দেশজুড়ে

জাহিদের ‘নজরবন্দি’ মানিকগঞ্জ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল

জাহিদের ‘নজরবন্দি’ মানিকগঞ্জ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল

ক্ষমতায় থাকাকালীন দলীয় নেতাকর্মী ও নিজের আত্মীয়-স্বজনদের চাকরি দিয়ে সুকৌশলে মানিকগঞ্জ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল এখনো নিজের দখলেই রেখেছেন সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক স্বপন। পছন্দের ঠিকাদারকে দিয়ে আউটসোর্সিং জনবল নিয়োগ করে দলীয় নেতাকর্মী ও আত্মীয়-স্বজনদের বহাল রেখেছেন তিনি।

Advertisement

শুধু তাই নয়, মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের বড় কর্তাদের দিয়ে নিজের কাছের লোকজন বহাল রেখে এখনো নানান ধরনের চক্রান্তে লিপ্ত সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী। এতে এতো বড় স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের সুফল পাচ্ছেন না মানিকগঞ্জের মানুষ।

অনুসন্ধানে জানা যায়, তৎকালীন সময়ে মন্ত্রীর সবচেয়ে আস্থাভাজন ছিলেন মানিকগঞ্জ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের সাবেক প্রজেক্ট ডিরেক্টর (পিডি) খান মো. আরিফ। যিনি এই প্রতিষ্ঠানের সবচেয়ে বড় ৭টি প্রজেক্টের ডিরেক্টরের দ্বায়িত্ব পালন করেছেন। ওই সময় প্রজেক্ট শেষ হওয়ার পর মন্ত্রণালয়ে বদলি হয়ে গেলেও এখন আবারো তিনি মানিকগঞ্জ মেডিকেল কলেজে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন।

এদিকে গাজীপুর জেলার বাসিন্দা আওয়ামী লীগ নেতা আমজাদ হোসেন পলাশ ছিলেন সাবেক যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মো. জাহিদ আহসান রাসেলের পারিবারিক সদস্য। সেই সূত্র ধরেই সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের ঘনিষ্ঠ হওয়ার পরই মানিকগঞ্জ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ২০২১ সালে আউটসোর্সিংয়ে ১২০ জন জনবল নিয়োগের টেন্ডার পায় মেসার্স মিয়া এন্টারপ্রাইজ। ওই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মালিক পলাশ। সেই পলাশকে টেন্ডার দিয়ে নিজের আত্মীয়-স্বজন ও দলীয় নেতাকর্মীদের নিয়োগ করেছেন সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী। নিজের লোকজনকে ওই হাসপাতালে বহাল রাখতে টেন্ডারের সময় ফুরিয়ে যাওয়ার পরও ২০২১-২০২২ ও ২০২২-২০২৩ অর্থ বছরে পরপর দুইবার সময় বাড়িয়ে দেওয়া হয়। এরপর আবার নতুন টেন্ডার হয় ২০২৩-২০২৪ অর্থ বছরে। সেই বছরও সাবেক পরিচালক আশ্বাদ উল্লাহর মাধ্যমে আরও ৪০ জন বাড়িয়ে ১৬০ জনবলের টেন্ডার সুকৌশলে পলাশের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকেই দেওয়া হয়। বর্তমান পরিচালক ডা. শফিকুল আলমের সহায়তায় নতুন করে সময় বাড়িয়ে এখনও সেই অদক্ষ জনবল দিয়েই চালানো হচ্ছে কার্যক্রম।

Advertisement

অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কাজের লোক চান্দু মিয়ার মেয়ে রিমা আক্তারকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল আয়া পদে, তবে তিনি এখন আল্ট্রাসনোগ্রাম ল্যাবের অ্যাটেনডেন্ট হিসেবে কাজ করছেন। এছাড়া চান্দু মিয়ার ভাতিজা মনির হোসেন নিয়োগ পান জমাদার সরদার হিসেবে, মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ আত্মীয় মো. সিজান নিয়োগ পান সহকারী বাবুর্চী পদে, স্বপনের ফুপাতো ভাইয়ের লোক তারিকুল ইসলাম নিয়োগ পান লিফটম্যান অপারেটর পদে, স্বপনের ফুপাতো ভাই সদর উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান ইসরাফিলের আত্মীয় ইয়াসমিন আক্তার নিয়োগ পান আয়া পদে, স্বপনের প্রতিবেশী শামীম খান নিয়োগ পান ওয়ার্ড মাস্টার পদে, মন্ত্রীর প্রতিবেশী মীর আব্দুস সালাম কিচেন সুপারভাইজার, ছাত্রলীগ নেতা মো. সুজন মিয়া ওয়ার্ড মাস্টার, কৃষ্ণপুর ইউনিয়ন শ্রমিক লীগের সভাপতি মোহাম্মদ সানোয়ার হোসেন পরিচ্ছন্নতাকর্মী, সদর উপজেলা শ্রমিক লীগের আহ্বায়ক টাইগার লিটনের আপন ছোট ভাই মো. মামুন খান সহকারী বাবুর্চি, মানিকগঞ্জ-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও কণ্ঠশিল্পী মমতাজ বেগমের কর্মী রুপালী আক্তার রেন্ট কালেক্টর, ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী শাহিনুর ইসলাম ওয়ার্ড বয়, হরগজ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদকের ছেলে মো. রাজিব মিয়া পরিচ্ছন্নতাকর্মী, সাবেক মন্ত্রীর নিজ ইউনিয়ন গড়পাড়া ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আফসার সরকারের লোক পারভীন আক্তার আয়া, পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহিদের নাতি তুজান্নাহার তুলি ইটিটি টেকনিশিয়ান, সাবেক পরিচালক আশ্বাদ উল্লাহর ভায়রার ছেলে সানজিদুল ইসলাম সার্ভার রক্ষণাবেক্ষণ টেকনিক্যাল পার্সন হিসেবে নিয়োগ পান।

এছাড়া ২০২১ সালে মেডিকেল কলেজ শাখায় আউটসোর্সিংয়ে নিয়োগ হয় ৬১ জনের। এর মধ্যে রয়েছে মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার মহিলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আছমা আক্তার, দিঘি ইউনিয়নের যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক সমচান ও কৃষ্ণপুর ইউনিয়নের ছাত্রলীগের সভাপতি শাহাজাদা পারভেজসহ একাধিক দলীয় নেতাকর্মী।

মানিকগঞ্জ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের একাধিক আউটসোর্সিং কর্মচারীর ভাষ্য, ‘তখন আমরা বিভিন্ন নেতাদের মাধ্যমেই নিয়োগ পেয়েছি। বেশিরভাগ নিয়োগ হয়েছে মন্ত্রীর ফুপাতো ভাই ইসরাফিল, শামীম ও গড়পাড়া ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আফসার সরকারের মাধ্যমে। আর এরাই মন্ত্রীর সবচেয়ে কাছের ছিলেন।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সরকারি এক বাবুর্চি বলেন, ‘আমরা সবাই নেতাদের ধরে এই হাসপাতালে চাকরি নিয়েছি। তাদের সুবিধা দিয়েই আসতে হয়েছে। এখানে আমার মতো অনেক গরিব মানুষ চাকরি করে। চাকরি গেলে অনেক সমস্যায় পড়তে হবে।’

Advertisement

ওয়ার্ড মাস্টার সুজন মিয়া বলেন, ‘ছাত্রজীবনে এক-দুইবার ছাত্রলীগের নেতাদের সঙ্গে গিয়েছি। চাকরি হওয়ার পর আর কোনো দলের সঙ্গে নেই।’

মেসার্স মিয়া এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী আমজাদ হোসেন পলাশ আত্মগোপনে থাকায় তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।

মানিকগঞ্জ মেডিকেল কলেজের সহযোগী অধ্যাপক খান মো. আরিফ বলেন, ২০২০ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত মানিকগঞ্জ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের পিডি হিসেবে ছিলাম। আবার ২০২৪ সালের জানুয়ারির ২০ তারিখ থেকে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে এখানে কর্মরত আছি।

এ বিষয়ে মানিকগঞ্জ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের পরিচালক ডা. শফিকুল আলম জাগো নিউজকে বলেন, আউটসোর্সিংয়ের নিয়োগ আর টেন্ডারের বিষয়ে আমার কিছু জানা নেই। আমি মানিকগঞ্জ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আসার পর আউটসোর্সিংয়ের কোনো টেন্ডার হয়নি।

এফএ/এএসএম