে। না হলে সামান্য প্রবৃদ্ধির বিনিময়ে যে মূল্য দিতে হবে, তা হয়তো বহুগুণ বেশি—রয়েছে স্বাধীনতা হারানোর ঝুঁকিও।
কেএএ/