হুমায়ূন কবীর ঢালী
Advertisement
আজ ভোরে ঘুম থেকে জেগেই প্রথম চোখে পড়লো সাহিত্য সমালোচক আহমাদ মাযহারের একটি পোস্ট—কবি দাউদ হায়দারের জীবনাবসান। পোস্টটি দেখেই বেদনাহত ও শোকাহত হলাম। যদিও বিশ্বাস হচ্ছিল না তিনি মারা গেছেন। শ্রদ্ধেয় আহমাদ মাযহারের পোস্টের সত্যতা যাচাই করতে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে ঢুঁ মেরে নিশ্চিত হলাম, সত্যিই নির্বাসিত কবি দাউদ হায়দার আর নেই। তিনি মারা গেছেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭৩ বছর।
জার্মানির স্থানীয় সময় শনিবার (২৬ এপ্রিল) রাত ৯টার দিকে জার্মানির রাজধানী বার্লিনের একটি রিহ্যাবিলিটেশন হোমে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন।
কবি দাউদ হায়দার গত বছরের ডিসেম্বর থেকে বিভিন্ন ধরনের শারীরিক অসুস্থতাজনিত জটিলতায় ভুগছিলেন। এ কারণে বেশ কয়েক মাস জার্মানির বেশ কয়েকটি হাসপাতালেও চিকিৎসাধীন ছিলেন।
Advertisement
দাউদ হায়দারের জন্ম রক্তঝরা ভাষা আন্দোলনের দিন, ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২, পাবনায়।
প্রাথমিক লেখাপড়া পাবনায়। স্কুল-কলেজ ঢাকায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন দৈনিক সংবাদে কিছুদিন সাহিত্য সম্পাদক ছিলেন। তুলনামূলক সাহিত্য নিয়ে পড়েছেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। সে সময় নিয়মিত কলাম লিখতেন পশ্চিমবঙ্গের যুগান্তর ও অমৃতবাজার পত্রিকায়।
কবি দাউদ হায়দার সত্তর দশকের জনপ্রিয় কবি। তাঁর ‘জন্মই আমার আজন্ম পাপ’ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ হয় ২৩ বছর বয়সে। সে সময় গ্রন্থটি তুমুল জনপ্রিয়তা লাভ করে। তাঁর কবিতার জন্য বাংলাদেশে মিছিল-মিটিং হয়। দৈনিক সংবাদ অফিস পুড়িয়ে দেওয়া হয়। কবির পাবনার বাড়িতে আক্রমণ হয়। নিষিদ্ধ হয় তার একটি কবিতা।
কবিতার জন্য দীর্ঘদিন জেল খেটেছেন। কবিতার জন্যই যেতে হয় নির্বাসনে। এক যুগের বেশি ভারতে অবস্থান করে অতঃপর ইউরোপে। অর্থাৎ তিনি দুইবার নির্বাসিত হয়েছেন। একবার বাংলাদেশ থেকে, পরের বার ভারত থেকে।
Advertisement
দাউদ হায়দারকে নিয়ে দুটি ডকুমেন্টরি চলচ্চিত্র নির্মাণ হয়েছে। বিখ্যাত সাহিত্যিক গুন্টার গ্রাস লিখেছেন, ‘দাউদ হায়দারের কবিতা দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে পৃথিবীময়’। জে এম জে এম কোয়েটজি লিখেছেন, ‘তাঁর কবিতা আজকের বিশ্বের রূপালেখ্য। আন্দোলিত আমরা’। মূলত তাঁর কবিতা বিশ্বের সমাজ-রাষ্ট্র-রাজনীতি-টানাপোড়েন, উদ্বাস্তু ও নির্বাসিত মানুষের যন্ত্রণা নানা আলেখ্যে চিত্রিত। সমকালীন বাংলা কবিদের মধ্যে তিনি ছিলেন যথার্থই বৈশ্বিক।
তিনি ছিলেন পৃথিবীজুড়েই ভ্রামণিক। আমন্ত্রিত ছিলেন নানা দেশের সাহিত্য সম্মেলনে। বিশ্বের বিখ্যাত লেখকদের সাথে ছিল দাউদ হায়দারের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ও হৃদ্যতা। বিশ্ববিখ্যাত কবি-সাহিত্যিকদের সাক্ষাৎকারও গ্রহণ করেছেন। যা পরবর্তীতে ‘সাক্ষাৎকার ও অন্যান্য’ শিরোনামে বই আকারে প্রকাশ হয়। তিনি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন উইলিয়ম গোল্ডিং, সুসান সানটাং, ওলে সোয়িঙ্কা, নাডিন গোরডিমার, হ্যারল্ড পাইন্টার, সোফিয়া লরেন, ভি এস নাইপল, পিটার ব্রুক, পিটার উস্তিনভ প্রমুখদের।
কবি দাউদ হায়দারের সাথে আমার ব্যক্তিগতভাবে সাক্ষাৎ হয়েছিল ২০১৪ সালে, নিউইয়র্কে। সে বছর তিনি মুক্তধারা বইমেলার আমন্ত্রিত অতিথি ছিলেন। সে সাক্ষাতে ৫-৬ দিন প্রাণবন্ত আড্ডা হয় কবির সাথে। প্রবাসে নির্বাসনে থাকলেও তিনি বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্য নিয়ে নিয়মিত খোঁজ-খবর রাখতেন। সমকালীন কবি-সাহিত্যিকদের সাহিত্য পড়তেন, জানতেন। ২০১৪ সালের সাক্ষাতে তিনি আমাকে তাঁর কাব্যগ্রন্থ ‘নদীর উৎস ছিল এখানে’ উপহার হিসেবে দিয়েছিলেন।
কবি দাউদ হায়দারের প্রয়াণে শোকাহত। তাঁর আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি। অনন্তলোকে তিনি শান্তিতে থাকুন।
লেখক: শিশুসাহিত্যিক ও প্রকাশক।
এসইউ/জেআইএম