মো. আবু রায়হান
Advertisement
এক মুঠো বাতাসের খোঁজে মানুষের হাতের তালুতে জন্ম হয়েছিল হাতপাখা নামক এক সহজ সরঞ্জামের। সময়ের স্রোতে বদলেছে সভ্যতা, পাল্টেছে প্রযুক্তি, কিন্তু হাতপাখা তার সরল রূপ ধরে রেখেছে আপন মহিমায়। বদলেছে কেবল তার ভূমিকা, নির্মাণশৈলী ও মানুষের সঙ্গে সম্পর্কের ধরণ। একবার পেছন ফিরে তাকালে দেখা যায় হাতপাখার এক দীর্ঘ ও বৈচিত্র্যময় অভিযাত্রা।
হাতপাখার ব্যবহার শুরু হয়েছিল প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে। প্রাচীন মিশরে ফেরাউনদের রাজসভায় দাঁড়িয়ে থাকা দাসেরা সোনার কাঠামোতে বাঁধা ময়ূর পালকের পাখা দুলিয়ে রাজাকে শীতল রাখত। চীনের হান রাজবংশ কিংবা জাপানের হেইয়ান যুগেও হাতপাখা ছিল সম্মানের প্রতীক। ভারতের মন্দির-আশ্রমেও দেবতাদের উদ্দেশ্যে হাতপাখা দিয়ে বাতাস করার প্রচলন ছিল।
বাংলার আবহাওয়ার দাবদাহের সঙ্গে তাল মেলাতে তালপাতা, খেজুরপাতা, কিংবা বাঁশের সাহায্যে স্থানীয়ভাবে হাতপাখা তৈরি শুরু হয়। এই হাতপাখা হয়ে ওঠে প্রতিটি ঘরের নিত্যসঙ্গী। দুপুরের কড়াচড়া রোদ কিংবা বিদ্যুৎহীন রাত হাতপাখার নরম বাতাসে ঘুমিয়ে পড়ত মানুষ। শুধু ব্যবহারিক চাহিদা মেটানো নয়, হাতে বোনা এই পাখাগুলো কখনো কখনো হয়ে উঠত স্নেহের বাহকও।
Advertisement
সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে হাতপাখায় যুক্ত হতে থাকে শিল্পের ছোঁয়া। সাধারণ তালপাতার পাখা ছাড়াও দেখা যায় বাঁশের চিকন বুননে তৈরি পাখা, যার গায়ে আঁকা রঙিন ফুল, পাখি, নকশা। গ্রামীণ মেলায়, বৈশাখী উৎসবে কিংবা বিয়ের উপহার সামগ্রী হিসেবে বাহারি হাতপাখার সমারোহ চোখে পড়ে। একরকম হাতপাখা হয়ে দাঁড়ায় ব্যক্তিগত রুচি ও সৌন্দর্যবোধের প্রকাশ।
বিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে যখন ঘরে ঘরে বৈদ্যুতিক পাখা পৌঁছাতে শুরু করল, হাতপাখার প্রয়োজনীয়তা কমতে থাকে। এসির ঠান্ডা বাতাসের আরামে মানুষ হাতপাখাকে ভুলতে শুরু করে। শহরাঞ্চলে তো বটেই, গ্রামেও আজ বিদ্যুৎ থাকায় আগের মতো প্রতিটি বাড়িতে হাতপাখার ঝুলন্ত সারি দেখা যায় না। তবুও বিদ্যুৎ চলে গেলে কিংবা খুব গরমের দিনে অথবা বিশেষ কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠানে এখনো হাতপাখার টুকটুকে বাতাসের কদর অক্ষুণ্ন। গ্রামবাংলার চাষের মাঠে বিশ্রামরত কৃষকের হাতে এখনো চোখে পড়ে পুরোনো হাতপাখার দোলা।
যদিও ব্যবহারিক গুরুত্ব কমেছে, হাতপাখা আজও হারিয়ে যায়নি। বরং হস্তশিল্পের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে নতুন পরিচয় পেয়েছে। বিভিন্ন মেলায়, হস্তশিল্প প্রদর্শনীতে বা ঘরের দেয়াল সাজানোর উপকরণ হিসেবে হাতপাখা নতুন জীবন পেয়েছে। নস্টালজিয়ার টানেই হোক বা ঐতিহ্য সংরক্ষণের চেষ্টা, হাতপাখা আজও টিকে আছে বাংলার মাটির সুবাস নিয়ে।
হাতপাখা ইতিহাসের জীবন্ত সঙ্গী, সংস্কৃতির বুনন ও ভালোবাসার স্মারক। আধুনিক জীবনের চাকচিক্যের মাঝেও হাতপাখার দোল মনে করিয়ে দেয়, আমরা একদিন তালপাতার বাতাসে স্বপ্ন দেখতাম, মাটির ঘ্রাণে জীবন খুঁজে পেতাম।
Advertisement
লেখক: শিক্ষার্থী, রাজশাহী কলেজ
কেএসকে/এএসএম