জাতীয়

শ্রমিকদের কতটা কল্যাণ করছে শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন?

শ্রমিকদের কতটা কল্যাণ করছে শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন?

প্রতিষ্ঠার সাড়ে ১৮ বছর পেরিয়ে গেলে ধুঁকে ধুঁকে চলছে বাংলাদেশ শ্রমিক কল‌্যাণ ফাউন্ডেশন। প্রতিষ্ঠার পর থেকে পূর্ণকালীন মহাপরিচালকও পায়নি শ্রমিকদের কল‌্যাণে কাজ করা এ প্রতিষ্ঠানটি। প্রায় সবাই অতিরিক্ত দায়িত্বে বা অন‌্য কাজের সঙ্গে মহাপরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন। ১৮ বছর পর গত জানুয়ারি থেকে শ্রম ভবনে স্থায়ী ঠিকানা হয়েছে ফাউন্ডেশনের।

Advertisement

ফাউন্ডেশনের মাঠ পর্যায়ে কোনো অফিস এখনো হয়নি। একমাত্র কার্যালয়ে লোকবলের তিন ভাগের দুই ভাগ সবসময়ই খালি ছিল।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নানান সংকটে নিজেই জর্জরিত থাকায় শ্রমিকদের কল‌্যাণে কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা রাখতে পারছে না ফাউন্ডেশন। এছাড়া ফাউন্ডেশন থেকে সহায়তা পেতে আবেদনের জটিলতা, শ্রমিক নেতা ও সংশ্লিষ্ট এক শ্রেণির কর্মকর্তাদের অপতৎপরতায় বিঘ্নিত হচ্ছে শ্রমিক কল‌্যাণ।

আরও পড়ুন এক দশকে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় নিহত ৮২৯৮ শ্রমিক শ্রমিকদের আইনি সুরক্ষা ও স্থায়ী শ্রম কমিশন গঠনের সুপারিশ সংকটে শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন, ১৫ বছরেও হয়নি স্থায়ী অফিস

লাভে থাকা বেশিরভাগ কোম্পানি লভ্যাংশ দিচ্ছে না ফাউন্ডেশনের তহবিলে। যারা দিচ্ছে না তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়ারও উদ্যোগ নেই। অন‌্যদিকে তহবিলে যে অর্থ রয়েছে, শ্রমিকরা ধুঁকলেও তাদের কল‌্যাণে দক্ষতার সঙ্গে সেই অর্থও কাজে লাগাতে পারছে না ফাউন্ডেশন।

Advertisement

স্থায়ীভাবে অক্ষম বা মৃত্যু হলে তহবিল থেকে ২ লাখ টাকা, জরুরি চিকিৎসার জন্য সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা সহায়তা নিতে পারবেন। তবে দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হলে সর্বোচ্চ ১ লাখ টাকা সহায়তার বিধান রয়েছে।

ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ফাউন্ডেশনের সহায়তা পেতে আবেদন পদ্ধতি অনলাইন করা হচ্ছে। তখন আবেদনের জটিলতা কেটে যাবে। আর কাজের পরিধি অনুযায়ী, জনবল বাড়ানোর বিষয়টি বিবেচনাধীন। এছাড়া লাভ করেও যে প্রতিষ্ঠানগুলো ফাউন্ডেশনের তহবিলে লভ‌্যাংশ দিচ্ছে না আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা করে তাদের বিরুদ্ধে ব‌্যবস্থা নেওয়া হবে।

২০০৬ সালে ‘বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন আইন, ২০০৬’ প্রণয়ন করে সরকার। ওই বছরের ১ অক্টোবর থেকে আইনটি কার্যকর ঘোষণা করা হয়। ২০১৩ সালে আইনে সংশোধন আনা হয়। ২০১০ সালে আইনটির বিধিমালা করা হয়। ২০১৫ সালে সংশোধিত হয় এই বিধিমালা। দেশের প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত শ্রমিক ও তাদের পরিবারের কল্যাণে এই আইনের অধীনে বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠিত হয়।

ফাউন্ডেশনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠার পর এ পর্যন্ত ৩০ হাজার ২৮৫ জনকে ১৪১ কোটি ৬৬ লাখ টাকা সহায়তা দিয়েছে শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন। এ পর্যন্ত শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন তহবিলে ৫১৮টি কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠান লভ্যাংশ জমা দিয়েছে। এখন তহবিলে জমার পরিমাণ এক হাজার ৫৮ কোটি টাকা।

Advertisement

সহায়তা পাওয়ার প্রক্রিয়ায় যত সমস্যা

ফাউন্ডেশনের সহায়তা পেতে আবেদনটি জটিল বলে জানিয়েছেন শ্রমিক নেতারা। এতগুলো ধাপ পেরিয়ে আবেদন করতে হয় বলে অনেকেই আগ্রহী হন না।

শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন বিধিমালায় বলা হয়েছে, প্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মরত শ্রমিককে আর্থিক অনুদান পাওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট নিয়োগকারী ও সংশ্লিষ্ট শ্রমিক সংগঠনের বা সংগঠনভুক্ত না হলে সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বা পৌরসভা বা সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার সুপারিশসহ আবেদন করতে হবে।

অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মরত শ্রমিককে সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বা পৌরসভা বা সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এবং শ্রম অধিদপ্তর বা কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট এলাকার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সুপারিশসহ আবেদন করতে হবে।

আরও পড়ুন প্রফিট বোনাস পরিশোধের দাবিতে এনইপিসি শ্রমিকদের মানববন্ধন শ্রমিক কল্যাণ তহবিলে লভ্যাংশ দিচ্ছে না বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান গৃহকর্মী-যৌনকর্মীদের শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতির সুপারিশ

এভাবে আবেদনের ক্ষেত্রে শ্রমিকরা হয়রানির মধ্যে পড়েন। বিভিন্ন ক্ষেত্রে সুপারিশ নিতে টাকা-পয়সাও দিতে হয় বলেও অভিযোগ করেন শ্রমিক নেতারা।

অভিযোগ আছে, বিগত সময়ে শ্রমিক নেতারা টাকার বিনিময়ে সহায়তা পাইয়ে দিয়েছেন। এছাড়া শ্রম মন্ত্রণালয় ও শ্রম অধিদপ্তরের এক শ্রেণির অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী নানান অপকৌশলে সহায়তা বাগিয়ে নিয়েছেন।

শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন আইন অনুযায়ী, কোনো শ্রমিক দুর্ঘটনাজনিত কারণে দৈহিক ও মানসিকভাবে স্থায়ী অক্ষম হলে, দুর্ঘটনাজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করলে, মরদেহের পরিবহন ও সৎকার, দুরারোগ্য চিকিৎসার জন্য আর্থিক সহায়তা, অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মরত মহিলা শ্রমিকের মাতৃত্ব কল্যাণ, শ্রমিক পরিবারের মেধাবী সদস‌্যের জন‌্য শিক্ষা বৃত্তি, বিশেষ দক্ষতার স্বীকৃতিস্বরূপ আর্থিক প্রণোদনা, শ্রমিকদের জীবন বিমার জন্য যৌথ বিমা ব্যবস্থার প্রবর্তন করাসহ বিভিন্ন ধরনের আর্থিক অনুদান ফাউন্ডেশনের তহবিল থেকে দেওয়া হয়।

‘শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন (সংশোধিত) বিধিমালা ২০১৫’ অনুযায়ী অসচ্ছল শ্রমিকদের সন্তানদের সাধারণ শিক্ষার জন্য ২৫ হাজার টাকা এবং উচ্চশিক্ষার জন্য সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারি মেডিকেল কলেজ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের প্রত্যয়ন সাপেক্ষে টিউশন ফি ও শিক্ষা উপকরণের জন্য সর্বোচ্চ তিন লাখ টাকা সহায়তা দেওয়া যায়।

স্থায়ীভাবে অক্ষম বা মৃত্যু হলে তহবিল থেকে ২ লাখ টাকা, জরুরি চিকিৎসার জন্য সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা সহায়তা নিতে পারবেন। তবে দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হলে সর্বোচ্চ ১ লাখ টাকা সহায়তার বিধান রয়েছে।

অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মরত নারী শ্রমিকদের মাতৃত্ব কল্যাণে তহবিল থেকে ২৫ হাজার টাকা সহায়তা দেওয়া যাবে। বিশেষ দক্ষতা দেখানো শ্রমিকদের ২৫ হাজার টাকা সহায়তা দিতে পারে ফাউন্ডেশন।

এ পর্যন্ত ৩০ হাজার ২৮৫ জন শ্রমিক ও তাদের পরিবার সহায়তা পেয়েছেন। দেশে দুর্দশায় থাকা শ্রমিকদের তুলনায় এ সংখ্যা নগণ্য। টাকার সংকট রয়েছে এমনও নয়, এখনো ফাউন্ডেশনের তহবিলে এক হাজার কোটি টাকার বেশি অর্থ রয়েছে। দক্ষতার সঙ্গে ফাউন্ডেশন কাজ করতে পারছে না বলে মনে করেন শ্রমিকরা।

সহায়তা পেয়েছেন মাত্র ৩০২৮৫ শ্রমিক

তহবিলে জমা টাকা অনুযায়ী শ্রমিকদের সহায়তার পরিমাণ খুবই কম বলে মনে করেন শ্রমিক নেতারা। তারা বলছেন, এই অর্থ দিয়ে শ্রমিকদের কল্যাণে নানামুখী পদক্ষেপ নেওয়া যেত, কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি তার দক্ষতা দেখাতে পারেনি। আইনে শ্রমিকদের কল্যাণে প্রকল্প নেওয়ার কথা থাকলেও ফাউন্ডেশনের এমন কোনো উদ্যোগ নেই।

ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তহবিলের পুরো টাকাই ব্যাংকে স্থায়ী আমানত হিসেবে রাখা আছে। এর মুনাফা দিয়ে মূলত শ্রমিকদের সহায়তা করা হচ্ছে।

আরও পড়ুন বিরূপ সময়ে সহায়তা কম, কখন ‘শ্রমিক কল্যাণ’ করবে ফাউন্ডেশন? দৈনিক ভিত্তিতে শ্রমিক নিয়োগ দেবে সরকার শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনে লভ্যাংশ দিতে চায় না বিমা কোম্পানি

এ পর্যন্ত ৩০ হাজার ২৮৫ জন শ্রমিক ও তাদের পরিবার সহায়তা পেয়েছেন। দেশে দুর্দশায় থাকা শ্রমিকদের তুলনায় এ সংখ্যা নগণ্য। টাকার সংকট রয়েছে এমনও নয়, এখনো ফাউন্ডেশনের তহবিলে এক হাজার কোটি টাকার বেশি অর্থ রয়েছে। দক্ষতার সঙ্গে ফাউন্ডেশন কাজ করতে পারছে না বলে মনে করেন শ্রমিকরা।

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর প্রশাসনেও ব্যাপক পরিবর্তন আসে। এতে ফাউন্ডেশনের কাজে স্থবিরতা নামে। বিপুল সংখ্যক আবেদন জমা হয়। প্রায় চার হাজারের মতো আবেদন জমা হয় বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

ফাউন্ডেশনের পরিচালনা বোর্ডের অনুমোদন ছাড়া শ্রমিকদের কোনো সহায়তা দেওয়া যায় না। গত বছরের ২৮ নভেম্বর আগের বোর্ড বাতিল করে আইন অনুযায়ী নতুন বোর্ড গঠন করা হয়। বোর্ডের চেয়ারম্যান শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা। জমা হওয়া আবেদনগুলো যাচাই-বাছাইয়ের কাজ চলছে বলে ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

২০০৭ সালের ৩১ জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত ১২ জন কর্মকর্তা ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক (ডিজি) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদার প্রায় সব কর্মকর্তাই ছিলেন অস্থায়ী ভিত্তিতে। পূর্ণকালীন ডিজি পায়নি ফাউন্ডেশন। ভালো বসার জায়গা, গাড়ি সুবিধা না থাকায় কেউ এখানে আসতে চাইতেন না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

নানান সংকটে ফাউন্ডেশন

প্রতিষ্ঠার পর দীর্ঘদিন কোনো স্থায়ী অফিস পায়নি ফাউন্ডেশন। ২০১৭ সালের মাঝামাঝি সচিবালয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ভবনের পেছনে টিনশেডে বসতেন ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। টিনশেড ভেঙে নতুন ভবন নির্মাণ শুরু হলে সচিবালয়ের ৬ নম্বর ভবনের ২১ তলার একটি অংশে স্থান হয় ফাউন্ডেশনের। স্বল্প জায়গায় গাদাগাদি করে বসতে হতো কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। সেই অবস্থা থেকে গত জানুয়ারি মুক্তি মিলেছে ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের।

২০০৭ সালের ৩১ জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত ১২ জন কর্মকর্তা ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক (ডিজি) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদার প্রায় সব কর্মকর্তাই ছিলেন অস্থায়ী ভিত্তিতে। পূর্ণকালীন ডিজি পায়নি ফাউন্ডেশন। ভালো বসার জায়গা, গাড়ি সুবিধা না থাকায় কেউ এখানে আসতে চাইতেন না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

ফাউন্ডেশনের বর্তমান মহাপরিচালক মো. মুনির হোসেন খান শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব। তিনি একই সঙ্গে কেন্দ্রীয় তহবিল ও বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালকের দায়িত্বে রয়েছেন।

সারাদেশের শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করলেও ফাউন্ডেশনের অনুমোদিত জনবল মাত্র ১৮ জন। এরমধ্যে রয়েছেন ১২ জন। এছাড়া ফাউন্ডেশনের কোনো গাড়ি নেই। সারাদেশে ফাউন্ডেশনের আর কোনো কার্যালয় হয়নি, এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগও নেই।

শিল্পপ্রতিষ্ঠানের এক বছরের লভ্যাংশের শূন্য দশমিক পাঁচ (আধা) শতাংশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনের তহবিলে বাধ্যতামূলকভাবে দিতে হবে। এক বছরের লভ্যাংশের পাঁচ শতাংশের মধ্যে চার শতাংশ অর্থ নিজ কোম্পানির শ্রমিকদের কল্যাণে ব্যয় করতে হয়।

বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান লভ্যাংশ দিচ্ছে না

আইন অনুযায়ী, শিল্পপ্রতিষ্ঠানের এক বছরের লভ্যাংশের শূন্য দশমিক পাঁচ (আধা) শতাংশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনের তহবিলে বাধ্যতামূলকভাবে দিতে হবে। এক বছরের লভ্যাংশের পাঁচ শতাংশের মধ্যে চার শতাংশ অর্থ নিজ কোম্পানির শ্রমিকদের কল্যাণে ব্যয় করতে হয়। এক শতাংশের অর্ধেক প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব শ্রমিক কল্যাণ তহবিলে, বাকি অর্ধেক (শূন্য দশমিক পাঁচ শতাংশ) শ্রম মন্ত্রণালয়ের অধীন শ্রমিক কল্যাণে ফাউন্ডেশনের তহবিলে জমা দিতে হয়। তবে পোশাক কারখানাগুলোকে এ তহবিলের বাইরে রাখা হয়েছে। শ্রম আইনের অধীনে করা বিধিমালায় পোশাক কারখানাগুলোর জন্য আলাদা বিধান রাখা হয়েছে।

আরও পড়ুন ফরিদপুরে মিক্সার প্লান্টে বিস্ফোরণ, দুই শ্রমিক দগ্ধ শ্রমিক কল্যাণ তহবিলে তালিকাভুক্ত না হলে সরকারি দরপত্রে অংশ নয় শ্রমিকদের কল্যাণে ভবিষ্যৎ তহবিল

শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন আইন অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানের লভ্যাংশ ঘোষণার ৯০ দিনের মধ্যে নির্ধারিত লভ্যাংশ দিতে হয়। কোনো কোম্পানির অংশগ্রহণ তহবিল ও কল্যাণ তহবিল পরিচালনায় গঠিত ট্রাস্টি বোর্ড এ সময়ের মধ্যে লভ্যাংশ জমা দিতে ব্যর্থ হলে তার বিরুদ্ধে এক লাখ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। ট্রাস্টি বোর্ড যদি অব্যাহতভাবে ব্যর্থ হতে থাকে, তবে ব্যর্থতার প্রথম তারিখ থেকে প্রত্যেক দিনের জন্য আরেও পাঁচ হাজার টাকা করে জরিমানা দিতে হবে।

ফাউন্ডেশন সূত্রে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত মাত্র ৫১৮টি প্রতিষ্ঠান ফাউন্ডেশনের তহবিলে লভ্যাংশ জমা দিয়েছে। কিন্তু দেশে হাজার হাজার প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যারা নিয়মিত লাভ করছে। আইন অনুযায়ী তাদের তহবিলে লভ্যাংশ দেওয়ার কথা। তারা আইন না মানলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না ফাউন্ডেশন।

‘শ্রমিক কল‌্যাণ ফাউন্ডেশনের তহবিলে যে টাকাটা আসে তা শ্রমিকদের কল‌্যাণের জন‌্য। কিন্তু শ্রমিকদের কল‌্যাণে তা ব‌্যয় করতে সরকারের কার্পণ‌্য আছে। এছাড়া যে আবেদনের মাধ‌্যমে সহায়তা নিতে হয় তা একজন শ্রমিকের পূরণ করা কঠিন।’- বিলসের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য নইমুল আহসান জুয়েল

যা বলছেন শ্রমিক নেতারা

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য নইমুল আহসান জুয়েল জাগো নিউজকে বলেন, ‘শ্রমিক কল‌্যাণ ফাউন্ডেশনের তহবিলে যে টাকাটা আসে তা শ্রমিকদের কল‌্যাণের জন‌্য। কিন্তু শ্রমিকদের কল‌্যাণে তা ব‌্যয় করতে সরকারের কার্পণ‌্য আছে। এছাড়া যে আবেদনের মাধ‌্যমে সহায়তা নিতে হয় তা একজন শ্রমিকের পূরণ করা কঠিন। নানান দুর্বলতার কারণে শ্রমিকরা বেনিফিটেড না।’

নইমুল আহসান জুয়েল বলেন, ‘ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম‌্যানের সই নিতে হয়। এজন‌্য তাকে ৫০০/১০০০ টাকা দিতে হয়। দেখা যায়, টাকাপয়সা খরচ করে আবেদন করলো কিন্তু সামান‌্য ত্রুটিতে যাচাই-বাছাইয়ে বাদ পড়ে গেলো। এজন‌্য শ্রমিকরা খুব একটা আগ্রহ পান না।’

‘এখন আবেদন দিতে হয় শ্রম অধিদপ্তর এবং কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের মাধ‌্যমে। কেন একজন শ্রমিক এত পথ ঘুরে আবেদন করবে? প্রক্রিয়াটি সহজ করতে হবে। বোর্ডের সদস‌্য যারা আছেন তারা নিজ নিজ ফেডারেশনের আবেদনগুলো পাসের জন‌্য বেশি তৎপর থাকেন। অন‌্যদের দিকে তাকান না। সদস‌্যরা যোগসাজশ করে একজন আরেকজনের ফেডারেশনের আবেদন পাস করাতে ভূমিকা রেখেছেন এমনও হয়েছে। আগের মন্ত্রীর দপ্তর থেকে নিজ এলাকার মানুষকে নয়ছয় করে টাকা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া কোনো কোনো শ্রমিক নেতা চুক্তি করে টাকা নিয়ে দিতেন বিগত সময়ে। এতে প্রকৃত শ্রমিকরা অনেক সময় বঞ্চিত হয়েছেন।’

এনবিআর, চেম্বারগুলো, পুঁজিবাজারসহ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরকে কাজে লাগিয়ে যারা লভ‌্যাংশ দিচ্ছে না তাদের ধরতে হবে বলেও জানিয়েছেন নইমুল আহসান জুয়েল।

‘মন্ত্রণালয়ে (শ্রম ও কর্মসংস্থান) আমরা একটা প্রস্তাব দিয়েছি যে, যারা যোগ‌্য হওয়ার পরও শ্রমিক কল‌্যাণ ফাউন্ডেশনের তহবিলে লভ‌্যাংশ দিচ্ছে না, তারা যাতে সরকারি টেন্ডারে অংশ নিতে না পারে। তবে এর সঙ্গে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় জড়িত। তাই এটি বাস্তবায়নে আন্তমন্ত্রণালয় সভা করতে হবে।’ -শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনের ডিজি মো. মুনির হোসেন খান

যা বললেন ফাউন্ডেশনের ডিজি

ফাউন্ডেশনের সমস্যা, শ্রমিকদের আবেদনের জটিলতা, তহবিলে লভ্যাংশ জমা না দেওয়া প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়াসহ বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেন শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক মো. মুনির হোসেন খান। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা আবেদন অনলাইনে নেওয়ার উদ‌্যোগ নিয়েছি। কাজ হচ্ছে। আমাদের সহায়তা করছে আইএলও (বিশ্ব শ্রম সংস্থা) ও জিআইজেড (জার্মান উন্নয়ন সংস্থা)। একজন শ্রমিক যাতে সহজে আবেদন করতে পারে, তাকে যাতে আবেদন করার জন‌্য ঢাকায় আসতে না হয়- সেই পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। আমরা আগামী অর্থবছর অনলাইনে আবেদন গ্রহণের লক্ষ‌্যমাত্রা নিয়ে এগোচ্ছি। তবে অনলাইন করা হলেও প্রাথমিকভাবে হার্ড কপির আবেদন গ্রহণও অব‌্যাহত থাকবে। ধীরে ধীরে হার্ড কপি তুলে দেব।’

শ্রমিকদের কল‌্যাণে ফাউন্ডেশন ঠিক ভূমিকা রাখতে পারছে না বলে মনে করেন শ্রমিক নেতারা- এ বিষয়ে মহাপরিচালক বলেন, ‘গত আগস্টের পর থেকে পরিচালনা বোর্ড ছিল না। পরে সেটি গঠন করার পর আবেদনের জট সৃষ্টি হয়। প্রায় চার হাজার আবেদন জমে। এখন সেগুলোর যাচাই-বাছাই চলছে। আমরা মে মাসের মধ‌্যে সব আপডেট করে ফেলব। অনেক ভুয়া আবেদন থাকে, যাচাই-বাছাই ছাড়া দেওয়া যায় না। আমরা চাই সহায়তা যাতে প্রকৃত ব‌্যক্তির কাছে যায়।’

শ্রমিক নেতাদের অপতৎপরতার বিষয়ে মুনির হোসেন খান বলেন, ‘আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, সহায়তার চেক জেলায় জেলায় গিয়ে সুবিধাভোগীদের হাতে পৌঁছে দেব।’

আরও পড়ুন শ্রম আইন লঙ্ঘন করছে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো দুই মাসে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় ২১৩ শ্রমিক নিহত: বিলস

তিনি বলেন, ‘আমাদের কাজের ব‌্যাপ্তি বেড়েছে। সেই তুলনায় লোকবল খুবই কম। এগুলো নিয়েও কাজ করছি।’

মহাপরিচালক আরও বলেন, ‘মন্ত্রণালয়ে (শ্রম ও কর্মসংস্থান) আমরা একটা প্রস্তাব দিয়েছি যে, যারা যোগ‌্য হওয়ার পরও শ্রমিক কল‌্যাণ ফাউন্ডেশনের তহবিলে লভ‌্যাংশ দিচ্ছে না, তারা যাতে সরকারি টেন্ডারে অংশ নিতে না পারে। তবে এর সঙ্গে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় জড়িত। তাই এটি বাস্তবায়নে আন্তমন্ত্রণালয় সভা করতে হবে। আমরা একটা মিটিং করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে তা বাস্তবায়নে যাব।’

মুনির হোসেন খান বলেন, ‘আমরা মনে করি কমপক্ষে সাত-আট হাজার কোম্পানি রয়েছে, যারা লাভ করছে এবং তাদের ফাউন্ডেশনের তহবিলে লভ‌্যাংশ দেওয়া উচিত। কিন্তু মাত্র পাঁচশ’র কিছু বেশি কোম্পানি লভ‌্যাংশ দিয়েছে। তবে আমরা চিঠিও দিয়েছি অনেককে। তারা সাড়া দিচ্ছে না। তারা যাতে সাড়া দিতে বাধ‌্য হয় আমরা সেই চেষ্টা করছি। এছাড়া কারা লাভে আছে, সেটি বিভিন্ন কৌশলে বের করার উদ্যোগ নিচ্ছি।’

আরএমএম/এমএমএআর/এমএফএ/এএসএম