তাহমিনা শিল্পী
Advertisement
‘ছড়ার বাড়ি অচিনপুর’ শুধু ছড়ার বই নয়। একটি অনুভবের ভুবন। যেখানে ছন্দের দোলায় ভেসে আসে সমাজ, দেশ, প্রকৃতি, মাটি-মায়ের প্রতি গভীর প্রেম ও দায়বদ্ধতা। মঈন মুরসালিন এই বইয়ে ছড়া লেখার কৌশলগত দক্ষতা ও মননশীল চিন্তার পরিচয় দিয়েছেন। প্রতিভা প্রকাশ থেকে প্রকাশিত ৮০ পৃষ্ঠার বইটিতে ৬৪টি ছড়া স্থান পেয়েছে। যার প্রতিটি ছড়াই শিশু-কিশোরদের উপযোগী হলেও প্রাপ্তবয়স্ক পাঠককেও ভাবনায় ডুবিয়ে দেয়।
বইয়ের প্রতিটি ছড়ায় আছে বিষয়বৈচিত্র্য। কখনো ছড়ার ছন্দে উঠে এসেছে শহুরে জীবনের কঠিন বাস্তবতা। কখনোবা মায়ের প্রতি মমত্ব। আবার কখনো বিজয়ের আনন্দে খেলে গেছে শিশুসুলভ উচ্ছ্বাস। বইটির ভাষা সহজ, সাবলীল এবং সুরেলা। এখানে শহর ও গ্রামের সম্মিলনের চিত্র ফুটে উঠেছে। শহুরে জীবনের কোলাহলে মানুষের অন্তর্গত কষ্ট, হারিয়ে যাওয়া শেকড় ও পরিচয়ের সংকটকে সংক্ষিপ্ত অথচ গভীরভাবে তুলে ধরেছেন। ছড়াকার বলেছেন, ‘এই শহরের পেটের ভিতর/ গ্রাম গিয়েছে ঢুকে/ এই শহরে আমরা থাকি/ কষ্ট নিয়ে বুকে।’ (হারিয়ে গেছে, পৃষ্ঠা-১২)
ছড়ায় মাকে তুলনা করা হয়েছে মাতৃভূমি ও জীবনের প্রেরণার উৎস হিসেবে। মা কেবল একজন মানুষ নন বরং একটি আলোকবর্তিকা। যিনি সন্তানকে পথ দেখান। তাই তো তিনি বলেছেন, ‘মা যে আমার সবুজ ভূমি/ একটি নতুন ভোর/ মা যে আমার জীবন চলার/ দেয় খুলে দেয় দোর।’ (মায়ের আঁচল, পৃষ্ঠা-১৪)। শিশুদের চেতনায়ও মা এমনই একটি অনুপম অনুরণন। এখানে মা মানে ভালোবাসা, নিরাপত্তা এবং আবেগের পরিপূর্ণ আশ্রয়। তাই তো দেখি, ‘একটি ছবি আঁকতে গেলেই/ মায়ের ছবি ভাসে/ মায়ার চাদর জড়িয়ে শুধু/ মা-ই ফিরে আসে।’ (মায়ের ছবি, পৃষ্ঠা-৩১)
Advertisement
‘বিজয় এলো পাখির গানে’ ছড়ায় আছে বিজয়ের আনন্দ আর পাখির কণ্ঠে উচ্চারিত ইতিহাসের সৌন্দর্য। শিশুদের অনুভবের উপযোগী এক অপূর্ব প্রকাশভঙ্গি। যেমন- ‘বিজয় এলো বাংলাদেশে/ পাখির গানে গানে/ সেই কথাটি একটি পাখি/ বলল কানে কানে।’ (পৃষ্ঠা-১৬)। একই ছড়ার শেষ অংশে আছে, ‘স্বাধীন দেশের সেই সে পাখি/ হারিয়ে গেছে ভিড়ে/ বিজয় দিনে আয় না বন্ধু/ আয় না আবার ফিরে।’ ছড়াটি এখানেই এক বিষণ্ণ বাস্তবতায় এসে পৌঁছায়। বিজয়ের আনন্দ যেমন আছে; তেমনই বিজয়ের পর হারিয়ে যাওয়া মূল্যবোধের যন্ত্রণাও আছে।
আরও পড়ুনবইয়ের শিরোনামে চৈত্রমাসবৈশাখী শিরোনামে যত বই‘ছবির মতো দেশ’ ছড়াটিতে আছে দেশের প্রতি ভালোবাসা ও গর্ব। শিশুসুলভ কল্পনার জগতে দেশের রূপ-রস-গন্ধ যেন এক স্বপ্নময় চিত্রকল্প। তিনি বলেছেন, ‘আমার সাথে আসলে পাবে/ আকাশ ভরা তারা/ ছবির মতো দেশটি আমার/ ছড়িয়ে দিয়ে সকল বাহার/ করবে পাগলপারা।’ (পৃষ্ঠা ২৯)। এ ছাড়া একুশে ফেব্রুয়ারি এবং ভাষা শহীদদের স্মরণে একটি আবেগঘন ছড়াও আছে। ফাগুনের আগমনে যে তীব্র বেদনা জেগে ওঠে, তা হৃদয় ছুঁয়ে যায়। ছড়াকারের ভাষায়, ‘ফাগুন এলেই কষ্ট জাগে/ মনের কিনারে/ স্মৃতির টানে যাই ছুটে যাই/ শহীদ মিনারে।’ (শহীদ মিনারে, পৃষ্ঠা-৫২)
মা, মাটি, দেশ ও ভাষার টরেও বৃক্ষের প্রতি তার টান লক্ষণীয়। তাই তো ‘বৃক্ষ বাঁচাও’ ছড়াটিতে বলেছেন, ‘এই পৃথিবীর বৃক্ষগুলো/ সব যদি যায় মরে/ মানুষ তবে সুস্থভাবে/ বাঁচবে কেমন করে?’ (পৃষ্ঠা ৩৪)। ছড়াটি পরিবেশ সচেতনতার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে। শিশুদের মাঝে প্রাকৃতিক ভারসাম্য ও গাছপালার গুরুত্ব বোঝাতে এর চেয়ে সরল অথচ কার্যকর ছন্দ আর হয় না। এমনকি ঈদের খুশি, নতুন পোশাকের আনন্দ আর সবার সঙ্গে ভাগাভাগির চিত্র ছড়ার ছন্দে মিশে তৈরি হয়েছে উজ্জ্বল সংস্কৃতির প্রতিচ্ছবি। তিনি ‘ঈদের দিনে’ ছড়ায় বলেছেন, ‘ঈদের দিনে তৈরি হলাম/ নতুন জামা পরে/ নামাজ শেষে যাচ্ছি আমি/ সবার ঘরে ঘরে।’ (পৃষ্ঠা ৪১)
‘ছড়ার বাড়ি অচিনপুর’ শুধু শিশুদের বই নয়। এটি একই সময়, অনুভব ও ভাবনা। যা আমাদের শেকড়, সমাজ ও ভবিষ্যতের প্রতি মনোযোগী করে। মঈন মুরসালিন শিশুদের চোখ দিয়ে দেখিয়েছেন সমাজ, প্রকৃতি, মা, দেশ ও ইতিহাসকে। এই ছড়ার ছন্দে ছড়িয়ে থাকা কথামালা নতুন প্রজন্মকে পথ দেখাবে। বইটি নিঃসন্দেহে বাংলা ছড়াসাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। একই সঙ্গে নিয়াজ চৌধুরী তুলির আঁকা প্রচ্ছদটি মন কেড়ে নেয়।
Advertisement
এসইউ/জেআইএম