দেশে পরিবহন খাতে নিয়োজিত শ্রমিকদের নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা নেই। তারা দিনে গড়ে ১৪-১৫ ঘণ্টা কাজ করেন। যান্ত্রিক গাড়ি যেমন কোনো বিশ্রাম পায় না, তেমন শ্রমিকদেরও পর্যাপ্ত বিশ্রামের সুযোগ নেই। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে তাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর। ঘটছে দুর্ঘটনা।
Advertisement
পরিবহন খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কর্মঘণ্টাসহ শ্রমিকদের অধিকারগুলো না মানায় অবসাদগ্রস্ত থাকেন যানবাহনের চালকরা। অথচ বিধি মোতাবেক পরিবহন মালিকপক্ষ তাদের নিয়োগপত্র দেওয়ার কথা। তা না করে চুক্তিতে বাস চালান চালক। এ কারণে প্রতিযোগিতাপূর্ণ গাড়ি চালান তারা। এতে সড়কে দুর্ঘটনাও বেশি ঘটছে। এককভাবে পরিবহন শ্রমিকরাই সবচেয়ে বেশি আহত ও নিহত হচ্ছেন।
শ্রমিকদের অতিরিক্ত কাজের প্রভাবে জীবন ঝুঁকিতে পড়ছে। এখন তাদের কর্মঘণ্টা নেই। কাজ না করলে বা ছুটিতে থাকলে আয় বন্ধ থাকে। এসব বিষয় নিয়ে বিকারগ্রস্ত থাকেন তারা। ফলে প্রতিদিনই অসংখ্য দুর্ঘটনা ঘটে।- যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) এক জরিপে দেখা গেছে, দেশে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় মৃত্যু গত এক দশকে ক্রমাগত বেড়েছে। এর মধ্যে বরাবর সবচেয়ে বেশি শ্রমিকের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে পরিবহন খাতে। ২০২৪ সালে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় ৭৩৬ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়। খাত অনুযায়ী সবচেয়ে বেশি ২৯২ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয় পরিবহন খাতে। যদিও আরেক জরিপে দেখা যায়, চলতি বছর তথা গত মার্চে সারাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ১২১ জন পরিবহন চালক মারা গেছেন।
Advertisement
পরিবহন খাতের শ্রমিকদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অভাব, প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা ও চাকরির নিশ্চয়তা না থাকা এই পেশাকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী।
তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘২০১১ সালে পরিবহন খাত শিল্প হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিল সরকার। কিন্তু আজ পর্যন্ত এ ঘোষণার বাস্তবায়ন হয়নি। পরিবহন খাত শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলে সড়কে দুর্ঘটনা ক্রমেই কমতো। শ্রমিকদের অতিরিক্ত কাজের প্রভাবে জীবন ঝুঁকিতে পড়ছে। এখন তাদের কর্মঘণ্টা নেই। কাজ না করলে বা ছুটিতে থাকলে আয় বন্ধ থাকে। এসব বিষয় নিয়ে বিকারগ্রস্ত থাকেন তারা। ফলে প্রতিদিনই অসংখ্য দুর্ঘটনা ঘটে।’
পরিবহন সেক্টরে কর্মঘণ্টা না থাকায় ঘটছে দুর্ঘটনাদেশে শ্রমিক অধিকার নিয়ে কাজ করে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিলস) নামে একটি সংগঠন। সোমবার (২৮ এপ্রিল) প্রকাশিত বিলসের এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, ২০২৪ সালে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় ৭৩৬ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়। খাত অনুযায়ী সবচেয়ে বেশি ২৯২ জন মৃত্যু পরিবহন শ্রমিকের। এভাবে ২০১৫ থেকে ২০২৫ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আট হাজার ৫১১ জন শ্রমিক কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনার শিকার হয়ে নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মারা গেছেন পরিবহন খাতের শ্রমিক।
আরও পড়ুনপুলিশ কাগজ দেখতে চাওয়ায় পরিবহন শ্রমিকদের সড়ক অবরোধএবার মহাখালীতে পরিবহন শ্রমিকদের সড়ক অবরোধ, তীব্র যানজটচাঁদামুক্ত সড়ক পরিবহন ব্যবস্থার দাবি শ্রমিক ফেডারেশনেরবিলসের আরেক গবেষণায় বলা হয়েছে, বেশির ভাগ চালক প্রতিদিন গড়ে ১৫ ঘণ্টা বা তার বেশি গাড়ি চালান। এই খাতের ৯০ শতাংশ শ্রমিকের সাপ্তাহিক ছুটি নেই। পাশাপাশি শ্রমিক হিসেবে অন্য সুযোগ-সুবিধা থেকেও তারা বঞ্চিত।
Advertisement
তীব্র যানজট ও গরমে বাসের ভেতর দম বন্ধ হয়ে আসে। এভাবে সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত গাড়িতে থাকতে হয়। দিনে মজুরি হিসেবে ৮০০ টাকা পাই।– চালক মফিজুল
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, পরিবহন খাতে নিয়োজিত শ্রমিকদের নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা না থাকা এবং পর্যাপ্ত বিশ্রামের সুযোগ না থাকার প্রভাব পড়ছে তাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর। চালকরা অবসাদগ্রস্ত অবস্থায় যানবাহন চালানোয় দুর্ঘটনা বেশি ঘটছে।
ঢাকার সায়েদাবাদ থেকে কক্সবাজারের দূরত্ব প্রায় ৩৯৭ কিলোমিটার। যাত্রাবিরতি ছাড়া এই পথে যাতায়াতে সময় লাগে প্রায় ১০ ঘণ্টা। এ দূরত্বে নিয়মিত যাত্রী পরিবহন করে সিডিএম ট্রাভেলস। রোববার (২৫ এপ্রিল) রাত ১০টায় কক্সবাজার থেকে যাত্রী নিয়ে ঢাকার সায়েদাবাদের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন চালক রাসেল মিয়া। সারা রাত বাস চালিয়ে তিনি ঢাকা পৌঁছান সোমবার (২৬ এপ্রিল) দুপুর ১২টায়। এই দীর্ঘ পথে তিনি একাই বাস চালিয়েছেন। পরে সায়েদাবাদের পাশে একটা বোর্ডিংয়ে ৬ ঘণ্টা রেস্ট নিয়ে রাত ১০টায় একই বাসে যাত্রী নিয়ে কক্সবাজার রওয়ানা দেন তিনি।
আলাপকালে রাসেল মিয়া বলেন, ‘এই দীর্ঘ যাত্রাপথে তার সঙ্গে দুজন সহকারী ছিলেন। এর মধ্যে একজন বাসের গেটে দাঁড়িয়ে যাত্রী তোলেন। আরেকজন যাত্রীদের কাছ থেকে ভাড়া আদায় করেন।’
তিনি জানান, সিডিএম বাসে তারা চুক্তিতে কাজ করেন। বাসের চাকা ঘুরলে তারা টাকা পান, অন্যথায় না খেয়ে থাকতে হয়। এজন্য অনেকটা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যাত্রী পরিবহন করি। বিশ্রামের সুযোগ খুব বেশি সময় থাকে না। শরীরের ওপর দিয়ে খুব ধকল যায়। একসময় শরীরে না মানলেও জোর করেই চালাতে হয়। বিশেষ করে একই দিনে দ্বিতীয় ট্রিপের সময় খারাপ বেশি লাগে।
মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে ময়মনসিংহ শহরের দূরত্ব প্রায় ১২০ কিলোমিটার। রুটে সবচেয়ে বেশি যাত্রী পরিবহন করে ইউনাইটেড পরিবহন। এ পরিবহনের একজন চালক দিনে গড়ে তিনবার মহাখালী থেকে ময়মনসিংহে যাত্রী পরিবহন করতে পারেন। এজন্য চালককে তার নিজ আসনে অন্তত ১৪ ঘণ্টা বসে থাকতে হয়।
তাদের নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা, বেতন-বোনাসও দেওয়া হয়। কিন্তু সে অনুযায়ী শহর বা শহরতলিতে চলাচল করা গণপরিবহনে তা দেখা যায় না, এটি সত্যি। তবে এটিকে আমরা নিয়মের মধ্যে নিয়ে আসার চেষ্টা করছি। শ্রমিকদের জন্য আর্থিক তহবিল ব্যবস্থা তৈরিসহ কোম্পানির সব সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা হবে।- বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব সাইফুল আলম
ইউনাইটেড পরিবহনের চালক মহসিন বলেন, ‘সকাল ৬টায় মহাখালী বা ময়মনসিংহ থেকে ফার্স্ট ট্রিপ শুরু করি। রাত ১২টায় লাস্ট ট্রিপ। এই দীর্ঘ সময় চালকের আসন আগুনের মতো গরম থাকে। স্টিয়ারিং ধরে বসে থাকতে থাকতে একসময় শরীর চলতে চায় না। সারা দিন চিল্লাচিল্লি, হর্নের আওয়াজে খুব কষ্ট হয়।’
ঢাকার মিরপুর-১৪ নম্বর থেকে সদরঘাটে যাত্রী পরিবহন করে বিহঙ্গ পরিবহন। এই পরিবহনের চালকের সহকারী মফিজুল ইসলাম। সম্প্রতি কারওয়ান বাজার সিগন্যালে আলাপকালে মফিজুল বলেন, ‘তীব্র যানজট ও গরমে বাসের ভেতর দম বন্ধ হয়ে আসে। এভাবে সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত গাড়িতে থাকতে হয়। দিনে মজুরি হিসেবে ৮০০ টাকা পাই।’
বাংলাদেশ শ্রম আইন-২০০৬ অনুযায়ী, প্রাপ্তবয়স্ক শ্রমিক দৈনিক আট ঘণ্টার বেশি সময় কাজ করতে পারবেন না বা তাকে দিয়ে কাজ করানো যাবে না। ক্ষেত্রবিশেষে ১০ ঘণ্টা পর্যন্ত শ্রমিক কাজ করতে পারবেন। কিন্তু বাস্তবে পরিবহনশ্রমিকদের ক্ষেত্রে এই কর্মঘণ্টার হিসাব মানা হচ্ছে না।
বিলসের হিসাবে দূরপাল্লার গণপরিবহনে প্রায় এক লাখ ৮৪ হাজার শ্রমিক কাজ করেন। এই শ্রমিকদের সবাইকে দৈনিক আট ঘণ্টার বেশি কাজ করতে হয়। তাদের প্রায় ৫০ শতাংশ দৈনিক ১৫ ঘণ্টার বেশি কাজ করেন। ২০ শতাংশ শ্রমিক কোনো ধরনের নিয়মিত কর্মবিরতি ছাড়াই কাজ করেন। মালিকরা চাইলে যে কোনো সময় কাজ থেকে বাদ দিতে পারেন। অসুস্থ হলে কিংবা ছুটি নিলে ওই দিনে কোনো আয় থাকে না।
গত ২২ এপ্রিল বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহম্মদের নেতৃত্বাধীন শ্রম সংস্কার কমিশন চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেন। ‘শ্রম জগতের রূপান্তর-রূপরেখা: শ্রমিক অধিকার, সু-সমন্বিত শিল্প সম্পর্ক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে সব শ্রমিকের আইনি সুরক্ষা ও স্বীকৃতি নিশ্চিত করার সুপারিশ করেছে কমিশন। এছাড়া প্রাতিষ্ঠানিক-অপ্রাতিষ্ঠানিক সব ক্ষেত্রে প্রত্যেক শ্রমিককে নিয়োগপত্র, পরিচয়পত্র দেওয়া বাধ্যতামূলক এবং জাতীয় পেনশন স্কিমের অধীনে শ্রমিকবান্ধব পেনশন স্কিম চালু করার সুপারিশ করা হয়েছে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব সাইফুল আলম জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের প্রতিটি দূরপাল্লার রুটে চলাচল করা বাস কোম্পানিতে নিয়োগপত্র দেওয়া হয়। তাদের নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা, বেতন-বোনাসও দেওয়া হয়। কিন্তু সে অনুযায়ী শহর বা শহরতলিতে চলাচল করা গণপরিবহনে তা দেখা যায় না, এটি সত্যি। তবে এটিকে আমরা নিয়মের মধ্যে নিয়ে আসার চেষ্টা করছি। শ্রমিকদের জন্য আর্থিক তহবিল ব্যবস্থা তৈরিসহ কোম্পানির সব সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা হবে।’
এমএমএ/এএসএ /এমএফএ/জেআইএম