অর্থনীতি

শ্রমিক যেখানে সবুজ বিপ্লবের স্বপ্নসারথি

শ্রমিক যেখানে সবুজ বিপ্লবের স্বপ্নসারথি

দেশের প্রধান রপ্তানিপণ্য তৈরি পোশাক। এই শিল্পে শ্রমিক অসন্তোষও বেশি। কর্মপরিবেশ, মজুরি প্রভৃতি নিয়ে তাদের অনেক অপ্রাপ্তির অভিযোগ। এর মধ্যেও অনেক কারখানা এ বিষয়ে ঘটিয়েছে নীরব বিপ্লব। সবুজ কারখানা বদলে দিয়েছে অতীতের সব ধারণা। উদ্যোক্তাদের চিন্তার বৈচিত্র্য, শ্রমিকদের কর্মনিষ্ঠা আর বৈশ্বিক স্বীকৃতিতে বাংলাদেশের পোশাক এখন বিশ্বের ব্র্যান্ড।

Advertisement

সবুজ কারখানা শুধু রপ্তানি খাতে বৈচিত্র্য আনেনি, আমূল পাল্টে দিয়েছে শ্রমিকদের জীবনমান। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পরিবেশবান্ধব টেকসই রূপান্তরের দীর্ঘমেয়াদি সুফল পৌঁছে দিতে শুধু পরিবেশের উন্নয়ন নয়, সংস্কারের পথে সবচেয়ে বড় অংশীজন করতে হবে শ্রমিকদের। কর্মীদের লিঙ্গ বৈষম্য কমানোর ক্ষেত্রেও কাজ করে যাচ্ছে শিল্প। আর্থিক উন্নতি, কমপ্লায়েন্স, কারখানায় পেশাগত নিরাপত্তা বিধানেও দেশ উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধন করেছে।

তৈরি পোশাক শিল্পের উদ্যোক্তারা বলছেন, পোশাক খাতে সবুজ (গ্রিন) কারখানা তৈরির কারণে বিশ্বে বাংলাদেশের পোশাকের ব্র্যান্ড তৈরি হচ্ছে। যার মাধ্যমে লাভবান হচ্ছেন মালিক-শ্রমিক দুই পক্ষই। কারখানায় বৈচিত্র্য আর ভালো কর্মপরিবেশ থাকায় মালিকরা শ্রমিকদের কাছ থেকে বেশি উৎপাদন পাচ্ছেন। শ্রমিকরাও নিরাপদ পরিবেশে স্বাচ্ছন্দ্যে কাজ করছেন। আবার বিদেশি ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে সবুজ কারখানায় তৈরি পোশাকের কদর বেশি থাকে। তাদের (বায়ার) থেকে অর্ডার বেশি ও ভালো দামের সুযোগ তৈরি হয়।

শারীরিক প্রতিবন্ধীকতা নিয়েই কাজ করছেন শান্তনা

Advertisement

বিশ্বের নামি-দামি বড় বড় ক্রেতা প্রতিষ্ঠান সবুজ কারখানা, তার কর্মপরিবেশ এবং শ্রমিকদের নিরাপত্তার বিষয়টি অনেক গুরুত্ব দেয়। পশ্চিমা দেশের ক্রেতারাও যে পোশাকটি কিনছেন তা পরিবেশবান্ধব পদ্ধতিতে তৈরি হয়েছে কি না তার বিবেচনায় এনে পোশাক কেনেন তারা।

কারখানায় মালিক-শ্রমিক সবাই সমান

নির্দিষ্ট সময়ে কাজের শিপমেন্টের বাড়তি চাপ থাকে। এ কারণে অনেক সময় ওভারটাইম করতে হয় শ্রমিকদের। তবু শ্রমিকের স্বাস্থ্যঝুঁকির কথা বিবেচনায় নিয়ে প্রতিটি গ্রিন কারখানায় গড়ে তোলা হয়েছে স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র। চিকিৎসক ও নার্সদের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে নিয়মিত চিকিৎসা নিতে পারেন শ্রমিকরা। রয়েছে বাকপ্রতিবন্ধী ও দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের কাজের সুযোগ। তারা কাজ করে ভালো আছেন। ভালোভাবে চলতে পারছেন, পরিবারেও ফিরেছে সচ্ছলতা।

আরও পড়ুন ‘দেশের ৬ কোটি শ্রমিকের আইনি সুরক্ষা ও মজুরির মানদণ্ড নেই’  নারী শ্রমিকের মাতৃত্বকালীন ছুটি ৬ মাসের আইন করার দাবি  পোশাকশিল্পে কমছে নারী শ্রমিক, নেমে আসতে পারে স্থবিরতা ইপিজেড শ্রমিকদের সামাজিক সুরক্ষা বাড়াতে আসছে ‘আঘাত’ প্রকল্প 

তাদেরই একজন রংপুরের সুবেদা খাতুন। যিনি কাজ করেন ফোর-এ ইয়ার্ন ডায়িং লিমিটেড নামের একটি গ্রিন কারখানায়। সুবেদা জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রতিবন্ধী হওয়ায় অনেকেই নানা কটু কথা বলতো। পরিবারের কাছেও ছিলাম অনেকটা অবহেলিত। ঢাকায় এসে এ কারখানায় কাজ পাই। এখন আমি কারও বোঝা নই। পরিবারকে টাকা দিতে পারি, নিজেও ভালো আছি।’

তৈরি পোশাক মালিক ও রপ্তানিকারক সমিতি-বিজিএমইএর সাবেক সহ-সভাপতি এবং টিম গ্রুপের সহ-প্রতিষ্ঠান ফোর-এ ইয়ার্ন ডায়িং লিমিটেডের কর্ণধার আব্দুল্লাহ হিল রাকিব বলেন, ‘আমাদের পরিবেশবান্ধব কারখানায় প্রত্যেক শ্রমিকের শিশুসন্তানের জন্য দিবাযত্ন কেন্দ্র আছে, সেখানে তাদের খাবারের ব্যবস্থাও আছে। গর্ভবতী মায়েদের জন্য দিনে দুবার বিশ্রামের ব্যবস্থা রাখা হয়। তাদের পুষ্টি চাহিদা পূরণে ওষুধ ও খাবারের ব্যবস্থাও থাকে। কারখানায় কর্মরত সবাই সমান, এ দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের এগিয়ে নিতে অনুপ্রেরণা জোগায়। আমরা এগিয়ে যাচ্ছি, আগামীতেও এ অগ্রগতি অব্যাহত রাখতে চাই।’

Advertisement

নিরাপদ কর্মপরিবেশ ও সুযোগ-সুবিধা

দেশের অন্য কারখানার চেয়ে সবুজ বা গ্রিন কারখানায় শ্রমিকরা অনেকটাই নিরাপদ পরিবেশে কাজ করেন। প্রতিষ্ঠান থেকে শ্রমিকদের দেওয়া হয় নানান সুবিধা। যেখানে রয়েছে বার্ষিক নির্দিষ্ট হারে ইনক্রিমেন্টের পাশাপাশি শতভাগ উৎসব বোনাস, মাসের শুরুতেই বেতনের ব্যবস্থা। তাছাড়া মাসের মাঝামাঝি সময়ে কোনো শ্রমিকের কাছে টাকা না থাকলেও তাকে নিত্যপণ্যের সংকটে ভুগতে হয় না। এসব কারখানার শ্রমিকদের সুবিধার্থে চালু আছে সুপারশপ। যেখানে বাজারের চেয়ে ৩০ শতাংশ কম দামে ভালো মানের পণ্য সরবরাহ করা হয়।

নগদ টাকা না থাকলে বাকিতেই নিত্যপণ্য নিতে পারেন শ্রমিকরা। মাস শেষে এসব বাজারের টাকা সমন্বয় করে দেওয়া হয় বেতন। শিশুরা মায়ের কর্মঘণ্টার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দিবাযত্ন কেন্দ্রে থাকতে পারে। বাড়তি যত্ন নিতে থাকেন নির্ধারিত কর্মী। রয়েছে নাশতা, গোসল, ঘুমানো ও খেলার ব্যবস্থা।

পরিবেশবান্ধব কারখানার টেকনিক্যাল ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত সাথী আক্তার রেনু। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি সবুজ কারখানায় কাজ করে ভালো সাপোর্ট পেয়েছি। আমার বেতনের টাকা দিয়ে জমি কিনেছি। স্বামী-সন্তান নিয়ে ভালো আছি। যে কোনো আদর্শ কারখানায় কোনো শ্রমিককে শ্রমিকের চোখে দেখা হয় না। মালিক-শ্রমিক মিলে কাজ করা হয়, আপন চোখে দেখা হয় অন্যদের। এতে কারখানায় উৎপাদনে সংকট থাকে না।’

গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক সাদেকুর রহমান শামীম জাগো নিউজকে বলেন, ‘এখনো অনেক কারখানায় মাতৃকালীন ছুটির জন্য কোর্টে যেতে হয়, মামলা করতে হয়। এসবের পরিবর্তন হতে হবে, অধিকার ফেরাতে হবে। আমাদের দেশের মতো দক্ষ শ্রমিক বিশ্বের অন্য কোনো দেশে নেই। অথচ অন্য দেশের তুলনায় বেতন কম পাচ্ছেন শ্রমিকরা। কারখানার শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়ন প্রয়োজন। কারখানায় লিফট আছে তবে সেখানে কজন শ্রমিক ব্যবহার করতে পারে সেটা দেখার বিষয়।’

এই শ্রমিক নেতা বলেন, ‘কারখানাগুলো সবুজ হওয়ায় কাজের পরিবেশ এসেছে। এসব পরিকল্পিত কারখানায় দুপুরে শ্রমিকের খাবারের ব্যবস্থা হচ্ছে। এটা আরও হোক। এসব কারখানায় উৎপাদিত পোশাকের রেট বাড়ানো দরকার, অবশ্যই দরকার।’

শ্রমিকের ঘাম আর উদ্যোক্তার চিন্তার বৈচিত্র্যে যে সাফল্য

২০১২ সালে পোশাকশিল্প উদ্যোক্তা সাজ্জাদুর রহমান মৃধার হাত ধরে প্রথম পরিবেশবান্ধব সবুজ কারখানার যাত্রা শুরু হয় বাংলাদেশে। পাবনার ঈশ্বরদী ইপিজেডে স্থাপিত কারখানাটির নাম ‘ভিনটেজ ডেনিম স্টুডিও’। এরপর থেকে ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে সবুজ পোশাক কারখানার সংখ্যা। উদ্যোক্তাদের চিন্তার বৈচিত্র্যে দেশের বস্ত্র ও তৈরি পোশাক খাতে বর্তমানে পরিবেশবান্ধব কারখানা দুই শতাধিক পেরিয়েছে। পরিবেশসম্মত সবুজ কারখানার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লিডারশিপ ইন এনার্জি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ডিজাইন বা এলইইডি সনদ পেয়েছে মোট ২৩৩টি কারখানা।

শারীরিক প্রতিবন্ধকতার কাছে হার না মানা লিপি

এসব কারখানার মধ্যে লিড প্লাটিনাম ৯৩টি, লিড গোল্ড ১২৬টি, লিড সিলভার ১০টি ও সার্টিফায়েড চারটি। ইউনাইটেড স্টেটস গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিল (ইউএসজিবিসি) ‘লিড’ নামে পরিবেশবান্ধব স্থাপনার সনদ দেয়। লিডের পূর্ণাঙ্গ রূপ লিডারশিপ ইন অ্যানার্জি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ডিজাইন। ‘লিড’ সনদ পেতে হলে একটি প্রকল্পকে ইউএসজিবিসির তত্ত্বাবধানে নির্মাণ থেকে উৎপাদন পর্যন্ত বিভিন্ন বিষয়ে সর্বোচ্চ মান রক্ষা করতে হয়।

বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, ‘আমাদের তৈরি পোশাক খাতে নিরাপদ, টেকসই ও পরিবেশবান্ধব শিল্পায়নে গর্ব করার মতো কিছু অর্জন রয়েছে। কর্মীদের লিঙ্গ বৈষম্য কমানোর ক্ষেত্রেও এ শিল্পে কাজ করে যাচ্ছে পোশাকখাত। আর্থিক উন্নতির পাশাপাশি কমপ্লাযেন্স, কারখানায় পেশাগত নিরাপত্তা বিধানেও বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধন করেছে। এ অর্জন আমাদের সহনশীলতা, উদ্যোক্তাদের একনিষ্ঠতা, গতিশীলতা, ত্যাগ ও ঘুরে দাঁড়ানোর প্রত্যয়। নিরাপদ কর্মপরিবেশ অর্জনের মাধ্যমে আমরা আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের আস্থা ধরে রাখতে সফল হয়েছি। আবার বিশ্বে বাংলাদেশ তার দ্বিতীয় স্থান ধরে রাখতেও সক্ষম হয়েছে।’

এক যুগে দ্বিগুণ হয়েছে রপ্তানি

শ্রমিকের ঝরানো ঘামে রপ্তানি দ্বিগুণের বেশি করতে সক্ষম হয়েছে দেশ। যেখানে বড় অবদান রয়েছে শ্রমিকদের, বিশেষ করে নারী শ্রমিকদের। কারণ, এ খাতের সিংহভাগ শ্রমিকই নারী। ২০১১ সালে যেখানে রপ্তানি ছিল ১৪ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার, সেখানে ২০২৪ সালে তৈরি পোশাক খাতে রপ্তানি ৩৮ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন ডলার, অপ্রচলিত বাজারগুলোতেও বেড়েছে প্রবৃদ্ধি। সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) বাজারে। যেখানে রপ্তানির পরিমাণ প্রায় ৫০ দশমিক ৩৪ শতাংশ। সে হিসেবে ইইউতে রপ্তানি হয়েছে ১৯ দশমিক ৩৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের তৈরি পোশাক।

বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি ফজলে শামীম এহসান বলেন, ‘টেকসই উন্নয়ন পোশাক শিল্পের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। শিল্পের বিকাশে সর্বাত্মক প্রচেষ্টার পরিবেশগত টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিতে কাজ করছেন উদ্যোক্তারা। বিশ্বের অন্যতম নিরাপদ এবং পরিবেশবান্ধব পোশাকের গন্তব্য হিসেবে বাংলাদেশ স্বীকৃত ও প্রশংসিত। পোশাক শিল্প তার অসাধারণ সাফল্য অর্জনের জন্য ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ ট্যাগযুক্ত পোশাকের প্রতি বিশ্ব ক্রেতাদের আস্থা বেড়েছে।’

বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই এটি একটি শিল্পকারখানা

তিনি বলেন, ‘বিশ্বের অন্যতম নিরাপদ ও পরিবেশবান্ধব কারখানা আমাদের দেশে। কর্মক্ষেত্রে কর্মীর নিরাপত্তা, পরিবেশগত টেকসই উন্নয়ন এবং শ্রমিকের অধিকার ও কল্যাণের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির জন্য বিশ্বব্যাপী প্রশংসা অর্জন করেছে দেশ। মালিক-শ্রমিকের যৌথ প্রচেষ্টার ফসল হলো এক যুগে দ্বিগুণের বেশি রপ্তানি আয়।’

ফতুল্লা অ্যাপারেলের এই ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) বলেন, ‘আমারা বিপুল অঙ্কের অর্থ খরচ করে গ্রিন কারখানা করেছি। এতে রপ্তানি আহামরি না বাড়লেও বিশ্বব্যাপী ইমেজ বেড়েছে। যে অর্ডার আগে অন্যদের (ভিন্ন দেশে) কাছে যেত সেটা এখানে এসেছে। কাজের পরিবেশ এসেছে, আরামে কাজ করতে পারেন সবুজ বিপ্লেবের স্বপ্নসারথি একজন শ্রমিক।’

ইএআর/এএসএ/জিকেএস