সানজানা রহমান যুথীপ্রতিদিনই বিশ্বের কোনো না কোনো জায়গায় কর্মক্ষেত্রে শ্রমিক শ্রেণির দুর্ঘটনা ঘটে। আবার কেউ কেউ চরম স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে ভোগে। এরই লক্ষ্যে প্রতিবছর ২৮ এপ্রিল বিশ্বব্যাপী পালিত হয় কর্মক্ষেত্রে বিশ্ব স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা দিবস।
Advertisement
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা ২০০৩ সালে প্রথম এ দিবসটি চালু করে। এ দিবসের উদ্দেশ্য হলো কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করা এবং দুর্ঘটনা ও রোগ প্রতিরোধে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা। আজ এই দিবসটি শুধু শিল্প-কারখানা নয়, অফিস-আদালত থেকে শুরু করে যে কোনো কর্মক্ষেত্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করে। তাই নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা আমাদের প্রত্যেকের অধিকার।
১৯৮০-এর দশকের শেষভাগ থেকে বিভিন্ন সংগঠন কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তা বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করতে উদ্যোগী হয়। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে ২০০৩ সালে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা এই দিবসটিকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দেয়। দিনটির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, এটি ‘মৃত ও আহত শ্রমিকদের আন্তর্জাতিক স্মরণ দিবস’ এর সঙ্গে যুক্ত-যেখানে কর্মক্ষেত্রে প্রাণ হারানো বা আহত হওয়া শ্রমিকদের স্মরণ করা হয়।
কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তার গুরুত্ব আজকের দিনে আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি। বৈশ্বিক শ্রমবাজারের পরিবর্তন, প্রযুক্তির প্রসার এবং কোভিড-১৯ মহামারির মতো ঘটনা কর্মক্ষেত্রে স্বাস্থ্যঝুঁকি ও সুরক্ষার প্রশ্নকে আরও সামনে এনেছে।
Advertisement
একটি নিরাপদ কর্মপরিবেশ শুধু শ্রমিকের জীবনের জন্যই নয়, প্রতিষ্ঠানের টেকসই উন্নয়নের জন্যও অপরিহার্য। কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনা বা অসুস্থতার কারণে শ্রমিকের উৎপাদনক্ষমতা কমে যায়, প্রতিষ্ঠানের অর্থনৈতিক ক্ষতি হয় এবং সামগ্রিকভাবে সমাজে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার তথ্য মতে, প্রতি বছর প্রায় ২.৩ মিলিয়ন মানুষ কর্মক্ষেত্র-সংশ্লিষ্ট দুর্ঘটনা বা রোগে প্রাণ হারায়। এছাড়া লাখ লাখ মানুষ স্থায়ীভাবে পঙ্গু হন বা দীর্ঘমেয়াদী অসুস্থতায় ভোগেন।
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে শিল্পকারখানার দ্রুত প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে নিরাপত্তার ঝুঁকিও বেড়েছে। এখানে গার্মেন্টস, নির্মাণশিল্প ও কৃষি খাতে কর্মরত শ্রমিকেরা নানা ধরনের ঝুঁকির মুখোমুখি হন। অগ্নিকাণ্ড, ভবন ধস, রাসায়নিক দুর্ঘটনা-এসব দুর্যোগ আমাদের এখনো মনে করিয়ে দেয়, সচেতনতা ও নিরাপদ ব্যবস্থাপনা কতটা জরুরি।
আধুনিক বিশ্বে নিরাপত্তা মানদণ্ডবর্তমানে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসারে, কর্মক্ষেত্রে স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ নীতিমালা মেনে চলা হয়:
ঝুঁকি নির্ধারণ ও ব্যবস্থাপনা: প্রতিটি কর্মক্ষেত্রে সম্ভাব্য ঝুঁকি আগে থেকেই চিহ্নিত করতে হবে এবং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।
Advertisement
১. শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ: নিয়মিত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শ্রমিকদের নিরাপদ কাজের পদ্ধতি শেখাতে হবে।
২. স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণ: কর্মীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং প্রয়োজনে চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে হবে।
৩. নিয়মিত পরিদর্শন: নিরাপত্তা সরঞ্জাম, ইমারজেন্সি এক্সিট, ফায়ার সেফটি-এসব বিষয়ে নিয়মিত পরিদর্শন চালাতে হবে।
৪. শ্রমিকদের অংশগ্রহণ: নিরাপত্তা নীতিমালার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে শ্রমিকদের অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে।
বাংলাদেশের বাস্তবতা ও করণীয়বাংলাদেশে কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিয়ে অনেক অগ্রগতি হলেও এখনো বড় চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। বিশেষ করে গার্মেন্টস শিল্পে বিদেশি ক্রেতাদের চাপ এবং সরকারের উদ্যোগের ফলে কিছু উন্নতি হয়েছে, যেমন ফায়ার সেফটি ও বিল্ডিং সেফটি ইস্যুতে বেশ কিছু প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে। তবুও মাঝেমধ্যে কারখানা দুর্ঘটনা বা নির্মাণ সাইটে প্রাণহানির খবর সামনে আসে।
এখন সময় এসেছে নিরাপত্তাকে শুধু আইনি বাধ্যবাধকতা হিসেবে নয়, বরং প্রতিষ্ঠান সংস্কৃতির অংশ হিসেবে গ্রহণ করার। প্রতিটি কর্মীকে প্রশিক্ষণ দিয়ে সচেতন করতে হবে, মালিকপক্ষকে নিরাপত্তা খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে এবং সরকারি নিয়ন্ত্রণ সংস্থাগুলোকে আরও সক্রিয় ও দায়িত্বশীল হতে হবে। একইসঙ্গে শ্রমিকদের নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হতে হবে, যাতে তারা নিরাপত্তার প্রশ্নে আপস না করেন।
চতুর্থ শিল্প বিপ্লব, অটোমেশন, রিমোট ওয়ার্ক-এসব পরিবর্তন আগামী দিনে কর্মক্ষেত্রে স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার চেহারা বদলে দিচ্ছে। রোবটিক্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহারের পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্য, কর্ম-জীবন ভারসাম্য এবং ডিজিটাল নিরাপত্তার মতো নতুন বিষয়গুলোও গুরুত্ব পাচ্ছে। ফলে নিরাপত্তা নীতিমালাও এখন শুধু শারীরিক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সীমাবদ্ধ নয় বরং মানসিক ও সামাজিক সুস্থতাকেও অন্তর্ভুক্ত করছে।
কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য একটি মৌলিক অধিকার। প্রতিটি শ্রমিকের সুস্থ জীবন ও সম্মানজনক কাজের পরিবেশ নিশ্চিত করা আমাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং নৈতিক দায়িত্ব। কর্মক্ষেত্রে বিশ্ব স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা দিবস আমাদের এই গুরুত্বপূর্ণ দিকটি স্মরণ করিয়ে দেয় এবং আহ্বান জানায়। চলুন, আমরা সবাই মিলে একটি নিরাপদ কর্মজীবন গড়ে তুলি, যেখানে প্রতিটি শ্রমিক নিশ্চিন্তে, নিরাপদে এবং দ্বায়িত্বশীলতার সাথে কাজ করতে পারেন।
আরও পড়ুন রাজকীয় পেঙ্গুইন স্যার নিলস ওলাভ ডিএনএ প্রযুক্তি হোক অপরাধ দমনের অন্যতম হাতিয়ারতথ্যসূত্র: আইএলও, ডব্লিউএইচও
কেএসকে/জিকেএস