পড়ন্ত এক বিকালে, যখন গোধূলির আলো মেলার মাঠে ছড়িয়ে পড়ছিল, তখন হঠাৎ এক অদ্ভুত শব্দ কানে এলো। ‘টংটং’ একটা পরিচিত, মিষ্টি ঝংকার। সেসব শব্দ যেন আমার শৈশবের গলি ঘুরে চলে এলো, মনে পড়লো সেই মেলা, যেখানে প্রথমবারের মতো টমটম গাড়ি হাতে পেয়েছিলাম। তবে সেদিনের মতো সেই শব্দ আর কানে আসে না। কোথায় যেন হারিয়ে গেছে সেই মাটির টমটম গাড়ি, আর তার স্নিগ্ধ টংটং ধ্বনি।
Advertisement
টমটম অথবা টংটং এটা শুধু একটা শব্দ নয়, বাঙালি সংস্কৃতির একটি অমূল্য প্রতীক। ছোট্ট এই মাটির গাড়ি মেলায়, গাঁও-গ্রামে, শহরের অলিগলিতে ছিল প্রাণের স্পন্দন। একটা সময় ছিল যখন এই গাড়ি ছিল শিশুদের জীবনের অমূল্য সম্পদ, সবার হাতে হাতে ঘুরে বেড়াতো সে মেলা থেকে মেলায়, গাছের ছায়া থেকে রোদে গরম হওয়া মাঠে।
এটি কোনো সাধারণ খেলনা ছিল না; এটা ছিল মাটির গন্ধ, কাগজের রঙিন নকশা, আর বাঁশের চিকন কাঠির মূর্ত রূপ। এটিই ছিল বাঙালির ঐতিহ্য, একটি শৈল্পিক সৃষ্টি, যা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে অক্ষুণ্ণ ছিল। আজ যখন আধুনিক প্রযুক্তি আমাদের ঘিরে ফেলেছে, তখন প্লাস্টিকের বাহারী গাড়ি, রোবট এবং ইলেকট্রনিক গ্যাজেটগুলো আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করছে, ঠিক সেই সময়টায়, মাটির টমটম গাড়ি যেন হারিয়ে যেতে বসেছে।
কিন্তু জানি, এই হারানো ঐতিহ্য অনেকের হৃদয়ে এখনো রয়ে গেছে। বিশেষ করে যাদের স্মৃতির ঝাঁপি খুললেই বেরিয়ে আসে সেই দিনগুলো যখন মেলার ভিড়ে বাবা-মায়ের হাত ধরে প্রথমবারের মতো টমটম গাড়ি কিনেছিলাম। সে দিনের কল্পনা চোখে ভাসে, সেই টংটং শব্দ আর ছোট্ট খেলনা, যা একসময় আমাদের আনন্দের একমাত্র উৎস ছিল।
Advertisement
টমটম গাড়ি তৈরি করার প্রক্রিয়াও এক শিল্পকর্মের মতো। প্রথমে এঁটেল মাটির ছাঁচে দুইটি চাকা এবং একটি বাটি তৈরি করা হয়। সেগুলো রোদে শুকিয়ে আগুনে পোড়ানো হয়, যেন শক্ত হয়। এরপর কাগজের সাহায্যে বাহারি নকশা আঁকা হয়, আর বাঁশের চিকন কঞ্চি দিয়ে তৈরি হয় গাড়ির ফ্রেম। এরপর দুটি পাতলা কাঠি ও একখানা যন্ত্র দিয়ে তৈরি হয় সেই টংটং শব্দ। এই শব্দই যেন গ্রীষ্মের দুপুরে মেলার মাঝে আনন্দের সুর হয়ে ওঠে।
বাঙালির ঐতিহ্য হয়ে ওঠা এই টমটম গাড়ি, ছোট-বড় সবার জন্য এক অনবদ্য স্মৃতি হয়ে থাকে। গ্রাম্য মেলাতে, বৈশাখী উৎসবে, কিশোররা যখন টমটম কিনে মাঠে বেড়ায়, তখন সে টমটম হয়ে ওঠে শৈশবের এক সোনালি মুহূর্ত। নব্বই দশকে বেড়ে ওঠা ছেলেমেয়েদের কাছে এক সুখের স্মৃতি এই গাড়ি। একসময় মাত্র ১০ টাকা কিংবা ২০ টাকায় কেনা এই গাড়ি ছিল আনন্দের চাবিকাঠি। এই মূল্য অনেক কম হলেও, তার সঙ্গে যুক্ত ছিল আবেগ, ঐতিহ্য, আর বাঙালির শিকড়ের অমূল্য সুর।
তবে আজকাল আধুনিকতার ছোঁয়ায় এই ঐতিহ্য হারিয়ে যেতে বসেছে। শিশুরা এখন মোবাইল গেমে, ইলেকট্রনিক খেলনায় মগ্ন। অথচ টমটম গাড়ি ছিল একটি সরল, নির্মল খেলা, যেখানে মাটির ঘ্রাণ, হাতের স্পর্শ, আর ঐতিহ্যর সুগন্ধ মিলেমিশে এক অমোঘ সুখ তৈরি করত। সেই সুখ, সেই স্পর্শ, এখন ভার্চুয়াল জগতের মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছে।
তবে এই হারানো ঐতিহ্যকে আবার ফিরে আনতে হবে। আমাদের সবার দায়বদ্ধতা, বিশেষ করে স্কুল, মেলা এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে, এই ধরনের দেশীয় খেলনার প্রদর্শনী বাড়ানো। বাচ্চাদের হাতে তুলে দেওয়া এই প্রাচীন খেলনা, যাতে তারা টমটমের টংটং শব্দ শুনতে পায়, মাটির তৈরি জিনিসপত্রের দিকে হাত বাড়ায়।
Advertisement
মনে পড়ে, আমি নিজেও প্রথম মেলায় গিয়ে পেয়েছিলাম একটি টমটম। আজও তার মাটির ঘ্রাণ, কাগজের রঙিন নকশা আর সেই ঘূর্ণায়মান চাকার টংটং শব্দ আমার স্মৃতির পাতায় উজ্জ্বল। আমি জানি, শুধু আমি নই, অনেকের কাছেই এই টমটম গাড়ি ছিল এক অনন্ত সুখের স্মৃতি, যা যুগ যুগ ধরে হৃদয়ে বেঁচে থাকবে।
টমটম গাড়ি এটি শুধু একটি খেলনা নয়, এটি বাঙালির আবেগ, সংস্কৃতি এবং শিকড়ের সঙ্গে মিশে থাকা এক অমূল্য সম্পদ। তাই আসুন, আমরা সবাই মিলে এ ঐতিহ্যকে ভালোবাসি, আগলে রাখি এবং পরবর্তী প্রজন্মের কাছে এ দেশীয় ঐতিহ্যটি পৌঁছে দিই।
আরও পড়ুন তুষারের শহর থেকে মহাকাশে লাইকা চরাঞ্চলে একমাত্র যান ঘোড়ার গাড়িকেএসকে/এএসএম