ময়মনসিংহ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় চামড়ার হাট শহরতলীর শম্ভুগঞ্জে। এই হাটে সারাবছর চামড়া বেচাকেনা হয়। তবে কোরবানির ঈদকে কেন্দ্র করে চামড়া ব্যবসায়ী কয়েকগুণ বেড়ে যায়। ঈদের কয়েকদিন আগে থেকে চামড়া ব্যবসায়ীরা বিপুল পরিমাণ লবণ মজুত করেন। আগামী শনিবার (৭ জুন) ঈদুল আযহা উদ্যাপিত হবে। এখনো চামড়া ব্যবসায়ীদের লবণ মজুত করার তেমন তোড়জোড় নেই। গুটিকয়েক ব্যবসায়ী লবণ মজুত করলেও বেশিরভাগ এখনো করেননি।
Advertisement
তারা আর্থিক সংকটে ভুগছেন বলে জানা গেছে। লবণ কেনার টাকাসহ চামড়া কেনার টাকা সংগ্রহ করতে অনেকে বিভিন্ন সমিতির দ্বারস্থ হচ্ছেন। দাদন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে উচ্চ সুদে ঋণও নিচ্ছেন কেউ কেউ। এরমধ্যে চামড়ার ন্যায্য দাম পাওয়া নিয়েও রয়েছে শঙ্কা। ট্যানারি মালিকদের কাছে চামড়া সরকার নির্ধারিত দামে বিক্রি করতে পারবেন কিনা, তা নিয়ে অনেকের কপালে যেন চিন্তার ভাঁজ পড়েছে।
বুধবার (২৮ মে) সকালে সরেজমিনে শম্ভুগঞ্জ চামড়া হাটে গিয়ে দেখা যায়, কয়েকজন চামড়া ব্যবসায়ী চামড়ার হাটের কোনায় চা স্টলে বসে আছেন। হাটে লবণ ছিটিয়ে যৎসামান্য চামড়া মজুত করে রাখা হয়েছে। দুই ব্যবসায়ী কিছু চামড়ায় লবণ ছিটিয়ে ভাজ করে রাখছেন। চামড়া বেচাকেনা নিয়ে বিভিন্ন কথাবার্তা চলছে কয়েকজন ব্যবসায়ীদের মধ্যে।
আরও পড়ুন
Advertisement
চায়ে চুমুকের ফাঁকে কেউ বলছেন, এবার চামড়ার বাজার ভালো যাবে। এতে ক্রেতা-বিক্রেতাদের মধ্যে স্বস্তি ফিরবে। আবার কেউ বলছেন, এবারও সিন্ডিকেট করতে পারেন ট্যানারি মালিকরা।
তারা আর্থিক সংকটে ভুগছেন বলে জানা গেছে। লবণ কেনার টাকাসহ চামড়া কেনার টাকা সংগ্রহ করতে অনেকে বিভিন্ন সমিতির দ্বারস্থ হচ্ছেন। দাদন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে উচ্চ সুদে ঋণও নিচ্ছেন কেউ কেউ। এরমধ্যে চামড়ার ন্যায্য দাম পাওয়া নিয়েও রয়েছে শঙ্কা। ট্যানারি মালিকদের কাছে চামড়া সরকার নির্ধারিত দামে বিক্রি করতে পারবেন কিনা, তা নিয়ে অনেকের কপালে যেন চিন্তার ভাজ পড়েছে।
এসময় সাংবাদিক পরিচয়ে কথা হয় কয়েকজন চামড়া ব্যবসায়ীর সঙ্গে। তারা জাগো নিউজকে বলেন, সরকার যে দাম নির্ধারণ করে দেয়। সে দামে এই বাজারে চামড়া বিক্রি হয় না। গতবছরও আমরা ট্যানারি মালিকদের নির্ধারিত দামে বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছি। এ বছর দাম কেমন হবে তা ট্যানারি মালিকদের ওপরই নির্ভর করছে। তারা ভালো দাম না দিলে ফরিয়া ব্যবসায়ীরা চরম ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
হাটে ওঠা চামড়া-ছবি জাগো নিউজ
Advertisement
তারা জানান, কোরবানির পর এ হাটে বিভাগের ময়মনসিংহ, নেত্রকোণা, শেরপুর, জামালপুর ছাড়াও কিশোরগঞ্জ, টাঙ্গাইল, গাজীপুর ও সিলেট বিভাগের বিভিন্ন জেলা থেকেও চামড়া নিয়ে আসেন ব্যবসায়ীরা। সারাবছরের প্রতি শনিবার গরুর ১ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার পিস ভালো মানের চামড়া বেচাকেনা হয়। এসময় খাসির ২০০-৩০০ পিস চামড়া এই হাটে আসে। সারাবছর ৭-৮ জন ব্যবসায়ী চামড়া কেনা-বেচা করলেও কোরবানির ঈদের সময় ২০-২২ জন ব্যবসায়ী কেনা-বেচা করেন। প্রতি শনিবার ট্যানারি মালিকরা তাদের প্রতিনিধি পাঠিয়ে চামড়া কিনে গাড়িতে করে নিয়ে যান। আড়তের বর্তমান অবস্থা ভালো না। অন্যান্য বছরের বছরের তুলনায় এবার সারাবছর বিক্রি কম হওয়ার পাশাপাশি ন্যায্য দাম পাওয়া যায়নি। এরইমধ্যে কয়েকজন এই ব্যবসা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে গেছে। মোকাম ব্যবসায়ীরা ব্যাংক থেকে ঋণের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন।
শহরতলীর শম্ভুগঞ্জে ঋষিপাড়া এলাকার বাসিন্দা রাজ কুমার ঋষি। তিনি ৩২ বছর যাবত চামড়ার ব্যবসা করছেন। আগে তার বাপ-দাদারাও এই ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
আরও পড়ুন
কোরবানির চামড়া সংগ্রহে গরম নিয়ে দুশ্চিন্তা প্রয়োজনে কাঁচা চামড়া সংরক্ষণ করে বিদেশে রপ্তানি করা হবেরাজ কুমার ঋষি জাগো নিউজকে বলেন, আমরা ট্যানারি মালিকদের কাছে জিম্মি। তারা সরকার নির্ধারিত দাম মানেন না। ট্যানারি মালিকরা যে দামে নির্ধারণ করেন, সে দামেই বিক্রি করতে বাধ্য হই। সারাবছরের বেশিরভাগ সময় গরুর ভালো মানের চামড়া ৪০০-৫০০ টাকা পিস হিসেবে কিনেছি। চামড়া পরিষ্কার করে লবণ লাগানো শেষে ট্যানারি মালিকদের কাছে ৭৫০-৮৫০ টাকা পিস হিসেবে বিক্রি করেছি। এতে প্রতি চামড়ায় ৫০-১০০ টাকা লাভ হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে লসও হয়েছে। গত কোরবানির ঈদে গরুর ১ হাজার ২০০ পিস চামড়া কিনেছিলাম। এরমধ্যে কিছু চামড়ায় লবণ লাগানো অবস্থায় কিনেছিলাম। তখন ৫০০-৭০০ টাকা পিস হিসেবে কিনে চামড়া পরিষ্কার করে লবণ লাগানো শেষে ট্যানারি মালিকদের কাছে ৯০০-১০০০ টাকায় বিক্রি করেছি। খাসির চামড়া ১৫-২০ টাকা পিস হিসেবে কিনে সর্বোচ্চ ২৫-৩০ টাকায় বিক্রি করেছি। ট্যানারি মালিকরা সিন্ডিকেট করায় গত ঈদেও আমরা ন্যায্য দাম পাইনি।
আমরা ট্যানারি মালিকদের কাছে জিম্মি। তারা সরকার নির্ধারিত দাম মানেন না। ট্যানারি মালিকরা যে দামে নির্ধারণ করেন, সে দামেই বিক্রি করতে বাধ্য হই। সারাবছরের বেশিরভাগ সময় গরুর ভালো মানের চামড়া ৪০০-৫০০ টাকা পিস হিসেবে কিনেছি। চামড়া পরিষ্কার করে লবণ লাগানো শেষে ট্যানারি মালিকদের কাছে ৭৫০-৮৫০ টাকা পিস হিসেবে বিক্রি করেছি। এতে প্রতি চামড়ায় ৫০-১০০ টাকা লাভ হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে লসও হয়েছে।
তিনি বলেন, সরকার নির্ধারিত দামে ট্যানারি মালিকরা চামড়া কিনলে আমরা লাভের মুখ দেখতাম। কিন্তু তারা সিন্ডিকেট করে বরাবরই আমাদের ঠকাচ্ছে। এবার দাম না পেলে আর হয়তো ব্যবসা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না।
এই হাটে সারাবছর চামড়া বেচাকেনা হয়-ছবি জাগো নিউজ
এই বাজারের চামড়া ব্যবসায়ী ফকির শাহীন বলেন, চামড়া কেনার জন্য সরকার সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণ সুবিধা দিলেও এই সুবিধা আমরা পাচ্ছি না। এছাড়া চামড়া ব্যবসার জন্য ব্যাংক থেকে ঋণ পাওয়া যায় কিনা, সেটি জানে না বেশিরভাগ মোকাম ব্যবসায়ী। ফলে ব্যবসায়ীদের কেউ বিভিন্ন সমিতি থেকে, আবার কেউ কেউ দাদন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে উচ্চ সুদে ঋণ নিচ্ছেন। ট্যানারি মালিকরা সিন্ডিকেট করলে এবং সরকার নির্ধারণ দামে চামড়া বিক্রি না করতে পারলে আমরা চরম ক্ষতিগ্রস্ত হবো। এছাড়া সারাবছর চামড়ার বাজার ভালো যাচ্ছে না। ঈদেও দাম না পেলে অনেক চামড়া ব্যবসায়ীরা এই ব্যবসা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হবেন।
আরও পড়ুন
প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়া দাম ৫, খাসির ২ টাকা বাড়লো কোরবানির গরুর চামড়ার সর্বনিম্ন দাম ১১৫০ টাকা, ঢাকায় ১৩৫০এদিকে ঈদকে সামনে রেখে এরইমধ্যে কোরবানির পশুর চামড়ার নতুন দাম নির্ধারণ করেছে সরকার। গত বছরের তুলনায় এবার গরুর চামড়ার দাম বাড়ানো হয়েছে ৫ টাকা। আর খাসি ও বকরির চামড়ার দাম বাড়ানো হয়েছে ২ টাকা করে। ঢাকায় প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত গরুর চামড়ার দাম ৬০ থেকে ৬৫ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ৫৫ থেকে ৬০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। ঢাকায় সর্বনিম্ন কাঁচা চামড়ার দাম ১ হাজার ৩৫০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। আর ঢাকার বাইরে সর্বনিম্ন দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ১ হাজার ১৫০ টাকা। এছাড়া খাসির চামড়ার ক্রয়মূল্য প্রতি বর্গফুট ২২ থেকে ২৭ টাকা এবং বকরির চামড়ার দাম ২০ থেকে ২২ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
সরকার যে দাম বেঁধে দিয়েছে, সেই মূল্য দিয়েই ট্যানারি মালিকরা কিনলে প্রান্তিক পর্যায়ে চামড়া ব্যবসায়ীরা লাভবান হবেন। ট্যানারি মালিকদের সিন্ডিকেট বন্ধ করতে হবে। তাদের সিন্ডিকেটের কারণে প্রান্তিক ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হন। এবার শম্ভুগঞ্জ হাট থেকে ট্যানারি মালিকরা দুই লক্ষাধিক চামড়া সংগ্রহ করতে পারবেন বলে আশা করছি।
সরকার নির্ধারিত দামে চামড়া বিক্রি হলে কোনো ব্যবসায়ী ক্ষতিগ্রস্ত হবে না উল্লেখ করে শম্ভুগঞ্জ চামড়া বাজারের ইজারাদার শাহীনুর রহমান শাহীন জাগো নিউজকে বলেন, সরকার যে দামটি বেঁধে দিয়েছেন, সেই মূল্য দিয়েই ট্যানারি মালিকরা কিনলে প্রান্তিক পর্যায়ে চামড়া ব্যবসায়ীরা লাভবান হবেন। ট্যানারি মালিকদের সিন্ডিকেট বন্ধ করতে হবে। তাদের সিন্ডিকেটের কারণে প্রান্তিক ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হন। এবার শম্ভুগঞ্জ হাট থেকে ট্যানারি মালিকরা দুই লক্ষাধিক চামড়া সংগ্রহ করতে পারবেন বলে আশা করছি।
দেশের চামড়াশিল্প খুবই সম্ভাবনাময় উল্লেখ করে ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসক মুফিদুল আলম বলেন, কোনো সিন্ডিকেটের কবলে পড়ে ব্যবসায়ীরা যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হন, সে জন্য নিয়মিত তদারকির ব্যবস্থা করা হবে।
এসএইচএস/এমএস