রাশেদুল হাসান এই সময়ের আলোচিত তরুণ কবি। তার কাছে কবিতা অনুভূতির এক নৈঃশব্দ্য যাত্রা। যেখানে মিশে আছে বিরহের নীল সুর। বিষণ্নতার ম্লান আলো আর ফিরে পাওয়ার আকুল প্রার্থনা। প্রতিটি পঙ্ক্তির ভাঁজে লুকিয়ে আছে হারানোর ব্যথা, স্মৃতির সুরভী আর অনন্ত অপেক্ষার রং। এখানে শব্দেরা আঁকে গভীর এক নিঃসঙ্গ সন্ধ্যা। কখনোবা আশার আলোর হৃদয় জুড়ানো মৃদু ঝলকানি। প্রেমের অপূর্ণতা, দূরত্বের হাহাকার কিংবা পুনর্মিলনের স্বপ্ন—সবকিছুই এখানে শব্দের সুরেলা আবরণে বন্দি।
Advertisement
যারা কবিতাকে হৃদয়ের গভীরে অনুভব করতে ভালোবাসেন; তাদের জন্যই এই শব্দের মায়াবী ভুবন। শুধু তা-ই নয়, বইয়ের উৎসর্গপত্রে চোখ পড়তেই চমকে যাবেন; যখন দেখবেন তাতে লেখা আছে—‘উৎসর্গ করার মানুষটি হারিয়ে গেছে’। এমন উৎসর্গপত্র আমার চোখে কখনো পড়েনি। আপনারা কখনো দেখেছেন কি না, আমার অবশ্য জানা নেই।
রাশেদুল হাসানের বইটিতে মোট ৫৮টি কবিতা স্থান পেয়েছে। এখানে মাকে নিয়ে কবিতা দিয়ে যাত্রা শুরু হয়েছে। শুরুটাই যেন পাঠককে মুগ্ধ করে ফেলেছে। কবির ভাষায়, ‘মা চড়া দামে দুঃখ কেনেন/ সুখগুলো বিনাদরে ভাগ করে দেন;/ তার কপালে লেখা থাকে লবণের হিসাব/ মুঠোয় ভরে তুলে আনেন স্বপ্নের ভাঙা টুকরো।’ (মা, পৃ-৬)
তার কবিতায় মানবিকতা, প্রেম, ঘৃণা, বিষাদ, প্রতিবাদ, শূন্যতা, বিষণ্নতা, বিচ্ছেদ, পরিবেশ, প্রকৃতিসহ নানাবিধ প্রসঙ্গ উঠে এসেছে। তাই তো আক্ষেপের সুরে কবি বলেছেন, ‘সঙ্গম করি জোছনার সাথে/ বিষাদের বিছানায়।’ (জোছনার সাথে সঙ্গম, পৃ-১৩)
Advertisement
কবিতা নিয়ে তিনি নানাবিধ কৌশলের আশ্রয় নিয়েছেন। তার টুকরো পদ্যে দুই লাইন, চার লাইন এবং ছয় লাইনের কবিতা স্থান পেয়েছে। নয় সংখ্যায় উল্লেখিত এই গুচ্ছে বিভিন্ন বিষয় উঠে এসেছে। কবির ভাষায়, ‘কবিতারা কবিতায় রূপ ধরে আসে/ সে রূপের মোহজলে কবিরা ভাসে।’ (টুকরো পদ্য: ০৯, পৃ-১৭)
‘নিস্তব্ধ রাতগুলো’ কবি রাশেদুল হাসানের একটি গদ্যকবিতা। গল্পের ঢঙে তিনি একটি রাতের গল্প তুলে ধরেছেন। তাতে প্রতীয়মান হয়, একজন লেখক রাত জেগে কীভাবে তার সৃষ্টির সঙ্গে সময় কাটান। কবির কলমে কীভাবে উঠে আসে কবিতার চরণ। গভীর রাতে গল্পের সঙ্গে লেখকের মেতে ওঠার স্মৃতিগুলো উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে।
কবি যখন বলেন, ‘সমুদ্র আর নদীর মাঝে কোনো সেতু নেই’। তখন কবিকে কেবল দার্শনিকই মনে হয়। কতটা গভীর দৃষ্টিভঙ্গি থাকলেই কেবল এমন করে বলা যায়। তিনি বলতে চান, ভাঙা তরীরও গল্প আছে। কবির ভাষায়, ‘বুকে চাপা দেওয়া নীরব কান্না/ আর ফিকে হয়ে যাওয়া মানচিত্রের রেখা/ সবই ভেসে ওঠে।’ (চিরকুট, পৃ-২৪)
আরও পড়ুন
Advertisement
কবিতায় আঞ্চলিকতার ব্যবহার নতুন নয়। সৈয়দ শামসুল হক আঞ্চলিক ভাষায় কবিতা লিখেও বাজিমাৎ করেছিলেন। তবে রাশেদুল হাসান প্রমিত কবিতায় আঞ্চলিক সংলাপ যুক্ত করে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। কবি লিখেছেন, ‘মাগির হুত আর বন্ধু রে মারি তুই বাঁইচতি হাইত্তিনু;/ আঁই তোরে খুন করি হালামু।’ (ভালোবাসা বিষয়ক বোধ, পৃ-৩৮)
‘আর কবিতা লিখবো না’ বলেও কবি নিয়মিত হয়তো লিখে যাচ্ছেন। কেননা তার ‘জড়িয়ে ধরার মানুষ নেই’। এমনকি তার সঙ্গে ‘কবিতা মিথ্যে কথা বলে’। তারপরও কবি বলছেন, ‘আমি কাউকে ঠকাইনি’ (পৃ-৪৭)। অথচ ‘ঠকেছি’ কবিতায় কবি ঠকেছেন বলেই স্বীকার করেছেন।
রাশেদুল হাসান মায়ের পাশাপাশি বাবাকে নিয়েও কবিতা লিখেছেন। এ ছাড়া কবিতা শেষ করেছেন ‘মোনাজাত’র মধ্য দিয়ে। একই সঙ্গে লিখেছেন ‘কান্নানামা’ এবং ‘আয়নাঘর’ও। কবি বলেছেন, ‘মোনাজাতে তোমাকে চাই/ আলো হয়ে, শান্তি হয়ে;/ জীবন পথের বাঁকে—/ তোমাকে চাই, আর কিছু নয়।’ (মোনাজাত, পৃ-৬৪)
সবচেয়ে মজার বিষয় হলো—বইয়ের যে শিরোনাম; এই শিরোনামে বইয়ে কোনো কবিতা নেই। বরং ‘আর্তনাদ’ শিরোনামে একটি কবিতার প্রথম লাইন হচ্ছে ‘থাকার জন্য সবাই আসে না—’ (পৃ-৪১)। এখান থেকেই তিনি বইটির নামকরণ করেছেন। সে হিসেবে তার নামকরণ সার্থক হয়েছে বলে মনে করি।
পেশায় সংবাদকর্মী রাশেদুল হাসান সময়-সুযোগ পেলে কবিতা, প্রবন্ধ, কলাম লিখে থাকেন। দুই দশকের বেশি সময় ধরে সাহিত্যচর্চা করেও তিনি এই প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেছেন। এটি আমার কাছে উত্তম সিদ্ধান্ত মনে হয়েছে। তবে আশা করবো বই প্রকাশের ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে।
ভবিষ্যতে নতুন কোনো বইয়ের জন্য অপেক্ষায় থাকবো আমরা। আমি তার বইয়ের বহুল পাঠ ও প্রচার কামনা করছি। এই যাত্রা যেন থমকে না যায়। কবির জন্য শুভ কামনা।
বইয়ের নাম: থাকার জন্য সবাই আসে নাকবির নাম: রাশেদুল হাসানধরন: কাব্যগ্রন্থপ্রকাশক: ছিন্নপত্র প্রকাশনপ্রচ্ছদ: সফেদ পান্থমূল্য: ২০০ টাকা।
এসইউ/এমএস