দেশে নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত কারখানা, দোকান ও প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শ্রমিক ৪৪ লাখ ৪০ হাজার ১৭৯ জন। এর মধ্যে তৈরি পোশাক (আরএমজি) খাতেরই ১৮ লাখ ১০ হাজার ৬৮৭ জন। বাকি ২৬ লাখ ২৯ হাজার ৪৯২ জন শ্রমিক নন-আরএমজি খাতের।
Advertisement
দেশের মোট প্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিকের ৪০ দশমিক ৭৮ শতাংশই তৈরি পোশাক শিল্পের সঙ্গে যুক্ত। কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের (ডিআইএফই) প্রতিবেদনে এমন তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদনটি ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত তথ্য নিয়ে তৈরি।
অবশ্য কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের এ তথ্য সঠিক নয় বলে দাবি খাত সংশ্লিষ্টদের। তারা বলছেন, পোশাক খাতে ১৮ লাখ শ্রমিক কর্মরত- এ তথ্য সঠিক নয়। পোশাক খাতে কমপক্ষে ৩৫ লাখ শ্রমিক আছেন। অবশ্য কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে- সারাদেশে অবস্থিত ৩১টি উপমহাপরিদর্শকের কার্যালয়ের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করে এ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। উপমহাপরিদর্শকের কার্যালয় থেকে যে তথ্য পাওয়া গেছে, এখানে তারই প্রতিফল ঘটেছে।
ডিআইএফই তাদের উপ-মহাপরিদর্শকের কার্যালয় থেকে যে তথ্য পেয়েছে তার ভিত্তিতেই হয়তো এ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। তবে আমার মনে হয় সারাদেশে প্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিকের সংখ্যা আরও বেশি হবে।- শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রধান সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহম্মদ
Advertisement
ডিআইএফইর তথ্য অনুযায়ী, ঢাকাসহ সারাদেশে মোট কারখানা আছে ৪৮ হাজার ৩৯৪টি। এর মধ্যে আরএমজি খাতের তিন হাজার ২৪৮টি এবং নন-আরএমজি খাতের কারখানা ৪৫ হাজার ১৪৬টি। অঞ্চলভিত্তিতে সবচেয়ে বেশি কারখানা রয়েছে নারায়ণগঞ্জে। আর কারখানায় কাজ করা শ্রমিকের সংখ্যা সর্বাধিক গাজীপুরে।
গাজীপুরে ১ হাজার ১২৫টি আরএমজি কারখানায় ৯ লাখ ৫ হাজার ২৪৯ জন শ্রমিক কর্মরত এবং এক হাজার ৫১৯টি নন-আরএমজি কারখানায় কর্মরত ৮ লাখ ২৮ হাজার ১০৫ জন। অর্থাৎ, গাজীপুরে আরএমজি এবং নন-আরএমজি মিলিয়ে মোট দুই হাজার ৬৪৪টি কারখানায় ১৭ লাখ ৩৩ হাজার ৩৫৪ জন শ্রমিক কর্মরত।
অপরদিকে, নারায়ণগঞ্জে আরএমজি ও নন-আরএমজি মিলিয়ে মোট কারখানা চার হাজার ৮০৬টি। এর মধ্যে আরএমজি খাতের কারখানা এক হাজার তিনটি এবং তিন হাজার ৮০৩টি নন-আরএমজি কারখানা। এসব কারখানায় মোট শ্রমিক কর্মরত তিন লাখ ৩০ হাজার ২৯০ জন। এর মধ্যে আরএমজি খাতে দুই লাখ ৪০ হাজার ৫১০ জন এবং নন-আরএমজি খাতে ৮৯ হাজার ৭৮০ জন।
রাজধানী ঢাকায় ৬৯৫টি আরএমজি কারখানায় কর্মরত তিন লাখ ১২ হাজার ২৫০ জন শ্রমিক। আর নন-আরএমজি দুই হাজার ৬৭৫টি কারখানায় কর্মরত এক লাখ ৫৫ হাজার শ্রমিক। সব মিলিয়ে ঢাকার তিন হাজার ৩৭০টি কারখানায় কর্মরত চার লাখ ৬৭ হাজার ২৫০ জন শ্রমিক।
Advertisement
এছাড়া চট্টগ্রামে ২৮৯টি আরএমজি কারখানায় এক লাখ ৬০ হাজার ৩৭৯ জন এবং ৩ হাজার ৭১১টি নন-আরএমজি কারখানায় দুই লাখ ১৯ হাজার ৫১ জন শ্রমিক আছেন। নরসিংদীতে ছয়টি আরএমজি কারখানায় ২১ হাজার ৩১২ জন এবং নন-আরএমজি এক হাজার ৫৮২টি কারখানায় ৩৮ হাজার ৭৩৬ জন। টাঙ্গাইলে নয়টি আরএমজি কারখানায় ২৪ হাজার ৮২০ এবং নন-আরএমজি এক হাজার ৫৯৭টি কারখানায় ৯২ হাজার ৫৮২ জন শ্রমিক।
ময়মনসিংহ অঞ্চলে ৮৩টি আরএমজি কারখানায় এক লাখ ১৪ হাজার এবং নন-আরএমজি দুই হাজার ৩৯৫টি কারখানায় দুই লাখ ৩০ হাজার শ্রমিক। কুমিল্লায় ছয়টি আরএমজি কারখানায় এক হাজার ৮৫০ জন এবং নন-আরএমজি এক হাজার ২১৬টি কারখানায় ১৩ হাজার ৯২৯ জন শ্রমিক। রাজশাহীতে দুটি আরএমজি কারখানায় ৩০৬ এবং নন-আরএমজি এক হাজার ৫০টি কারখানায় ৫ হাজার ২৫০ জন শ্রমিক।
আমি মনে করি শ্রমিকের এ সংখ্যা সঠিক নয়। এক সময় আমরা বলতাম গার্মেন্টসে ৪০-৪২ লাখ শ্রমিক। ডিজিটালাইজেশনের কারণে শ্রমিকের সংখ্যা একটু কমেছে। একটু কমা মানে ৪২ লাখ থেকে সেটা হতে পারে ৩৫ লাখ বা ৩৬-৩৭ লাখ। কিন্তু কোনো অবস্থায় গার্মেন্টস সেক্টরে ৩৫ লাখের কম শ্রমিক কাজ করে না।- জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশন সভাপতি আমিরুল হক আমিন
সিরাজগঞ্জে একটি আরএমজি কারখানায় ৯০০ এবং নন-আরএমজি এক হাজার ৩২৩টি কারখানায় ৩০ হাজার ৫৯৯ জন শ্রমিক। রংপুরে নয়টি আরএমজি কারখানায় ৯২০ এবং নন-আরএমজি দুই হাজার ২০৭টি কারখানায় ৪২ হাজার ৫০৮ জন শ্রমিক। যশোরে নয়টি আরএমজি কারখানায় পাঁচ হাজার ৫২১ এবং নন-আরএমজি এক হাজার ২২৭টি কারখানায় ৭৫ হাজার ৮০৫ জন শ্রমিক আছেন।
মৌলভীবাজারে চারটি আরএমজি কারখানায় ৯ হাজার ৯৫০ জন এবং নন-আরএমজি এক হাজার ৯৫৭টি কারখানায় এক লাখ ৬২ হাজার ৯১৮ জন শ্রমিক। রাঙ্গামাটিতে একটি আরএমজি কারখানায় এক হাজার ৯০ জন এবং নন-আরএমজি ১৬১টি কারখানায় ১৭ হাজার ৫৬৬ জন শ্রমিক কর্মরত। গোপালগঞ্জে দুটি আরএমজি কারখানায় ৯০ জন এবং নন-আরএমজি ৪২৭টি কারখানায় পাঁচ হাজার ২৭০ জন শ্রমিক কর্মরত। মানিকগঞ্জে চারটি আরএমজি কারখানায় ১১ হাজার ৫৪০ এবং নন-আরএমজি ৫৩৫টি কারখানায় ৩২ হাজার ৩০০ জন শ্রমিক কর্মরত।
এদিকে উপ-মহাপরিদর্শকের কার্যালয় রয়েছে এমন ১৫টি অঞ্চলে কোনো আরএমজি কারখানা নেই। এর মধ্যে রয়েছে- নওগাঁ, ফেনী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, জামালপুর, কক্সবাজার, বরিশাল, সিলেট, কুষ্টিয়া, খুলনা, দিনাজপুর, বগুড়া, পাবনা, কিশোরগঞ্জ, ফরিদপুর ও মুন্সিগঞ্জ। এ অঞ্চলগুলোতে আরএমজি কারখানা না থাকলেও নন-আরএমজি কারখানা রয়েছে।
এর মধ্যে নওগাঁ অঞ্চলে ৯২৮টি কারখানায় ২২ হাজার ৬১২ জন, ফেনীতে এক হাজার ৪৩৯টি কারখানায় ছয় হাজার ২৮৯, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৮৩৯টি কারখানায় ২৫ হাজার ৯৫, জামালপুরে ৮৩৭টি কারখানায় ১৮ হাজার ৪৫০, কক্সবাজারে ৮৪০টি কারখানায় ১৭ হাজার ১৫৪, বরিশালে এক হাজার ৩৩টি কারখানায় ৪৬ হাজার ২৬, সিলেটে এক হাজার ২৩৫টি কারখানায় ৩৮ হাজার ৭৮৬ এবং কুষ্টিয়ায় এক হাজার ১৭২টি কারখানায় ২৭ হাজার ৩৮০ জন শ্রমিক কর্মরত।
এছাড়া খুলনার এক হাজার ৬০৮টি কারখানায় এক লাখ ৩২ হাজার ২০৯ জন, দিনাজপুরের এক হাজার ১০০টি কারখানায় ১৮ হাজার ৯৯৯, বগুড়ার এক হাজার ৫৫৪টি কারখানায় ৪৯ হাজার ৩৫২, পাবনার দুই হাজার ৫৭৫টি কারখানায় ৯০ হাজার ৮০২, কিশোরগঞ্জের এক হাজার ২৪৫টি কারখানায় ১০ হাজার ৪০৩, ফরিদপুরের ৭০৪টি কারখানায় ৬২ হাজার ৪১২ এবং মুন্সিগঞ্জের ৬৫২টি কারখানায় ২৪ হাজার ১২৪ জন শ্রমিক আছেন।
শ্রমিক নিয়ে ডিআইএফইর প্রতিবেদনের তথ্য তুলে ধরা হলে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) নির্বাহী পরিচালক ও শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রধান সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহম্মদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘ডিআইএফই তাদের উপ-মহাপরিদর্শকের কার্যালয় থেকে যে তথ্য পেয়েছে তার ভিত্তিতেই হয়তো এ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। তবে আমার মনে হয় সারাদেশে প্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিকের সংখ্যা আরও বেশি হবে।’
দেশে যে প্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিক রয়েছে তার প্রায় অর্ধেক আরএমজি খাতের। বিষয়টি কীভাবে দেখছেন? এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘আমরা এক শিল্পকেন্দ্রিক হয়ে গেছি। এখন আমাদের জাতীয় নীতি হলো কীভাবে আমরা এক শিল্পকেন্দ্রিক অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে পারবো। এজন্য আমাদের নিজস্ব কাঁচামালভিত্তিক যে শিল্প আছে, যেমন- ফুড প্রসেসিং, অ্যাগ্রো প্রসেসিং এবং আমাদের যুব সমাজকে কেন্দ্র করে যে আইটি সেক্টর- এগুলো ডেভেলপ করতে হবে।
জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশন সভাপতি আমিরুল হক আমিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি মনে করি শ্রমিকের এ সংখ্যা সঠিক নয়। এক সময় আমরা বলতাম গার্মেন্টসে ৪০-৪২ লাখ শ্রমিক। ডিজিটালাইজেশনের কারণে শ্রমিকের সংখ্যা একটু কমেছে। একটু কমা মানে ৪২ লাখ থেকে সেটা হতে পারে ৩৫ লাখ বা ৩৬-৩৭ লাখ। কিন্তু কোনো অবস্থায় গার্মেন্টস সেক্টরে ৩৫ লাখের কম শ্রমিক কাজ করে না। এছাড়া ঢাকার ভিতরে ও কেরানীগঞ্জে যেসব কারখানা আছে, সেগুলো বিবেচনায় নিলে ঢাকার ভিতরেই প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক আছে।’
আমাদের যে শ্রমিক তার অধিকাংশই পোশাক খাতের। এমন এক শিল্পকেন্দ্রিক হয়ে যাওয়া ভালো লক্ষণ কি না? এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘আমাদের গার্মেন্টস সেক্টর আশির দশক থেকে শুরু। স্বাধীনতার আগে ছিল একটা। এখন সেটা সাড়ে তিন-চার হাজার হয়ে গেছে। এটা এখন আমাদের জন্য একটা ঝুঁকিপূর্ণ জায়গা। ঝুঁকিপূর্ণ জায়গা এ কারণে যে, দেশের ৮৪ শতাংশ রপ্তানি শুধু একটা সেক্টর থেকে হয়। কাজেই আমাদের দ্রুত প্রয়োজন এটাকে ডাইভারসিফাই করা এবং বিভিন্ন শিল্পের দিকে ঝোঁকা।’
বিষয়টি নিয়ে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক ওমর মো. ইমরুল মহসিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘ফর্মাল সেক্টরের নিবন্ধিত কারখানার তথ্যের ভিত্তিতে শ্রমিকদের এ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। আমাদের ৩১টি জেলায় কার্যালয় রয়েছে। এসব কার্যালয়ের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করে সারাদেশের চিত্র প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে। এখানে নিবন্ধিত শ্রমিকের যে তালিকা আছে, সেটা সঠিকই আছে। এখানে নন-ফর্মাল সেক্টরের তথ্য উল্লেখ করা হয়নি।’
এমএএস/এএসএ/জেআইএম