ফিচার

ডিএনএ প্রযুক্তি হোক অপরাধ দমনের অন্যতম হাতিয়ার

ডিএনএ প্রযুক্তি হোক অপরাধ দমনের অন্যতম হাতিয়ার

মুহাম্মাদ রবিউল ইসলাম

Advertisement

২৫ এপ্রিল ২০২৫ সালটি বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পালিত হচ্ছে ‘আন্তর্জাতিক ডিএনএ দিবস’ বা ‘বিশ্ব ডিএনএ দিবস’ হিসেবে। এই দিনটিতে স্মরণ করা হয় ডিএনএ-এর আনবিক গঠনের আবিষ্কারের দিনটিকে স্মরণ করার মধ্য দিয়ে।

১৯৫৩ সালের ২৫ এপ্রিল জেমস ওয়াটসন, ফ্রান্সিস ক্রিক, মরিস উইলকিন্স, রোজালিন্ড ফ্র্যাঙ্কলিন এবং তার সহকর্মীরা ডিএনএর আনবিক কাঠামোর উপর তাদের গবেষণাপত্র বিশ্ববিখ্যাত জার্নাল নেচারে প্রকাশ করেছিলেন। তাই এ দিনটিকে উদযাপন করে থাকেন বায়োলজিক্যাল সায়েন্স, জীবপ্রযুক্তিবিদ ও জিন প্রকেীশলী, মলিকুলার বায়োলজি, জেনেটিক্স সর্ম্পকে আগ্রহী সহ সংশ্লিষ্ট বিষয়ের সঙ্গে জড়িত ছাত্র, শিক্ষক ও পেশাজীবী সংগঠনের ব্যক্তিরা।

তবে ডিএনএ প্রথম আবিষ্কৃত হয় ১৮৬৯ সালে সুইস রসায়নবিদ ফ্রিডরিখ মিসারের মাধ্যমে। ফ্রেড‌রিক মীসার একজন তরুণ সুইডিস চি‌কিৎসক ১৮৬৯ সা‌লের শীতকা‌লে ‘টু‌বিন‌জেন ইউনিভা‌র্সিটির’‘ফে‌লিক্স হোপ হেইলার’ নামক ল্যাবরেটরীতে রক্তের শ্বেত ক‌ণিকার উপাদানের উপর কাজ করতে গিয়ে সর্বপ্রথম ‘ডিএনএ’ এর সন্ধান পান।

Advertisement

ডিএনএ ফিঙ্গার‌প্রিন্টিং বা ডিএনএ প্রোফাইলিং কী?ডিএনএ ফিঙ্গার‌প্রিন্টিং সারা বিশ্বে এখন‌ ডিএনএ প্রোফাইলিং নামে সর্বা‌ধিক প‌রি‌চিত। এটিকে সংক্ষেপে বলা যেতে পারে একজন মানুষের জেনে‌টিক ফটোগ্রাফ। এক‌টি মানব কোষে জনন কোষ ছাড়া প্রায়‌ তিনশত কো‌টি বেইস পেয়ার থাকে। এর মধ্যে শতকরা দশভাগ ডিএনএ চ‌ল্লিশ হাজারের বেশি জিনকে ধারন করে। ডিএনএ প্রোফাইল অর্থ ডিএনএ অনুতে অবস্থিত অন্যূন ১০ (দশ) টি জেনেটিক মার্কার হইতে প্রাপ্ত জেনোটাইপের সমন্বয়ে গঠিত ডিএনএ নমুনা বিশ্লেষণের ফলাফল। যা আলফা নিউমেরিক ভ্যালু হিসেবে প্রকাশ করা হয়। উদাহরণ স্বরুপ- ২ নং ক্রোমোসোম এ অবস্থিত টিপিওএক্স একটি জেনেটিক মার্কার। এমন ১০টি এসটিআর লসি বা জেনেটিক মার্কার ব্যবহার করে ফরেনসিক ডিএনএ পরীক্ষার বা ডিএনএ প্রোফাইলিং এর রিপোর্ট প্রস্তুত করতে হয়।

জিন কী?জিন হল ডিএনএ-এর এক‌টি নি‌র্দিষ্ট অংশ বা‌ সেগ‌মেন্ট, যা এক‌টি নি‌র্দিষ্ট বৈ‌শিষ্ট্য যেমন, চোখের রং, চুলের রং ইত্যাদির জন্য দায়ী। জিনগুলো পরস্পরের মধ্যে ইনট্রোন নামক ননকো‌ডিং ডিএনএ অবস্থান করে। মানুষের মোট ডিএনএ-এর শতকরা নব্বই ভাগই হলো এই ননকো‌ডিং ডিএনএ। ননকো‌ডিং ডিএনএ-এর কাজ এখনও জানা যায় নি ব‌লে একে জাংক ডিএনএ বলা হয়। মানুষ সব ডিএনএ তার পিতা মাতার কাছ থেকে পায়। প্রতি‌টি মানুষের ৯৯.৯ শতাংশ ডিএনএ একই, পার্থক্য শুধু ০.১ শতাংশ ডিএনএ তে। মজার ব্যাপার হলো এই ০.১ % ডিএনএ এর অবস্থান ননকো‌ডিং অঞ্চ‌লে।

ডিএনএ গ‌ঠিত হয় মূলত চার‌টি নাইট্রোজেনাস বেস দ্বারা এগুলো হলো এডে‌নিন, গুয়া‌নিন, সাইটো‌সিন ও থায়া‌মিন। এই চার‌টি অক্ষর দিয়ে জেনে‌টিক কোড বা জেনে‌টিক্স এর বিশ্বকোষ লিখা হয়। ডিএনএ প্রোফাইলিং বা ডিএনএ ফিঙ্গারপ্রিন্টিংয়ের যে কৌশল জিনতত্ত্ববিদ অ্যালেক জেফ্রিজ আবিষ্কার করেছিলেন, তার মাধ্যমে যে অপরাধী শনাক্ত করা যেতে পারে, এটা প্রথমে কারোরই মাথায় আসেনি। পৃথিবীর ইতিহাসে তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি ডিএনএ প্রোফাইলিংয়ের ব্যবহার বিচারকার্যে শুরু করার প্রস্তাব দেন যুক্তরাজ্যের আদালতে ১৯৮৫ সালের দিকে।

তারপর ১৯৮৬ সাল থেকে অপরাধ বিজ্ঞান ও অপরাধমূলক বিচারব্যবস্থায় ডিএনএ প্রযুক্তি বা ডিএনএ ফিঙ্গারপ্রিন্ট একটি যুগান্তকারী সংযোজন হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এটি বিচারব্যবস্থাকে একটি নতুন যুগে উত্তরণ ঘটিয়েছে। হত্যা বা ধর্ষণের মতো সহিংস অপরাধ দমন, পিতৃত্ব-মাতৃত্ব নির্ণয়, মৃত ব্যক্তির পরিচয় উদ্ধার, কিডনি দাতা-গ্রহীতার সম্পর্ক নির্ণয়, প্রবাসীদের পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ণয়, নারী পাচার ও অবৈধ অভিবাসী প্রতিরোধে ডিএনএ পরীক্ষাসহ প্রবাসী শ্রমিকদের লাশ দেশে আনার ক্ষেত্রে ডিএনএ প্রোফাইলিংয়ের ব্যবহার প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে।

Advertisement

বাংলাদেশে ডিএনএ প্রযুক্তি এর যাত্রা শুরু হয় ২০০৬ সালে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ম‌হিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নারী নির্যাতন প্রতিরোধকল্পে মা‌ল্টিসেক্টরাল প্রোগ্রামের অধীনে ঢাকা মে‌ডিকেল কলেজ ক্যাম্পাসে ২০০৬ সালের ২৩ জানুয়ারি স্থাপন করা হয়ে‌ছিল দেশের সর্বপ্রথম ন্যাশনাল ফরেনসিক ডিএনএ প্রোফাইলিং ল্যাবরেটরী। এরই ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে দেশের ৮ বিভাগীয় মেডিকেল কলেজ হাসাতালে প্রতিষ্ঠিত হয় ৮ বিভাগীয় ডিএনএ স্ক্রিনিং ল্যাবরেটরী। তারপর ২০১৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ফরেনসিক ডিএনএ ল্যাবরেটরী অব বাংলাদেশ পুলিশ’ এর ফরেনসিক ডিএনএ ল্যাবরেটরী ঢাকার মালিবাগে।

বাংলাদেশের সব ফরেনসিক ডিএনএ ল্যাবরেটরীসমূহে পরিচালনার জন্য সরকার প্রতিষ্ঠা করেছে ২০২০ সালে ডিএনএ ল্যাবরেটরী ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর যেটি মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে পরিচালিত হছে। ২ টি ফরেনসিক প্রোফাইলিং ল্যাবরেটরী এবং ৮টি ফরেনসিক ডিএনএ স্ক্রিনিং ল্যাবরেটরীর মাধ্যমে বাংলাদেশের ফরেনসিক ডিএনএ ল্যাবরেটরীর কাজ পরিচালিত হচ্ছে। উক্ত ল্যাবরেটরীসমূহ হতে আদালত, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, হাসপাতাল এবং বৈদে‌শিক দূতাবাসসমূহের জন্য ডিএনএ প্রোফাইলিং সু‌বিধা প্রদান হচ্ছে।

ডিএনএ আইন প্রণয়ন করেছে এমন দেশের সংখ্যা বিশ্বে ৬৪টি। এর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৬১ তম। বাংলাদেশে ডিএনএ আইন পাস হয় ২০১৪ সালে এবং কার্যকর হয় ২০১৪ সালের ৯ অক্টোবর হতে। ডিএনএ আইনে নিম্নেবর্ণিত নমুনা ছাড়া ডিএনএ পরীক্ষা করা যাবে না মর্মে উল্লেখ রয়েছে। ডিএনএ নমুনা পরীক্ষা:- নিম্নবর্ণিত উদ্দেশ্য ব্যতীত অন্য কোনো উদ্দেশ্যে ডিএনএ নমুনা ও ডিএনএ প্রোফাইল ব্যবহার করা যাবে না, যথা-(ক) কোনো ব্যক্তি শনাক্তকরণ; (খ) কোনো অপরাধের সহিত সংশ্লিষ্ট কোনো ব্যক্তি; (গ) নিখোঁজ বা অজ্ঞাত ব্যক্তি শনাক্তকরণ; (ঘ) দুই বা ততোধিক ব্যক্তির মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক নিরূপণ; (ঙ) প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা দুর্ঘটনাজনিত কারণে মৃত ব্যক্তি শনাক্তকরণ; (চ) বিরোধ নিষ্পত্তি; এবং (ছ) বিধি দ্বারা নির্ধারিত অন্য কোনো বিষয়।

ডিএনএ আইন এ ডিএনএ ডাটাবেজ প্রতিষ্ঠার কথা উল্লেখ রয়েছে যেটির মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের অপরাধীদের অতিদ্রুত শনাক্ত করা সম্ভব হবে। বি‌শ্বের সর্বপ্রথম ডিএনএ ডাটাবেজ প্রতি‌ষ্ঠিত হয় ১৯৮৫ সালে যুক্তরাজ্যে। এই ডাটাবেজে প্রায় ৬২ লাখের উপরে ডিএনএ প্রোফাইল মজুদ রয়েছে, যার ৫৮ লাখ প্রোফাইল ব্যক্তি পর্যায়ের ও ৪ লাখ ক্রাইম সীন প্রোফাইল।বিশ্বের চারটি ডাটাবেজ প্রতিষ্ঠানে ২ কোটি ৬০ লাখ মানুষ তাদের ডিএনএ অন্তর্ভুক্ত করেছে। এসব প্রতিষ্ঠান হচ্ছে-অ্যানসেসট্রি, ২৩এন্ডমি, মাইহেরিটেজ এবং জিন বাই জিন।

কি ধরনের অপরাধস্থল হতে ডিএনএ নমুনা নিয়ে ডিএনএ ডাটাবেজ প্রতিষ্ঠা করতে হবে তা ডিএনএ আইনে উল্লেখ রয়েছে। ডিএনএ আইন ২০১৪ এর ধারা ২৪ অনুসারে-সরকার, ডিএনএ ল্যাবরেটরী কর্তৃক সম্পাদিত ডিএনএ প্রোফাইল সম্বলিত নিন্মবর্ণিত ইনডেক্সসমূহ সমন্বয়ে একটি জাতীয় ডিএনএ ডাটাবেজ প্রতিষ্ঠা করবে, যথাঃ (ক) অপরাধস্থল ইনডেক্স (খ) সাজাপ্রাপ্ত অপরাধী ইনডেক্স (গ) অজ্ঞাত ব্যক্তিদের ইনডেক্স এবং (ঘ) সরকার কর্তৃক সময় সময় নির্ধারিত অন্য কোনো ইনডেক্স

(২) উপ-ধারা (১) এ বর্ণিত ইনডেক্সসমূহে ডিএনএ বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রাপ্ত ডিএনএ প্রোফাইল এবং ডিএনএ সংক্রান্ত অন্যান্য তথ্যাদি অন্তর্ভূক্ত থাকিবে। বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থায় ডিএনএ প্রযুক্তি এর মাধ্যমে অপরাধী শনাক্তকরণের নব দিগন্ত উম্মেচিত এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

আরও পড়ুন লোকজ আনন্দে ফিরে দেখা শেকড়  বিশ্ব ধরিত্রী দিবস/ প্রতিনিয়ত বদলে যাচ্ছে ধরিত্রী 

লেখক: বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও ল্যাবরেটরী রিসিভারকারী দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, বিভাগীয় ডিএনএ স্ক্রিনিং ল্যাবরেটরী, ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।

কেএসকে/জিকেএস