দেশজুড়ে

এক গ্রামেই বেহাত সরকারের সাড়ে ৫১ বিঘা সম্পত্তি!

এক গ্রামেই বেহাত সরকারের সাড়ে ৫১ বিঘা সম্পত্তি!

সাড়ে ৫১ বিঘা সম্পত্তি সরকারের কিন্তু দখলে আছেন স্থানীয় প্রভাবশালীরা। এসব সম্পত্তির ছোট-বড় অন্তত ৯টি পুকুর প্রতিবছর সাড়ে ৯ লাখ টাকায় ইজারাও দেন তারা। আরেকটি অংশে ৩২টি পাকা ও সেমিপাকা দোকান নির্মাণ করে গড়ে তুলেছেন ‌‘রাহুলিয়া বাজার’। এতে সরকারের প্রায় ৪০ কোটি টাকা মূল্যের সাড়ে ৫১ বিঘা সম্পত্তি বেহাত হয়ে গেছে। ফলে প্রতিবছর কয়েক লাখ টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার।

Advertisement

ঘটনাটি সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলার বড়পাঙ্গাসী ইউনিয়নের রাহুলিয়া গ্রামের। অভিযুক্ত প্রভাবশালী ও দখলদাররা হলেন-১ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সদস্য ও গ্রাম্যপ্রধান শওকত আলী প্রামাণিক, অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্য আব্দুস সামাদ সরকার, বাহাদুর সরকার, বিএনপি সমর্থক লিয়াকত আলী ও আলেম উদ্দিন, জামায়াত সমর্থক আসমত সেখ, সাবেক ইউপি সদস্য শাহজাহান ও করিম মোল্লাসহ আরও ১৫-২০ জন।

ইউনিয়ন ভূমি অফিস ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, রাহুলিয়া গ্রামে প্রায় দেড় হাজার লোকের বসবাস। এই মৌজার ২৩৬ নম্বর আরএস খতিয়ানের ২৪টি দাগে মোট সাড়ে ৫১ বিঘা (১৭ দশমিক ১৪ একর) ক-তফসিলভুক্ত অর্পিত সম্পত্তি রয়েছে। যা সরকারি হলেও স্থানীয় প্রভাবশালী একটি চক্র প্রায় ২০-২৫ বছর ধরে অবৈধভাবে নিজেদের কব্জায় রেখেছেন। এই সম্পত্তি থেকে চক্রটি এরইমধ্যে হাতিয়ে নিয়েছে ২-৩ কোটি টাকা। তবুও প্রশাসনের এই সম্পত্তি উদ্ধারের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে রাহুলিয়া গ্রামের একজন স্থায়ী বাসিন্দা জাগো নিউজকে জানান, প্রায় ২৫ বছর হলো গ্রামের প্রভাবশালী শওকত আলী প্রামাণিক, অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্য আব্দুস সামাদ সরকার ও বাহাদুর সরকারের নেতৃত্বে ৩৫ বিঘা আয়তনের ৯টি ছোট-বড় সরকারি পুকুর প্রতিবছর লিজ দেওয়া হচ্ছে। ৯ লাখ ৫৬ হাজার ৬৬৬ টাকায় লিজ দেন তারা। শুধু তাই নয়, শওকত আলী প্রামাণিক ২৩৬ নম্বর খতিয়ানের ৪১২ দাগের ৬ শতক পতিত ও ৪৯৭ দাগের ৩৩ শতক পুকুর এবং আব্দুস সামাদ সরকার ১ দশমিক ২২ একরের একটি পুকুর ভরাট করে নিজ দখলে নিয়েছেন।

Advertisement

ওই ব্যক্তি আরও জানান, একই খতিয়ানের ১৬২ নম্বর দাগের পতিত ১ দশমিক ৩ একর জায়গার দক্ষিণ অংশে তাদের নেতৃত্বেই অবৈধভাবে দখল করে ‘রাহুলিয়া বাজার’ গড়ে তোলা হয়েছে। সেখানে ৩০-৩৫টি দোকান রয়েছে। লাখ টাকায় এগুলো তারা হাত বদলও করেন। এছাড়া ছয়টি ফসলি দাগের প্রায় ১৫ বিঘা (৪ দশমিক ৯৬ একর) অর্পিত সম্পত্তি স্থানীয় আব্দুল রাজ্জাক ও শামছুল ইসলাম গংরা দখলে নিয়ে চাষাবাদ করছেন।

জানতে চাইলে অভিযুক্ত ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সদস্য শওকত আলী প্রামাণিক সরকারি সম্পত্তি দখল ও লিজ দেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেন। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, পুকুরগুলো একসময় পরিত্যক্ত হয়ে পড়েছিল। পরবর্তী সময়ে আমরা গ্রামবাসী পুকুরের পাড় বেঁধে মাছচাষ শুরু করি। এতে যে টাকা আয় হয়েছিল তা মসজিদ ও কবরস্থান উন্নয়নে কাজ করা হয়েছে। তবে সরকারি জায়গায় তার নিজস্ব কোনো দোকান নেই বলে তিনি জানান।

অভিযুক্ত একই গ্রামের কবরস্থান পরিচালনা কমিটির সভাপতি ও অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্য আব্দুস সামাদ সরকারের সম্পত্তি দখলের বিষয়টি এড়িয়ে জাগো নিউজকে বলেন, অল্প কিছু টাকার বিনিময়ে কবরস্থান ও মসজিদ কমিটির পক্ষ থেকে পুকুরগুলো লিজ দেওয়া হতো। এসব টাকা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানেই ব্যয় হয়েছে।

অর্পিত সম্পত্তির বিষয়ে স্থানীয় ইউপি সদস্য তুজাম্মেল হক বকুল জাগো নিউজেক বলেন, ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর প্রথমে শত্রু সম্পত্তি ও পরে অর্পিত সম্পত্তি বলে চিহ্নিত হয়েছে। সরকারের উচিত এসব সম্পত্তি দখলমুক্ত করে সঠিক কাজে লাগানো অথবা নিয়মিত ইজারা দেওয়া।

Advertisement

সিরাজগঞ্জ অতিরিক্ত চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের সহকারী সরকারি কৌঁসুলি (এপিপি) নাসির উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, অর্পিত সম্পত্তির প্রকৃত ইজারাদারও জমি হস্তান্তর বা বিক্রি করতে পারবেন না। এমনকি বন্ধক বা অন্য কাউকে ইজারাও দিতে পারবেন না। একইসঙ্গে জমিতে অবকাঠামো নির্মাণ, আগের অবকাঠামোর আকার পরিবর্তন বা মেরামত কিংবা সম্পত্তির শ্রেণি পরিবর্তন করার সুযোগ নেই। বরং জমিতে ‘অর্পিত সম্পত্তি’ মর্মে সাইনবোর্ড টাঙানো বাধ্যতামূলক।

হাওরা (বড়পাঙ্গাসী) ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা মোছা. সেতারা খাতুন জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি এখানে নতুন যোগদান করেছি। যে কারণে আমার ওই অর্পিত সম্পত্তির বিষয়টি জানা ছিল না। পরবর্তী সময়ে বিষয়টি জানার পর সরেজমিন ঘুরে তিনটি পুকুর ইজারা দেওয়ার জন্য ইউএনওকে একটি প্রতিবেদন দিয়েছি। বাকি সম্পত্তিগুলোর বিষয়ে খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) (অতিরিক্ত দায়িত্ব) আবু সালেহ্ মোহাম্মদ হাসনাত জাগো নিউজকে বলেন, বিষয়টি অবগত হওয়ার পর আমরা তিনটি পুকুরে লাল পতাকা টাঙিয়ে দখলমুক্ত করেছি। একইসঙ্গে ইজারা দিতে জেলা প্রশাসক বরাবর প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।

তবে বিগত সময়ে ওই পুকুরগুলো কেন ইজারা দেওয়া হয়নি, সেই প্রশ্নের সদুত্তর দেননি তিনি।

এম এ মালেক/এসআর/জেআইএম