প্রতিদিনের স্ট্রেস, কাজের চাপ, রোদ, গরম, ঠান্ডা ইত্যাদি নানান কারণে আমাদের প্রায়ই মাথাব্যথায় ভুগতে হয়। কেউ কেউ কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে ব্যথা থেকে রেহাই পান। অনেকে আবার টানা কয়েকদিন ব্যথায় কষ্ট পান। মানসিক চাপ ও পানিশূন্যতাসহ নানান কারণে মাথাব্যথা করতে পারে। তবে মাইগ্রেন একটি বিশেষ ধরনের মাথাব্যথা, যে ব্যথা সাধারণ ক্লান্তি থেকে হওয়া ব্যথার চেয়ে আলাদা। কিন্তু কী এই মাইগ্রেন?
Advertisement
এ বিষয়ে জাগো নিউজের সঙ্গে কথা বলেছেন রাজধানীর বাংলাদেশ স্পেশালাইজড্ হসপিটালের সিনিয়র মেডিক্যাল অফিসার ও রেসপিরেটরি এবং নিউরোলজি ডিপার্টমেন্টের চিকিৎসক ডা. ইমরান রহমান তুর্জ। চলুন মাইগ্রেন নিয়ে বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক সরাসরি চিকিৎসকের কাছে থেকে-
জাগো নিউজ:আমরা সবাই মাইগ্রেনের সঙ্গে পরিচিত। কিন্তু মাইগ্রেন আসলে কী? অন্য সাধারণ মাথাব্যথা থেকে এটি কেন আলাদা?
ডা. ইমরান রহমান তুর্জ: মাইগ্রেন হলো একটি জটিল স্নায়ুবিক ব্যাধী। এই রোগে শরীরভেদে মাঝারী থেকে তীব্র মাথাব্যথা হতে পারে। সাধরানত মাথার এক পাশে তীব্র ব্যথা শুরু হয় এবং সেই সঙ্গে বমি বমি ভাব থাকতে পারে। অতিরিক্ত ব্যথায় রোগীর বমিও হতে পারে। যদিও মাইগ্রেনের কারণ এখনও বিজ্ঞানীরা নিশ্চিতভাবে চিহ্নিত করতে পারেননি, তবে সাধারণত মনে করা হয় যে মাইগ্রেন পরিবেশগত এবং জেনেটিক কারণগুলোর মিশ্রণের কারণে হয়ে থাকে।
Advertisement
মাইগ্রেনের মাথাব্যথার একটি বড় কারণ হলো মস্তিষ্কের নিউরোট্রান্সমিটারগুলোর (রাসায়নিক বার্তাবাহক) অসামঞ্জস্যতা। নিউরোট্রান্সমিটারগুলো মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষের মধ্যে সংকেত পাঠায় এবং তাদের কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করে। এগুলোর প্রধান দুই ধরনের প্রভাব আছে। একটি হলো নিউরনকে বেশি সক্রিয় করা; আরেকটি হলো নিউরনের কার্যকলাপ কমিয়ে দেওয়া। যখন মস্তিষ্কের রাসায়নিকগুলো ঠিকমতো কাজ না করে। অর্থাৎ কিছু রাসায়নিক বেশি কাজ করে, কিছু কম করে। এই অসামঞ্জস্যতা মাইগ্রেনের ব্যথা ট্রিগার করে।
জাগো নিউজ: বিভিন্ন সময় মাথাব্যথা করা একটি সাধারণ বিষয়, কিন্তু একজন ব্যক্তি কখন বুঝবেন যে এটি সাধারণ মাথাব্যথা নয়? কোন লক্ষণগুলো দেখা দিলে মাথাব্যথা নিয়ে চিকিৎসকের কাছে যাওয়া উচিত?
ডা. ইমরান রহমান তুর্জ: মাইগ্রেন এবং অন্যান্য মাথাব্যথার পার্থক্য করার জন্য ব্যথার তীব্রতা, অবস্থান এবং এর সঙ্গে সম্পর্কিত অন্যান্য লক্ষণগুলো বিশ্লেষণ করা জরুরি। মাইগ্রেনের ব্যথা খুবই তীব্র; অনেকটা মাথার ভেতরে হাতুড়ি পিটানোর মতো। সেই সঙ্গে অস্থিরতা এবং মাথার এক পাশে তীব্র ব্যথা হয়ে থাকে। মাইগ্রেনের কারণে ব্যথার সঙ্গে বমি ভাব, বমি হওয়া, আলো ও শব্দের প্রতি সংবেদনশীলতা সৃষ্টি হতে পারে। এই ধরণের লক্ষণ দেখা দিলে নিজে নিজে ওষুধ না খেয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
সাধারণত রোগীরা বুঝতে পারেন যে কখন তার মাইগ্রেনের এটাক হবে, এই বিষয়টিকে অরা বলা হয়। অরা হচ্ছে চোখের সামনে রূপালী দাগ বা জিগজ্যাগ লাইন দেখতে পাওয়া। দুশ্চিন্তাজনিত মাথাব্যথা সাধারণত সকাল থেকেই অল্প মাত্রায় শুরু হয় এবং দিন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যথাও বাড়তে থাকে। তবে এই ব্যথায় রোগী কষ্ট পেলেও সাধারণ কাজকর্ম চালিয়ে যেতে পারে। আবার অনেক সময় আবহাওয়া পরিবর্তনের সময় সাইনাস এর এটাক বাড়তে পারে। সেক্ষেত্রে কপালে, নাকের পাশে ব্যথা অনুভূত হয়।
Advertisement
জাগো নিউজ: মাইগ্রেন কি কখনও পুরোপুরি সেরে যায়?
ডা. ইমরান রহমান তুর্জ: মাইগ্রেন সাধারণত নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে হয়। কারও কারও আবার বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মাইগ্রেন ঠিকও হয়ে যেতে পারে। এর কোনো নির্দিষ্ট প্রতিকার নেই। তবে ট্রিগার ও লক্ষণগুলো নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
জাগো নিউজ: মাইগ্রেনের ভয়াবহতা কতোখানি?
ডা. ইমরান রহমান তুর্জ: মাইগ্রেন কখনও প্রাণঘাতী রোগ না। তবে এই মাথাব্যথা কয়েক ঘণ্টা থেকে কয়েক দিনও থাকতে পারে । রোগীরা বলে থাকেন - মাথাব্যথার পরিমাণ এত বেশি হয় যে, তাদের দৈনন্দিন কাজ করাটাও খুব কষ্টসাধ্য হয়ে যায় ।
জাগো নিউজ: মাইগ্রেন থাকলে কোন কোন কাজ থেকে বিরত থাকা উচিত?
ডা. ইমরান রহমান তুর্জ: একেকজন রোগীর একেকটি বিষয়ে ব্যথা ট্রিগার করতে পারে। তবে কিছু সাধারণ বিষয় আছে, যেগুলো নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে বেশ কিছু ট্রিগার এড়ানো সম্ভব। যেমন-
১. স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট: রিলাক্সেশন কৌশল, বায়োফিডব্যাক এবং স্ট্রেস কমানোর অন্যান্য উপায় উপকারী হতে পারে।
২. ঘুমের স্বাস্থ্যবিধি: নিয়মিত ঘুমের সময়সূচী বজায় রাখা এবং পর্যাপ্ত ঘুম নিশ্চিত করা মাইগ্রেন প্রতিরোধে সাহায্য করতে পারে।
৩. ডায়েট: নিয়মিত খাবার খাওয়া এবং পানিশূন্যতার বিষয়ে সচেতন থাকা দরকার।
৪. ব্যায়াম: নিয়মিত অ্যারোবিক ব্যায়াম ঘন ঘন মাইগ্রেনের ব্যথা কমাতে পারে।
৫. মাথাব্যথার ডায়েরি: মাথাব্যথার ডায়েরি রেখে ডাক্তারকে ট্রিগার সনাক্ত করতে সাহায্য করলে সঠিক চিকিৎসা পাওয়া সহজ হয়।
এছাড়াও ব্যথার তীব্রতা ও শরীরের অন্যান্য লক্ষণের ওপর ভিত্তি করে চিকিৎসকগণ বেশ কিছু ওষুধ প্রেসক্রাইব করে থাকেন। যেমন, বিটা-ব্লকার, অ্যান্টিকনভালসেন্টস, অ্যান্টিডিপ্রেসেন্টস ও ক্যালসিয়াম চ্যানেল ব্লকার জাতীয় ওষুধ। তবে অবশ্যই কোনো রেজিস্টার্ড ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া এই ওষুধগুলো খাওয়া উচিত না।
নিজের মাথাব্রথার ট্রিগারগুলো চেনা ও স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের মাধ্যমে এই তীব্র মাথাব্যথাকে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। সেই সঙ্গে যথেষ্ট পানি পান করুন এবং আনন্দময় জীবনযাপনে মনোযোগ দিন।
এএমপি/জিকেএস